দেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্যানসারে মৃতের সংখ্যাও। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভারতে পুরুষদের তুলনায় ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন মহিলারা! তবে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার মহিলাদের মধ্যে তুলনামূলক কম।
দেশ জুড়ে ৪৩টি ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা একটি সমীক্ষা চালান। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তার পর তা বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলে উন্নীত হন। সেই ফলাফলে দাবি করা হয়, ২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে সাত লক্ষ আট হাজার জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দু’লক্ষ ছ’হাজার জনের।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করেছেন গবেষকেরা। বিশ্লেষণের সময় মাথায় রাখা হয়েছে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যু এবং প্রবণতার তথ্যকে। দিল্লির এমস, চেন্নাইয়ের আদিয়ার ক্যানসার ইনস্টিটিউট, মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারের মতো চিকিৎসাকেন্দ্রগুলি থেকে তথ্য নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা।
মহিলাদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্তের হার বেশি
ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক চিত্রটি তুলে ধরেছেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর (আইসিএমআর) চিকিৎসক প্রশান্ত মাথুর। তাঁকে উদ্ধৃত করে ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে ৫১.১ শতাংশ মহিলা। তবে মৃত্যুর হার পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের কম (৪৫ শতাংশ)। গত ১০ বছরে মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা জরায়ু ক্যানসারের তুলনায় বেড়েছে। তবে এই দুই ক্যানসারই মহিলা আক্রান্তদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। যদিও এই ধরনের ক্যানসার নিরাময় সম্ভব। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসার মাধ্যমে কর্কট রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন মহিলারা। সেই তুলনায় ক্যানসার আক্রান্ত পুরুষদের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা কম। তামাক সেবন ও দূষণের কারণে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসে ক্যানসার বেড়েছে। প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে মুখের ক্যানসারের। অন্য দিকে, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে গত কয়েক বছরে পাকস্থলী, বৃহদন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্তের হারও বেড়েছে।
মুখের ক্যানসারের প্রকোপ বেড়েছে
সাম্প্রতিক সময়ে মুখের ক্যানসার ভয় ধরাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। চিন্তিত চিকিৎসকেরাও। পুরুষদের মধ্যে এই ধরনের ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। শুধু তা-ই নয়, মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া মহিলাদের থেকে পুরুষদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এই ক্যানসারের মূলেই রয়েছে অতিরিক্ত তামাক সেবন। গুটখার মতো মাদকদ্রব্য এই ধরনের ক্যানসারের জন্য বেশি দায়ী। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে ‘গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে’র রিপোর্ট। ২০০৯-২০১০ এবং ২০১৬-২০১৭ সালের তামাক সেবনের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানিয়েছেন, আগের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতায় ৬ শতাংশ হ্রাস লক্ষণীয়। তবে শুধু গুটখা নয়, অতিরিক্ত মদ্যপানও ঝুঁকির কারণ।
দিল্লি এমসের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিষেক শঙ্করের মতে, যকৃতের ক্যানসার, মুখের ক্যানসার-সহ কমপক্ষে সাত ধরনের ক্যানসারের জন্য দায়ী মদ্যপান। এই অভ্যাস পুরুষদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। যদি কেউ মদ এবং তামাক, দুই সেবন করেন, তবে তাঁদের শরীরে কর্কট রোগ বাসা বাঁধার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
উত্তর-পূর্বে সতর্কতা
মিজ়োরামের রাজধানী আইজ়লে পুরুষদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক লক্ষের মধ্যে ১৯৮ জন ক্যানসার আক্রান্ত। সেখানে মহিলাদের সংখ্যা ১৭২। জীবনধারা, পরিবেশ এবং সংক্রমণ — এই সব নানা কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতে ক্যানসার আক্রান্তের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলেছে। আইসিএমআর-এর চিকিৎসক মাথুর বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার জাতীয় গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি।’’ এ ছাড়াও, খাদ্যাভাসও ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যা দায়ী।
ভৌগোলিক বিস্তার
ভারতের কোন জায়গায় কোন ধরনের ক্যানসার আক্রান্তের প্রবণতা বেশি, তা-ও সমীক্ষার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। হায়দরাবাদে স্তন ক্যানসারের হার বেশি। আইজ়লে জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্তের হার ২৭.১ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসে ক্যানসার আক্রান্তের হারে প্রথমে রয়েছে শ্রীনগর (৩৯.৯ শতাংশ)। মহিলাদের মধ্যে এই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি আইজ়লে। বিশাখাপত্তনম, বেঙ্গালুরু, কোল্লম, তিরুঅনন্তপুরম, চেন্নাই, দিল্লিতেও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। মুখের ক্যানসারের হার পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অহমদাবাদে। পূর্ব খাসি পাহাড় অঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে মুখের ক্যানসার বেশি দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় এবং রাজ্য পর্যায়ের প্রয়োজনীয় পরিকল্পনাই ক্যানসারের ভৌগোলিক বিস্তার রোধ করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসা এবং জীবনধারার পরিবর্তনও কর্কট রোগ থেকে বাঁচতে বড় ভূমিকা নেয়।