বাঙালি বাড়িতে বাচ্চার পাঁচ বছরের জন্মদিন অনেক সময় ধুমধাম করে পালন করা হয়। সারা ভারতেও সেই প্রথা আছে কি না জানি না। তবে অ্যাস্ট্রোস্যাটের পাঁচ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান বেশ বড় করেই উদ্যাপিত হল গত সপ্তাহে। এই উপলক্ষে ইসরো একটি তিন দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সভার আয়োজন করেছিল ১৯-২১ জানুয়ারি। অতিমারি পরিস্থিতির কারণে সভাটি হল অনলাইন। দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রোস্যাট ব্যবহার করে যা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার বর্ণনা দিলেন। বোঝালেন, বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কে কী কী নতুন তথ্য জানা গিয়েছে।
অ্যাস্ট্রোস্যাট কী এবং ইসরো কেন প্রায় ১৭৮ কোটি টাকা খরচ করে দশ বছরের প্রচেষ্টায় তৈরি করল, সেটা বোঝার জন্য আমাদের একটু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উন্নত মানের রেডার নির্মাণ করার জন্য রেডিয়ো তরঙ্গ শনাক্তকরণের প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি সাধন করা হয়েছিল। যুদ্ধের পর সেই প্রযুক্তিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কাজে লাগালেন মহাজাগতিক বস্তু থেকে রেডিয়ো তরঙ্গের বিকিরণ শনাক্ত করার কাজে। একই ভাবে রকেট প্রযুক্তির উন্নতিকে ব্যবহার করে স্বল্প সময়ের রকেট উড়ানে এক্স-রে তরঙ্গ শনাক্তকরণের যন্ত্র বসিয়ে মহাজাগতিক এক্স-রে বিকিরণের পর্যবেক্ষণও শুরু হয় ১৯৫০-এর পর থেকেই। ২০০২ সালে রিকার্ডো জাক্কোনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান এক্স-রে জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে।
শুধু তা-ই নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, আমরা যে আলো চোখে দেখি (দৃশ্যমান আলো) তার চেয়ে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ‘আলো’ তথা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যেমন—ইনফ্রারেড, মাইক্রোওয়েভ, রেডিয়ো এবং তার থেকে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো, যেমন অতিবেগুনি, এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদিও মহাজাগতিক বিভিন্ন বস্তু থেকে নিয়মিত ভাবে বিকিরিত হচ্ছে। এই সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ঠিক ভাবে শনাক্ত করলে ওই বস্তুগুলির প্রকৃতি নির্ধারণ অনেক সুগম এবং সম্পূর্ণ হবে। আমাদের কোনও অসুখ হলে যেমন এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, এমআরআই-সহ নানা পদ্ধতিতে আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়ার দোষত্রুটি নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়, সেই রকমই মহাজাগতিক বস্তু থেকে আসা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে বস্তুটির মধ্যে কী উপাদান আছে এবং কী ধরনের প্রক্রিয়া চলছে, তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এক্স-রে’র ব্যবহার যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, সে রকম দৃশ্যমান আলো ছাড়াও অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের পর্যবেক্ষণ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
কিন্তু একটা মুশকিল হল, দৃশ্যমান আলো ও রেডিয়ো তরঙ্গ ছাড়া আর কোনও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে না। এটাকে ‘মুশকিল’ বলছি বটে, কিন্তু সেটা শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার প্রসঙ্গে। আমাদের বায়ুমণ্ডল যদি অতিবেগুনি, এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি শক্তিশালী বিকিরণকে না আটকাত, তা হলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকত না। তা হলে উপায়? বিজ্ঞানীরা বুঝলেন যে, এর জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রকেই ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে পাঠাতে হবে, যেখানে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব খুব কম। সেখান থেকেই জন্ম নেয় মহাকাশ-দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (স্পেস টেলিস্কোপ) ধারণা। প্রথম দিকে রকেট বা বেলুনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে অনেক উচ্চতায় পাঠিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হল। তার পর দীর্ঘ সময় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে পৃথিবীর চার পাশে একটি কক্ষপথে পাঠানো হল। পৃথিবীকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিক্রম করতে করতে বিভিন্ন মহাকাশ-দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলি মহাজাগতিক নানা রহস্যভেদ করে চলেছে গত প্রায় তিন-চার দশক ধরে।
এ বার ফিরে আসা যাক অ্যাস্ট্রোস্যাটের কথায়। অ্যাস্ট্রোস্যাট হল ভারতে তৈরি করা প্রথম মহাকাশ-পর্যবেক্ষণাগার। ২০০৪ সালে ইসরো অ্যাস্ট্রোস্যাট তৈরি করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। ইসরো ছাড়াও দেশের অনেকগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র এবং কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রোস্যাটের বিভিন্ন দূরবীক্ষণ ও সেগুলির যন্ত্রাংশ তৈরির দায়িত্ব নেয়। অ্যাস্ট্রোস্যাটে রয়েছে আলাদা আলাদা পাঁচটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র— ইউভিট, এসএক্সটি, ল্যাক্সপিসি, সিজ়েডটিআই এবং এসএসএম। অ্যাস্ট্রোস্যাটের একটি বিশেষত্ব হল, এই দূরবীক্ষণগুলি দিয়ে অতিবেগুনি থেকে শুরু করে কম শক্তি ও বেশি শক্তির এক্স-রে অবধি তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালির একটি বিস্তৃত পরিসরে একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটি বিশ্বের অন্য কোনও দূরবীক্ষণে সম্ভব নয়। অ্যাস্ট্রোস্যাট দৃশ্যমান আলোর থেকে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের, তথা বেশি শক্তিশালী বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে। এই ধরনের বিকিরণ আসে মহাজগতের এমন উৎস থেকে, যেখানে বিভিন্ন উচ্চশক্তিসম্পন্ন ভৌতপ্রক্রিয়া চলছে। যেমন, গ্যালাক্সির সেই সব অংশ, যেখানে তৈরি হচ্ছে নতুন নক্ষত্র, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, এবং বিচিত্রধর্মী কিছু বিশেষ নক্ষত্র, যেমন— শ্বেত বামন (হোয়াইট ডোয়ার্ফ) ও নিউট্রন নক্ষত্র, যেগুলির মহাকর্ষ বল সূর্যের তুলনায় যথাক্রমে প্রায় ১০ হাজার ও ১০০ কোটি গুণ বেশি। আর উচ্চশক্তিসম্পন্ন মহাজাগতিক বিকিরণের সবচেয়ে পরিচিত উৎস হল কৃষ্ণগহ্বর, যার মহাকর্ষ বল এত বেশি যে, আলোও সেখান থেকে বার হতে পারে না। শ্বেত বামন, নিউট্রন নক্ষত্র বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রবল আকর্ষণে এগুলির খুব কাছাকাছি থাকা কোনও সাধারণ নক্ষত্র থেকে গ্যাসীয় পদার্থ এগুলির দিকে দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয় এবং খুব তপ্ত হয়ে ওঠে। এই উত্তপ্ত গ্যাসীয় প্রবাহ থেকে বিকিরিত হয় অতিবেগুনি ও এক্স-রে তরঙ্গ।
গত পাঁচ বছরে অ্যাস্ট্রোস্যাটের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহাজাগতিক নানা বস্তু ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। অ্যাস্ট্রোস্যাটের ইউভিট দূরবীক্ষণে শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৯৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্যালাক্সি থেকে বিকিরিত অতিবেগুনি রশ্মি। এর থেকে মহাবিশ্বের ইতিহাসের একদম প্রথম দিকে কী ভাবে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল, সেই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ঠিক এই ধরনের পর্যবেক্ষণ এর আগে অন্য কোনও দূরবীক্ষণের দ্বারা সম্ভব হয়নি। সূর্য থেকে অনেক ভারী নক্ষত্রের জীবনের শেষ দিকে নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়ে যখন কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়, সেই সময় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে স্বল্প শক্তির গামা-রে বিকিরিত হয়। অ্যাস্ট্রোস্যাটের সিজ়েডটিআই দূরবীক্ষণের মাধ্যমে সেই গামা-রে’র পোলারাইজ়েশান ধর্ম ও সময়ের সঙ্গে তার পরিবর্তন এই প্রথম সঠিক ভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর থেকে নক্ষত্রের জীবনের শেষ ভাগে কী ধরনের ভৌত প্রক্রিয়া হয়, সেই সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে। এর আগে একই ভাবে গামা-রে’র পোলারাইজ়েশন সঠিক ভাবে শনাক্ত করে ক্র্যাব পালসারের মধ্যেকার ভৌত প্রক্রিয়া সম্পর্কেও নতুন তথ্যের সন্ধান দিয়েছিল অ্যাস্ট্রোস্যাট। এই পর্যবেক্ষণ তাত্ত্বিকদের বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে এবং এখানেই আস্ট্রোস্যাটের সাফল্য। কারণ, যখন নতুন পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাকে ঢেলে সাজাতে হয়, তখনই গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ইউভিট দূরবীক্ষণ ব্যবহার করে আমাদের পড়শি গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রমিডা-র অতিবেগুনি বিকিরণ সুসংবদ্ধ ভাবে জরিপ করা হচ্ছে, যা থেকে ওই গ্যলাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কী হারে নতুন নক্ষত্র তৈরি হচ্ছে, তা বোঝা গিয়েছে। এসএক্সটি এবং ল্যাক্সপিসি দূরবীক্ষণের মাধ্যমে আমাদের এবং নিকটবর্তী অন্য গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে থাকা নিউট্রন নক্ষত্র বা সূর্যের কাছাকাছি ভরের কৃষ্ণগহ্বর এবং দূরবর্তী গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত সূর্যের চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি ভরের কৃষ্ণগহ্বর এবং তাদের চার পাশের উত্তপ্ত গ্যাসের প্রবাহ সম্পর্কে জানা গিয়েছে অনেক নতুন তথ্য।
অ্যাস্ট্রোস্যাট যেমন কিছু অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার করেছে, সে রকম কিছু প্রত্যাশিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ এখনও করা যায়নি। যন্ত্রের প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী, অ্যাস্ট্রোস্যাটের পরিকল্পিত জীবনকাল ছিল পাঁচ বছর। কিছু যন্ত্রাংশ আংশিক ভাবে বিকল হলেও প্রতিটি দূরবীক্ষণই এখনও কর্মক্ষম, এবং ইসরো অ্যাস্ট্রোস্যাটের ক্রিয়াকলাপ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অ্যাস্ট্রোস্যাটের গুরুত্ব শুধু কার্যসিদ্ধির দক্ষতায় সীমাবদ্ধ নয়। আগামী কয়েক বছরে কক্ষপথে নিক্ষিপ্ত হতে চলেছে ভারতের আরও কিছু মহাকাশ-দূরবীক্ষণ। সেগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং উন্নততর মহাকাশ-দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরির কাজে হাত দিতে সাহস জোগাচ্ছে অ্যাস্ট্রোস্যাট।
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy