Advertisement
E-Paper

সদ্যোজাতদের জন্ডিস রোখার পথ দেখিয়ে চমক ভারতীয়ের

শিশুদের জন্ডিসকে রোখার একটা পথ হয়তো এ বার সত্যি-সত্যিই বেরিয়ে আসতে চলেছে। বহু বহু শতাব্দীর অক্লান্ত চেষ্টার পর। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চলেছে এক অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম। গ্যাসট্রো-এনটেরোলজিস্ট আনন্দ কান্নন।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১০:৩০
ছবির ইনসেটে ভারতীয় বিজ্ঞানী আনন্দ কান্নন

ছবির ইনসেটে ভারতীয় বিজ্ঞানী আনন্দ কান্নন

শিশুদের জন্ডিসকে রোখার একটা পথ হয়তো এ বার সত্যি-সত্যিই বেরিয়ে আসতে চলেছে। বহু বহু শতাব্দীর অক্লান্ত চেষ্টার পর। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চলেছে এক অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম। গ্যাসট্রো-এনটেরোলজিস্ট আনন্দ কান্নন।

জন্মের তিন দিন পর থেকেই জন্ডিসের জটিল জটে জড়িয়ে পড়তে হয় কথা বলতে না পারা শিশুদের। সেই কষ্টের কথা তারা বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। আর কাঁদায় মা, বাবাকে। কষ্টে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে বিছানায় অয়েল ক্লথের মধ্যে শুয়ে থাকা শিশুটির গালে, চিবুকে। তার গা’টা হয়ে যায় একেবারে কাঁচা সোনার মতো হলদেটে। সেই হলুদ উঠে আসে তার ছোট্ট বেবি ফ্রকে, বালিশে। তার পাশ ঘিরে থাকা কাপড়চোপড়ে। জন্মের পর কোনও শিশুর পক্ষেই জন্ডিসের সেই হাঁসফাঁস থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। মাতৃগর্ভের আগলে রাখা বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে হয়তো জন্মের ওই তিন দিন পর থেকেই শিশু ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করে কাকে বলে জীবন যন্ত্রণা! এই রোগটির নাম- ‘সিভিয়ার নিওন্যাটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া’।

কেন প্রতিটি শিশুকেই জন্মের তিন দিন পর থেকে আক্রান্ত হতে হয় জন্ডিসে, তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না এত দিন। আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে, শিশুদের ওই জন্ডিসের জন্য তার শরীরে পিছন থেকে ‘কলকাঠি’ নাড়ে কে, কী ভাবে, বহু বহু শতাব্দীর তন্নতন্ন তল্লাশেও তা জানা যায়নি। একেবারে হালে যা খুঁজে পেয়েছে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। যার নেতৃত্বে রয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সান দিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিন’-এর ফার্মাকোলজির অধ্যাপক রবার্ট টুকে আর তাঁর সহকর্মী, ফার্মাকোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর শুজুয়ান শেন। সঙ্গে রয়েছেন অনাবাসী ভারতীয়, কেরলের সন্তান গ্যাসট্রো-এনটেরোলজিস্ট আনন্দ কান্নন। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরো‌নাম- ‘ইনটেসটাইন্যাল এনসিওআর-ওয়ান, আ রেগুলেটর অফ এপিথেলিয়াল সেল ম্যাচুরেশন, কন্ট্রোলস নিওন্যাটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া’। এর ফলে, শিশুদের জন্ডিস রোখার ওষুধ আবিষ্কারের পথটা খুলে গেল বলে মনে করছেন কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসকরা।

আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ কেন?


ভারতীয় বিজ্ঞানী আনন্দ কান্নন (বাঁ দিকে) ও ছাত্রী মাওয়া শি’কে সঙ্গে নিয়ে গ্যাস্ট্রো-এনটেরোলজিস্ট রবার্ট টুকে

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সান ডিয়েগো থেকে ই-মেলে অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানী আনন্দ কান্নন লিখেছেন, ‘‘আমরা এই প্রথম সদ্যোজাতদের শরীরে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিনের হদিশ পেয়েছি, যে পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে শিশুর রক্তে মেশা বিলিরুবিনকে জলে দ্রবীভূত হতে দেয় না। মানে, বিলিরুবিনকে জলে দ্রবীভূত করানোর জন্য শিশুর শরীরের যে জিনটি উৎসাহ দেয়, ওই প্রোটিনটি পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে সেই জিনটিকেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘুম পাড়িয়ে রাখে।’’


এই সেই এনজাইম (বাঁ দিকে), যা বিলিরুবিন ভাঙতে সাহায্য করে



এই সেই কলকাঠি নাড়া প্রোটিন

শিশুদের জন্ডিস রোখার কাজটা কেন সহজ হল বলে মনে করা হচ্ছে?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সান ডিয়েগো থেকে ই-মেলে অন্যতম প্রধান গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সান দিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিন’-এর ফার্মাকোলজির অধ্যাপক রবার্ট টুকে লিখেছেন, ‘‘এই প্রোটিনটি খুঁজে পাওয়ার ফলে আমরা এখন এমন ওযুধ আবিষ্কার করতে পারব, যা ওই সর্বনাশা প্রোটিনের কর্মনাশা হয়। ওই প্রোটিনটিকে অকেজো করে দিতে পারে। সেই প্রোটিনটি অকেজো হয়ে গেলেই সদ্যোজাতের শরীরে ঘুমিয়ে পড়া জিনটি আবার জেগে উঠবে। আর সেই জিনটি আবার তুমুল উৎসাহে কাজে নেমে পড়বে শিশুর রক্তে জমা বিলিরুবিন অণুগুলিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জলে দ্রবীভূত করার কর্মযজ্ঞে। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে আমরা সফল হয়েছি। মানুষের ওপর পরীক্ষা (হিউম্যান ট্রায়াল) চালানোর কাজটা শুরু হবে খুব তাড়াতাড়ি। তার পরেই শুরু হয়ে যাবে ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণা।’’

জন্মের তিন দিন পরেই কেন জন্ডিসের জটিল জটে জড়িয়ে পড়ে কষ্টে হাঁসফাঁস করতে থাকে শিশু?


গ্যাস্ট্রো-এনটেরোলজিস্ট দেবাশিস দত্ত (ডান দিকে) ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিতা সাহা

কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিতা সাহার কথায়, ‘‘রক্তের হিমোগ্লোবিন আসলে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে বেড়ায় দেহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। শিশু যখন মাতৃজঠরে থাকে, তখন তার রক্তের হিমোগ্লোবিন মায়ের প্লাসেন্টার রক্ত থেকে অক্সিজেন শুষে নেওয়ার কাজটা করে। সেই অক্সিজেন শুষে নিতে না পারলে শিশুর শরীরটা চলবে কী ভাবে? তার পর যখন শিশু মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে, সূর্যের আলো পড়ে তার দেহে, তখন তার রক্তের অতটা হিমোগ্লোবিন আর কাজে লাগে না। কিছু হিমোগ্লোবিন বাড়তি হয়ে যায়। বাড়তি যখন তখন তার আর হিমোগ্লোবিন হয়ে থাকাটারই বা দরকার কীসের! সুর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি চামড়া ফুঁড়ে কিছুটা ঢুকে পড়ে সদ্যোজাতের রক্তের বাড়তি হিমোগ্লোবিনকে ভাঙতে শুরু করে দুদ্দাড়িয়ে। সেই বাড়তি হিমোগ্লোবিন অণু তখন ভেঙেচুরে গিয়ে জন্ম দেয় বিলিরুবিন অণুর। আমরা জানি, রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রাটা বাড়লেই আমাদের গা ভরে যায় হলুদ রঙে। আমরা জানি, এটাই জন্ডিস। প্রকৃতি জানে, এমনটাই হবে। তাই মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা শিশুর ‘হাতে’ তার অজান্তেই একটা ‘অস্ত্র’ ধরিয়ে দেয় প্রকৃতি। প্রতিটি সদ্যোজাতের শরীরে থাকে বিশেষ একটি এনজাইম (আদতে যা প্রোটিন)। যার নাম- ‘ইউডিপি-গ্লুকিউরোনোসিলট্রান্সফেরেস-ওয়ান-এ-ওয়ান’ (ইউজিটি-ওয়ান-এ-ওয়ান)। এই এনজাইমটাই সদ্যোজাতের শরীরে রক্তের বাড়তি হিমোগ্লোবিন ভেঙে তৈরি হওয়া বিলিরুবিন অণুগুলি যাতে জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়, তার ব্যবস্থাটা করে। জলে গুলে গেলেই বিলিরুবিনের ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। কারণ, তখন সেটা প্রস্রাবের মাধ্যমে সদ্যোজাতের শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এই এনজাইমের কাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করে শিশুর শরীরের বিশেষ একটি জিন। নতুন যে প্রোটিনটির হদিশ পেয়েছেন আবিষ্কারকরা, দেখা গিয়েছে, সেই প্রোটিনটি ওই জিনটিকেই অনেকটা ক্ষমতাহীন করে দেয়। ফলে, সদ্যোজাতের শরীরের রক্তের বাড়তি হিমোগ্লোবিন ভেঙে তৈরি হওয়া বিলিরুবিন অণুগুলি আর জলে দ্রবীভূত হতে পারে না। আর তাই শিশুদের জন্মের তিন দিন পর থেকেই জন্ডিসে ভুগতে হয়। যে জন্ডিসটা থাকে তিন দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। আর প্রি-ম্যাচিওরড শিশুর ক্ষেত্রে সেই জন্ডিসটা থাকে কম করে ১৪ দিন। এর ফলে ওই শিশুদের মস্তিষ্কে গিয়ে জমা হতে থাকে ওই বিলরুবিন। যা পরে তাদের মস্তিষ্কে নানা রকমের জটিল রোগের জন্ম দেয়। তাদের বিকারগ্রস্ত করে তোলে। আবার এমন একটি রোগ রয়েছে, যাতে শিশুদের শরীরে ওই এনজাইমটিই থাকে না। রোগটির নাম- ‘ক্রিগলার-নাজার সিনড্রোম’।’’

কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিশিষ্ট গ্যাস্ট্রো-এনটেরোলজিস্ট দেবাশিস দত্ত বলছেন, ‘‘এটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। যেহেতু সদ্যোজাতের শরীরে জমা বিলিরুবিন অণুগুলি জলে দ্রবীভূত হতে না পারলে তা রক্তের মাধ্যমে শিশুর মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছয়। আর শিশুদের মস্তিষ্কে সেই বিলিরুবিন অণুগুলি প্রচুর পরিমাণে জমে গেলে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের নানা রকমের স্নায়বিক রোগের শিকার করে তোলে। শিশুরা নানা ধরনের নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের শিকার হয়। যা পরে তাদের শারীরিক বা মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী করেও তুলতে পারে।’’

সদ্যোজাতদের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রাটা কতটা হলে অত্যন্ত বিপজ্জনক মনে করা হয়?

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিতা বলছেন, ‘‘মাতৃজঠর থেকে বেরনোর তিন থেকে সাত দিনের মাথায় শিশুদের রক্তে হিমোগ্লোবিন ভেঙে তৈরি হওয়া বিলিরুবিনের মাত্রাটা সাধারণত ১৭ থেকে ২১/২২-এর মধ্যে থাকে। বড়দের জন্ডিস হলে যেটা বেড়ে ১২/১৩ পর্যন্ত হয়ে যায়। সাধারণত, জন্মের সাত থেকে ১৪ দিন পর সেই জলে অদ্রাব্য বিলিরুবিনের মাত্রাটা সুস্থ শিশুদের ক্ষেত্রে নেমে আসে ২-এ। কিন্তু জন্মের পর শিশুদের রক্তে সেই বিলিরুবিনের মাত্রাটা যদি বেড়ে ২২/২৩ হয়ে যায়, তা হলে তা রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স’ (এএপি)-এর বেঁধে দেওয়া ‘গাইডলাইন’ অনুযায়ী সদ্যোজাতদের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রাটা ১৬/১৭ হয়ে গেলেই সেটা চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। তখন আমরা শিশুটিকে একটি বিশেষ ধরনের অতিবেগুনি রশ্মির ট্রিটমেন্ট দিই। এটাকে বলে ‘স্পেশ্যাল ইউভি (আল্ট্রা-ভায়োলেট) লাইট অ্যারেঞ্জমেন্ট’। ওই অতিবেগুনি রশ্মি পড়লেই শিশুটির রক্তে জমা বাড়তি বিলিরুবিন জলে দ্রবীভূত হতে শুরু করে। আর তার ফলেই বিপদের হাত থেকে বাঁচে সদ্যোজাতটি।’’

আরও পড়ুন- কৃত্রিম কিডনি বানিয়ে চমক বাঙালির, বাজারে আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি

নতুন আবিষ্কারের বাড়তি তাৎপর্য কোথায়?

গ্যাস্ট্রো-এনটেরোলজিস্ট দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘আবিষ্কারকরা বলছেন, ইঞ্জেকশন দিতে হবে না। ওরাল মেডিসিনের মাধ্যমেই সদ্যোজাতের শরীরের সেই কলকাঠি নাড়া প্রোটিনকে জব্দ করা যাবে। যাতে সে বিলিরুবিনকে জলে দ্রবীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধাটা দিতে না পারে। ইঞ্জেকশন না দিয়ে ওরাল মেডিসিনের মাধ্যমেই ওই জটিলতা দূর করতে পারা গেলে শিশুরা অনেকটাই রেহাই পাবে যন্ত্রণা, দুর্ভোগের হাত থেকে।’’

ছবি সৌজন্যে: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগো

Jaundice Newborn Baby's Jaundice UGT1A1 Gene
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy