সেই বিদ্যুৎ! উসেইন বোল্ট।-ফাইল চিত্র।
সব রকমের মাটির তাল দিয়েই প্রতিমা গড়া যায় না। ঝুরো মাটি হলে চলবে না। প্রতিমা গড়ার জন্য লাগে বিশেষ এক ধরনের এঁটেল মাটি। তেমনই একেবারে শৈশবে কারও মধ্যে ক্রীড়া প্রতিভা (স্পোর্টস ট্যালেন্ট) খুঁজে পেলেই তাকে দিয়ে সুইমার (সাঁতারু), স্প্রিন্টার, ম্যারাথনার সব কিছুই বানিয়ে ফেলা যাবে, তা নয়। বুঝে নিতে হবে কাকে দিয়ে কোনটা হয়। বুঝে নিতে হবে দক্ষ সাঁতারু, স্প্রিন্টার বা ম্যারাথনার হয়ে ওঠার জন্য কী কী শারীরিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন। জেনে নিতে হবে, শৈশবে খুঁজে পাওয়া সেই ক্রীড়া প্রতিভাদের মধ্যে সেই সব শারীরিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে কি না। তাদের জিনের বৈশিষ্ট্য কী কী। জিন কাঠামো তাঁদের ক্রীড়াক্ষেত্রের কোন দিকে স্বাভাবিক ভাবে উৎসাহিত করতে পারে। জেনে নিতে হবে, কোন খেলায় কত ক্যালোরি খরচ করার প্রয়োজন। খেলোয়াড়ের শরীর সেই পরিমাণ ক্যালোরি পায় কি না। ঘাটতি থাকলে কার ক্ষেত্রেে কতটা আর তা কী ভাবে মেটাতে হবে? শৈশব থেকে সেই মতোই তাঁদের গড়ে তোলা হলে, ঠিক ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে, তবেই তাঁদের কাছ থেকে কাঙ্খিত মানের পারফরম্যান্স আশা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ওই ক্রীড়া শিক্ষার্থীদের প্রতিভাকে ঘষে-মেজে আরও ঝকঝকে করে তোলা সম্ভব। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
যেমন, টেনিস তারকা বরিস বেকার। ছোটবেলা থেকেই তাঁর খুব শখ ছিল বড় হয়ে তিনি হবেন ফুটবলার। কিন্তু সেই ছোটবেলাতেই ডাক্তাররা তাঁকে দেখে বলে গিয়েছিলেন, বেকারের যা শারীরিক গঠন, তাতে তিনি বড় হয়ে খুব বড় লং টেনিস প্লেয়ার হতে পারেন। বেকারের বরং ছোটবেলা থেকেই লং টেনিস প্র্যাকটিস করা উচিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রীতিমতো ঘাম ঝরানো প্রয়োজন তাঁর টেনিস কোর্টেই। বরিস বেকারের টেনিস খেলাটা শুরু হয় তার পরেই।
বরিস বেকার
তার মানে, বেকারের ক্ষেত্রে আদর্শ জহুরির কাজটা করেছিলেন বিচক্ষণ ডাক্তাররাই। কোন পথে গেলে কোনও ক্রীড়া প্রতিভার পারফরম্যান্সের ১০০ ভাগ পাওয়া যাবে, সেই পথটা ঠিক করে দেওয়া আর সেই পরামর্শটা মেনে নেওয়ার প্রয়োজনটাই সবার আগে।
বিখ্যাত সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ
ক্রীড়া বিজ্ঞান নিয়ে প্রায় আজীবন গবেষণায় মগ্ন বিশিষ্ট ক্রীড়া চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সফল ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জিনের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ, সংশয় থাকতে পারে না। তবে মজার ঘটনা হল, সেটাই শেষ কথা নয়। জিন ‘ঈশ্বর’ নয় যে তাকে পরিবেশ, জীবনযাপনের পদ্ধতি, প্রকরণ কিছুটা হলেও, বদলাতে পারবে না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শরীরে কয়েকটি নির্দিষ্ট হরমোনের ক্ষরণের পরিমাণ বাড়িয়ে, কমিয়েও ক্রীড়া প্রতিভাদের শক্তির তারতম্য ঘটানো যায়। আবার সব অসম্ভবই যে সম্ভব করে তোলা যায়, এমনটাও নয়। তা হলে তো সবাই জেসি ওয়েন্স, কার্ল লুইস, উসেইন বোল্ট বা মার্ক স্পিৎজ অথবা সের্গেই বুবকা হয়ে যেতেন!’’
সের্গেই বুবকা
জন্মেই তো আর বুবকা, পেলে, বোল্ট বা স্পিৎজ হওয়া যায় না। বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিনে’র (ইনস্টেম) জেনেটিক্সের অধ্যাপক মহেন্দ্র রাও বলছেন, ‘‘১৮৯৬ সালেই অলিম্পিক্সে প্রথম ম্যারাথনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর সেই বছর যিনি ম্যারাথনে প্রথম সোনা জিতেছিলেন সেই গ্রিক ম্যারাথনার স্পিরিডন লুইস আদতে ছিলেন এক জন ভারী। গ্রিসে তখন খুব জলের অভাব। খাবার জল আনতে হত মানুষকে অনেক দূর থেকে। পেটের দায়ে অনেকের মতোই তখন স্পিরিডন লুইসও ভারী হয়ে গিয়েছিলেন।
প্রায় ৩০/৪০ মাইল দূর থেকে বড় বড় বালতিতে জল নিয়ে এসে লুইস বাড়ি বাড়ি জল দিতেন। ম্যারাথনার হিসেবে জন্মাননি লুইস! ম্যারাথনার হওয়ার মতো জিন বা পেশিতন্তু তাঁর হয়তো-বা ছিল, কিন্তু মূলত ওই অত দূর থেকে মাইলের পর মাইল আসা, যাওয়া করে জল আনার অভ্যাসই তাঁকে পরে বড় ম্যারাথনার হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। এটাই প্রমাণ করে পরিবেশ কী ভাবে আমাদের তৈরি করে। আমাদের বদলে দেয় একটু একটু করে। জিনের কাঠামোতেও পরিবর্তন আনে বিবর্তনের নিয়মেই।’’
অতীতের অ্যালবাম: অলিম্পিক্স ম্যারাথনে লুইসের সোনাজয়ের সেই ইতিহাস
আবার চাইলেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যায়ও না। চাইলেই পারব কি আমরা এক জন দক্ষ স্প্রিন্টারকে (১০০ থেকে ৪০০ মিটার দৌড়) দূর পাল্লার (৮০০, ১৫০০, ৫০০০ বা ১০ হাজার মিটার দৌড়) দৌড়বীর বা ম্যারাথনার করে তুলতে? উল্টোটাও কি সম্ভব?
‘‘প্রায় অসম্ভবই’’, বলছেন আজীবন ক্রীড়া বিজ্ঞানের গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘কম পাল্লা আর দূর পাল্লার দৌড়বীরের মধ্যে জিন ও পেশিতন্তুর নিরিখে বেশ কিছু ফারাক থাকে। কম পাল্লার দৌড়বীরের থাকে সাদা পেশিতন্তু আর অল্প মাইটোকনড্রিয়া। মাইটোকনড্রিয়া হল শরীরের রান্নাঘর। সেখানে রান্নাবান্না হলে যে খাবারদাবার (পড়ুন, শক্তি উৎপন্ন) তৈরি হয়, দূর পাল্লার দৌড়বীরকে তার সুদীর্ঘ পথে তা শক্তি জোগায়। কিন্তু রান্নাঘরে রান্নাবান্না করতে তো সময় লাগে। বাজার করতে হয়, কুটনো কুটতে হয়, তার পর হাঁড়ির জল ফোটে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কম পাল্লার দৌড়বীরের অত সময় লাগলে চলে? তাই তাঁর ওই শরীরের ‘রান্নাঘর’ মাইটোকনড্রিয়ার ওপর ভরসা করলে চলে না। শরীরে অল্প মাইটোকনড্রিয়া থাকলেই তার কাজ হাসিল হয়ে যায়। সাড়ে নয় সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়তে অত রান্নাবান্না করার দরকারটাই বা কীসের? কিন্তু ম্যারাথনার বা দূর পাল্লার দৌড়বীরের ওই ‘রান্নাঘর’টা (মাইটোকনড্রিয়া) বেশি সংখ্যায় না থাকলে, তাঁকে অতটা লম্বা পথ দৌড়তে শক্তি জোগাবে কে? ম্যারাথনারের লাগে প্রচুর রেসপিরেটরি উৎসেচক অনেক সময় ধরে তাঁর শরীরকে ছোটানোর জ্বালানিটা দেয় ওই উৎসেচকই। কিন্তু সেই উৎসেচকের যথেষ্টই অভাব রয়েছে স্প্রিন্টারের শরীরে। ফলে ভাল স্প্রিন্টারকে, চাইলেও ম্যারাথনার বানানো যায় না, সহজে। তা কার্যত, অসম্ভবই।’’
কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়া যায় অবশ্যই। না হলে আজকের দীপা কর্মকারকে পাওয়া যেত না। এমনটাই বলছেন ‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-ইস্ট জোন (সাই)’-এর জিমন্যাস্টিক্সের কোচ মিনারা বেগম বলছেন, ‘‘খুব ছোটবেলায় দীপার পা দু’টো ছিল ‘ফ্ল্যাট ফুট’। যেটা হলে গতি পাওয়া যায় না। জিমন্যাস্টিক্সের জন্য যা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে আজ সেই দীপার সেই সমস্যা শুধুই যে অনেকটা কমে এসেছে, তাই নয়, দীপা আজ আন্তর্জাতিক মানের জিমন্যাস্ট হয়ে উঠতে পেরেছেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ, খুব ছোটবেলা থেকেই (৩/৪ বছর) দীপা তাঁর ওই জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য কঠোর অনুশীলন শুরু করেছিলেন। সেটাও সম্ভব হওয়ার কিছুটা কারণ, দীপার বাবা ছিলেন ‘সাই’-এর কর্মকর্তা। ব্যায়াম, অনুশীলনের মাধ্যমে ওই শারীরিক সমস্যা কমানো যায়, এই ধারণা অনেকের থাকলেও তা যে খুব ছোটবেলা থেকে (৩/৪ বছর) শুরু করলেই ঠিকমতো কাজে দেয়, সম্ভবত ‘সাই’য়ের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে দীপাদের পরিবারে সেই সচেতনতার অভাব ছিল না। তাই সে দিনের সেই দীপা আজকের দীপা হতে পেরেছেন।’’
অনুশীলনে বদলানো যায় না? এই কি সেই ‘ফ্ল্যাট ফুটেড’ দীপা কর্মকার?
কিন্তু তার পরেও অনেক বাধা রয়েছে, যা পেরতে পারা যাচ্ছে না বলেই অলিম্পিক্স, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়াডের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চগুলিতে ভারতের প্রাপ্তির ঝুলি ভরছে না। স্বাধীনতার ৭০ বছরে পা দেওয়ার পরেও! সেই বাধাগুলি কোথায়, আর সেই সব হার্ডলগুলি কী ভাবে টপকানো যায়, তার বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়গুলি নিয়ে শুক্রবার আলোচনা করা যাবে।
ঋণ স্বীকার: ক্রীড়া চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা
জিন বিশেষজ্ঞ মহেন্দ্র রাও, ‘ইনস্টেম’ বেঙ্গালুরু
জিন বিশেষজ্ঞ অলোক শ্রীবাস্তব, খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজ, ভেলোর
আরও পড়ুন- জিন, হরমোন, পরিবেশ পিছিয়ে রাখছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy