Advertisement
E-Paper

কোষের কারসাজিতে দুই বাঙালির বাজিমাত

জীবকোষের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান। তারই হাতে জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। ‘মাইক্রো আরএনএ’ নামে এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঠিকুজি-কোষ্ঠী অবশ্য বিজ্ঞানীরাও এখনও জেনে উঠতে পারেননি। তবে দেশ-বিদেশে চেষ্টা চলছে। এ শহরের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও সেই রহস্য ভেদের শরিক।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৩
সায়ন ভট্টাচার্য ও শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

সায়ন ভট্টাচার্য ও শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

জীবকোষের মধ্যে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান। তারই হাতে জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। ‘মাইক্রো আরএনএ’ নামে এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঠিকুজি-কোষ্ঠী অবশ্য বিজ্ঞানীরাও এখনও জেনে উঠতে পারেননি। তবে দেশ-বিদেশে চেষ্টা চলছে। এ শহরের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও সেই রহস্য ভেদের শরিক।

সৌরকোষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যৱহৃত হয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তড়িৎদ্বার 'ক্যাথোড'। ধাতু কিংবা রাসায়নিকের বদলে তা তৈরী হতে পারে মানুষের চুল থেকেই! এমনই এক উদাহরণ জনসমক্ষে তুলে এনেছে এ রাজ্যের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এবং এই দু’টি আলাদা ধরনের কাজের নেতৃত্বে রয়েছেন দুই বঙ্গসন্তান।

জীব কোষের রহস্য ভেদের চেষ্টা করে চলেছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি’ (আইআইসিবি)-র বিজ্ঞানী শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সেই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৭ বছর পর জীববিদ্যায় শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার উঠেছে কোনও বাঙালি বিজ্ঞানীর হাতে। এর আগে পেয়েছিলেন বোস ইনস্টিটিউটের বর্তমান অধিকর্তা সিদ্ধার্থ রায়।

চুল থেকে ক্যাথোড তৈরি করায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (কলকাতা)-র রসায়ন বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সায়ন ভট্টাচার্য। এই আবিষ্কার সম্প্রতি ‘কার্বন’ নামে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রাক্তনী শুভেন্দ্রনাথবাবু দেশের মাটিতে বসে গবেষণা করার জন্য সুইৎজারল্যান্ড থেকে ফিরে আইআইসিবি-তে যোগদান করেন। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করেন মাইক্রো আরএনএ-র চরিত্র অনুসন্ধান। সে সময় আইআইসিবি-র অধিকর্তা ছিলেন ভাটনগর পুরস্কারের ক্ষেত্রে শুভেন্দ্রনাথের পূর্বসূরি সিদ্ধার্থবাবু-ই।

শুভেন্দ্রনাথবাবু বলছেন, ডায়াবেটিস থেকে ক্যানসার, মানব শরীরের নানা ধরনের রোগের পিছনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জিনই দায়ী। এবং সেই জিনের কাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে জুড়ে রয়েছে এক বা একাধিক মাইক্রো আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)। এই ক্ষুদ্র আরএনএ তার নিজস্ব আদানপ্রদান পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরের কোষ থেকে কোষে সঙ্কেত বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার গতিপ্রকৃতি বিজ্ঞানীদের সম্পূর্ণ অজানা। সেই অজানাকে জানতে পারলেই অবশ্য দিশা মিলতে পারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দিকের। এই বাঙালি বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘মাইক্রো আরএনএ-র ঠিকুজি এবং চরিত্র বোঝা গেলে ডায়াবেটিস, ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসার নতুন দিক খুলে যেতে পারে।’’ একই সুর আইআইসিবি-র অধিকর্তা শমিত চট্টোপাধ্যায়ের গলাতেও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘শুভেন্দ্রনাথ মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের রোগমুক্তির চাবিকাঠি খুঁজছেন। তাঁকে সব রকম সাহায্যের জন্য আমরা তৈরি।’’

চুল থেকে ক্যাথোড তৈরির ভিত স্থাপন হয়েছিল ২০১১-১২ সালে। সে সময় বিভিন্ন বর্জ্যপদার্থকে পুনর্ব্যবহার করে তোলা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন সায়নবাবুরা। সেই গবেষণায় ইতিমধ্যেই ব্যৱহৃত রান্নার তেল কিংবা ঘাস থেকে তৈরি করা কার্বনের ‘ন্যানো-পার্টিকল’ (অতি ক্ষুদ্র কণা)-কে ক্যানসার চিকিৎসার কাজে লাগানোতে সফল হয়েছেন তাঁরা। তার পরে সায়নবাবুদের নজর পড়ে মানুষের ফেলে দেওয়া চুলের উপরে।

বর্তমানে সৌরকোষে সাধারণত প্ল্যাটিনামের মতো দামী ধাতু বা কপার সালফাইডের মতো পরিবেশদূষক রাসায়নিক দ্বারা নির্মিত ক্যাথোড ব্যৱহার করা হয়। কিন্তু ফেলে দেওয়া চুল থেকে ক্যাথোড তৈরী করা গেলে তা অপেক্ষাকৃত অনেক সস্তা ও পরিবেশবান্ধব হবে, এমনটাই ভেবেছিলেন সায়নবাবুরা। সেই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছে এই নয়া ক্যাথোড। তবে কৃতিত্ব অবশ্য একা নিতে নারাজ কলকাতা ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটি-কানপুরের প্রাক্তনী সায়নবাবু। এই গবেষণায় জুড়ে ছিলেন তাঁর দুই গবেষক-ছাত্র অথর্ব সহস্রবুদ্ধে এবং সুতনু কাপড়ীও।

চুলকে ঠিক কী ভাবে ক্যাথোডে পরিণত করছেন বিজ্ঞানীরা?

সায়নবাবু জানান, ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ ও পরিষ্কার করার পর তাকে সালফিউরিক অ্যাসিডে ১৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২৫ মিনিট ধরে উত্তপ্ত করা হয়। এর পরে তাকে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের (যেমন হিলিয়াম, আর্গন, ক্রিপটন) উপস্থিতিতে একটানা ৬ ঘন্টা উত্তাপ দিয়ে সচ্ছিদ্র কার্বন মৌলে রূপান্তরিত করা হয়। এই কার্বন একই সাথে তড়িতের সুপরিবাহীও বটে। এই দুই ধর্মের উপস্থিতির জন্যেই এই মৌল কার্বন সৌরকোষে ইলেকট্রন পরিবহণ ও স্থানান্তরণে সহায়তা করে।

সৌরকোষ পরিবেশবান্ধব সৌরশক্তির উৎস। সায়নবাবুদের তৈরি এই ক্যাথোডও পরিবেশবান্ধব। এই পদ্ধতিতে সেলুনে জড়ো হওয়া বর্জ্য চুলের পুনর্ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। সায়নবাবু মনে করেন, সহজলভ্য চুলকে বিকল্প শক্তির উৎপাদনে আগামী দিনে শিল্পক্ষেত্রেও ব্যবহার করা সম্ভব। এর ফলে সৌরকোষ তৈরির খরচও অনেক কমানো সম্ভব। সায়নবাবু বলছেন, ‘‘চুল থেকে তৈরি করা ক্যাথোড গুণমানে ধাতব ক্যাথোডের থেকে কম তো নয়ই, বরং সহজলভ্য, সস্তা ও পরিবেশবান্ধবও বটে।’’

Micro-RNA Cancer Scientists
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy