Advertisement
E-Paper

মহাকাশ থেকে ঝুপ করে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ল ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া!

ঠিক ২৭ দিন আগেকার কথা। সেটা ছিল মে মাসের ১১ তারিখ। তারা হু হু করে ধেয়ে এল মহাকাশ থেকে! একেবারে উল্কার বেগে! তার পর ঝুপ ঝাপ নেমে পড়ল অতলান্ত প্রশান্ত মহাসাগরে। উত্তাল হয়ে উঠল প্রশান্ত মহাসাগরের ওই অংশটি। ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াদের দাপাদাপিতে!

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৬ ১১:১৬

ঠিক ২৭ দিন আগেকার কথা।

সেটা ছিল মে মাসের ১১ তারিখ।

তারা হু হু করে ধেয়ে এল মহাকাশ থেকে! একেবারে উল্কার বেগে!

তার পর ঝুপ ঝাপ নেমে পড়ল অতলান্ত প্রশান্ত মহাসাগরে। উত্তাল হয়ে উঠল প্রশান্ত মহাসাগরের ওই অংশটি। ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াদের দাপাদাপিতে!

মহাকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসল ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়ারা। যেন রাক্ষসের বংশ! লক্ষ লক্ষ। কোটি কোটি। যারা গত দশ মাস ধরে কাটিয়েছে মহাকাশে। শূন্যের ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচের তাপমাত্রায়। যাকে হাড়কাঁপানো বললে ভুল বলা হয়। হাড়-জমানো বা হাড়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া কল্পনাতীত ঠাণ্ডায়।

মহাকাশে এত দিন ওই ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াদের ঘর-বাড়ি ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)। সেখানেই তারা ‘খাচ্ছিল-দাচ্ছিল-খেলে বেড়াচ্ছিল-ঘুমোচ্ছিল’! চেহারায় বাড়ছিল। এমনকী, খামতি ছিল না তাদের বংশ-বিস্তারেও!

মহাকাশ ‘ঘুরে-ট্যুরে’ তাদের কী অভিজ্ঞতা হল, যেখানে মহাকর্ষ বল কার্যত, শূন্যই, সেই ‘মাইক্রো-গ্র্যাভিটি’তে কেমন কাটাল তারা মহাকাশে, তাদের তবিয়ৎ কতটা ঠিকঠাক ছিল ‘মহাকাশ পর্যটনে’, মহাকাশচারীদের মতোই তারা পৃথিবীতে এসে, প্রাথমিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে কি না, তাদের শারীরিক গঠন-কাঠামোর কোনও অদলবদল হয় কি না, তা দেখার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরিতে (জেপিএল) সে দিন অধীর প্রতীক্ষায় কে বসেছিলেন, জানেন?

দেখুন ভিডিও: মহাকাশে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া।

এক ভারতীয়। দক্ষিণ ভারতের মানুষ। কস্তুরী ভেঙ্কটেশ্বরন। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচ্য মাইক্রো-বায়োলজিস্ট। সদ্য ফিরে আসা ‘মহাকাশচারী’ ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াদের ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ করাটাই এখন যাঁর এক ও একমাত্র কাজ। পৃথিবীর অন্য সব মাইক্রো-বায়োলজিস্টকে দৃশ্যতই দৌড়ে হারিয়ে দিয়ে, ফিরে আসা ‘মহাকাশচারী’ ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়াদের ওপর ‘মাস্টারি’ করার দায়িত্বটা এখন বর্তেছে তাঁর কাঁধেই। পরীক্ষাটা হচ্ছে এই প্রথম। মহাকাশে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো‌র আগে ছ্ত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে পৃথিবীর গবেষণাগারে দীর্ঘ দিন ধরে রাখা হয়েছিল কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা একটি তাপমাত্রা ও পরিবেশে। তার পর তাদের একেবারে বন্দি করে ফেলা হয়েছিল ক্যাপস্যুলের পর ক্যাপস্যুলে। আর ক্যাপস্যুল-বন্দি ওই ছত্রাক আর ব্যাকটেরিয়াদের গত বছরেই একেবারে রকেটে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। সেখানে তাদের রাখাও হয়েছিল খুব ‘আতুআতু-পুতুপুতু’ করে, সাদরে, সযত্নে। গত এক বছরে যে যে মহাকাশচারী গিয়েছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে, তাঁদের প্রত্যেককেই যাওয়ার আগে পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছিল, ‘গিয়ে ওদেরও (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া) দেখে এস। ট্রে আর ক্যাপস্যুলগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, দেখে এস।’’ সেই ‘অভিভাবকত্বে’ খামতি দেখাননি কোনও মহাকাশচারীই। গত ১১ মনে তাদের ফিরিয়ে আনা হল পৃথিবীতে।


জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরিতে ভারতীয় কস্তুরী ভেঙ্কটেশ্বরন।পাসাডেনায়।

অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দরাবাদের সন্তান কস্তুরী ভেঙ্কটেশ্বরন সমুদ্রের গভীর থেকে পৌঁছে গিয়েছেন মহাকাশের গভীর শূন্যতায়, ‘মাইক্রো-গ্র্যাভিটি’তে।

পাসডেনা থেকে ই-মেলে ভেঙ্কট (ভেঙ্কটেশ্বরন) আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘সত্তরের দশকে হায়দরাবাদে গ্র্যাজুয়েশন করার সময়েও মাইক্রো-বায়োলজিতে মোটেই আগ্রহ ছিল না আমার। আমার প্রথম পিএইচডি-টা আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই সময় থেকেই একটু একটু করে ঝুঁকে পড়তে শুরু করি অণুজীবদের (মাইক্রোব্‌স) দিকে। সামুদ্রিক প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জরুরি পুষ্টিকর খাদ্য সমুদ্রের তলায় তৈরি করার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেয় অণুজীব, সেটাই ছিল আমার গবেষণার বিষয়। এর পর ঝুঁকে পড়ি ফুড মাইক্রোবায়োলজিতে। আমার দ্বিতীয় পিএইচডি-টি ওই ফুড মাইক্রোবায়োলজিতেই। জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৯০-এ। আমিই প্রথম দেখিয়েছিলাম, নানা রকমের খাদ্যাখাদ্য থেকে আমাদের যে হরেক অসুখ হয়, তার জন্য মূলত দায়ী ‘ই-কোলি’ ব্যাকটেরিয়া। গত ৩৯ বছর ধরে আমি একটা নেশাতেই বুঁদ হয়ে রয়েছি। তা হল- নতুন নতুন অণুজীব খুঁজে বের করা। যাদের কাউকেই আমরা জানতে পারিনি, চিনতে পারিনি।’’


আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ‘মহাকাশচারী’ ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ারা।

এখন প্রায় গোটা বিশ্বই জানে, ভেঙ্কট গত আড়াই দশকে ২৫টি নতুন অণুজীব আবিষ্কার ও তাদের নামকরণ করেছেন। তার মধ্যে ১৫টি অণুজীব আবিষ্কার করেছেন নাসায় যোগ দেওয়ার পর।

কিন্তু তার পর আবার নতুন মোড় নেয় ভেঙ্কটেশ্বরনের গবেষণা। অণুজীব থেকে চলে যান সমুদ্রে ভাসা তেলে!

১৯৮৯-এ আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে পণ্যবাহী জাহাজ থেকে সমুদ্রে তেল ভেসে গিয়ে একটি বড় বিপত্তি ঘটেছিল। মরে যাচ্ছিল প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ। সেই ঘটনার নাম- ‘এক্সন ভাল্দেজ্‌ অয়েল স্পিল’। কী ভাবে সমুদ্রে ভাসমান ওই বিপুল পরিমাণ তেলের ‘আগ্রাসন’ থেকে মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীকে বাঁচানো যায়, তার উপায় খুঁজে বের করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেয় একটি জাপানি সংস্থা। কস্তুরীই তখন নতুন একটি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন, যারা সামুদ্রিক মাছকে তো রক্ষা করেই, ভাসমান তেলটুকুও নিজেরাই ‘খেয়ে নেয়’। আক্ষরিক অর্থে, ওই ব্যাকটেরিয়ারা সমুদ্রে ভাসমান তেলের সবটুকুই শুষে নিতে‌ পেরেছিল।

ভেঙ্কটেশ্বরন ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘আমার জীবনের বড়সড় ‘ব্রেক’টা এসেছিল অবশ্য ১৯৯৬ সালে। ওই বছরেই আমি উইস্‌কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চার হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আর তার দু’বছরের মধ্যেই, ১৯৯৮ সালে, আমি পেয়ে গিয়েছিলাম আরও বড় ‘ব্রেক’! উইস্‌কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যিনি ‘অ্যাডভাইজর’ ছিলেন, তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন নাসায়। আর আমার মতো ওঁর জনা চার-পাঁচেক ছাত্রকেও সেখানে নিয়ে গেলেন। ব্যস, সেই শুরু! আমি সমুদ্রের গভীর থেকে চলে গেলাম মহাকাশের অতল শূন্যতায়। পৃথিবীর কোন কোন অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে মহাকাশেও, তা নিয়ে শুরু হয়ে গেল আমার গবেষণা।’’

মহাকাশে যদি মিলেই যায় ‘প্রাণ’- অদূর ভবিষ্যতে, যদি এটা প্রমাণিত হয়ে যায় আজ বা কাল, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে যে পরিবেশে বাঁচতে পারে অণুজীব, তা টিঁকে থাকতে পারে মহাকাশের শূন্য মহাকর্ষেও, তা হলে সেটাই হবে ভেঙ্কটের সবচেয়ে বড় ‘ভিকট্রি’!

চার-চারটে ‘ভি’! ভিনি-ভিডি-ভিসি! আর ভেঙ্কট!

আরও পডুন

রাস্তা, স্তম্ভ, সমুদ্রের তলায় প্রাচীন নগরী বানিয়েছে ব্যাকটেরিয়া!

Microbes in Space: Indian Researcher Explores Tiny Life
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy