Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Science News

উল্কা আছড়ে পড়তেই জলের ফোয়ারা চাঁদের পিঠে! দেখল নাসার যান

এই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-জিওসায়েন্স’-এ।

উল্কাপাতে চাঁদ থেকে ছিটকে বেরোল জলের কণা। ছবি সৌজন্যে: নাসা

উল্কাপাতে চাঁদ থেকে ছিটকে বেরোল জলের কণা। ছবি সৌজন্যে: নাসা

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:০২
Share: Save:

আচমকা উল্কা এসে আছড়ে পড়ল চাঁদে। আর তাতেই তোলপাড় হয়ে গেল চাঁদের মাটি। বুক চিড়ে বেরিয়ে এল জলের কণা। ফোয়ারার মতো! মিশে গেল চাঁদের বাতাসে। তার পর কোথায় যেন সেই জলকণা বাষ্প হয়ে উধাও হয়ে গেল! হারিয়ে গেল মহাকাশের অতল অন্ধকারে।

এই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-জিওসায়েন্স’-এ। যে গবেষকদলের প্রধান মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেহেদি বেন্না। রয়েছেন অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানী, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র এস কুমারমঙ্গলমও।

খুব দুঃখ, বড় আঘাত পেলে আমাদের চোখ দিয়ে যেমন জল গড়িয়ে পড়ে, আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই গাল, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়া সেই জল যেমন শুকিয়ে যায়, অনেকটা যেন তেমনই একটা ঘটনা!

নাসার উপগ্রহ দেখল সেই অবাক করা ঘটনা

চমকে দেওয়ার মতো এই ঘটনার সাক্ষী থাকল নাসার পাঠানো উপগ্রহ ‘ল্যাডি’। যার পুরো নাম- ‘লুনার অ্যাটমস্ফিয়ার অ্যান্ড ডাস্ট এনভায়রনমেন্ট এক্সপ্লোরার’। তা হলে কি আগামী দিনে চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ বানাতে বা ভিন গ্রহের ভিন মুলুকে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহে ট্রান্সপোর্টেশন হাব গড়ে তুলতে চিন্তাটা কমবে আমাদের? এই আবিষ্কার অনিবার্য ভাবেই সেই প্রশ্নটার জন্ম দিল।

উল্কার আচমকা আঘাতে যে চাঁদের অন্দর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে, জলের কণা, তাত্ত্বিক ভাবে সে কথা বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল না। কিন্তু চোখে না দেখতে পারলে বিজ্ঞান যে কিছুই বিশ্বাস করে না। ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’। এই প্রথম সেই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা দেখতে পাওয়া গেল।

কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হতে পারল মানবসভ্যতা। নাসার ল্যাডির দৌলতে।

সুইডেন থেকে নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এটা সত্যিই একটি মাইলস্টোন আবিষ্কার। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, চাঁদের মাটির নীচে এখনও জল থাকতে পারে। সে জন্যই সম্প্রতি চাঁদ নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে নাসার। চাঁদ নিয়ে গবেষণার জন্য আমাদের (নাসা) প্ল্যানেটারি ডিভিশন একটি নতুন কর্মসূচি নিয়েছে। তার নাম- ‘ডালি’। ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লুনার ইনস্ট্রুমেন্টেশন’। এই আবিষ্কার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল।’’

এই আবিষ্কার সম্ভব হল কী ভাবে?

আনন্দবাজার ডিজিটালের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে অন্যতম গবেষক এস কুমারমঙ্গলম জানিয়েছেন, চাঁদের বায়ুমণ্ডলটা কেমন, তা কতটা পাতলা বা পুরু বা তা এতটাই পাতলা যে, নেই বললেই চলে কি না, তা বুঝতে আজ থেকে ৬ বছর আগে আমাদের উপগ্রহের মুলুকে ল্যাডিকে পাঠিয়েছিল নাসা। চাঁদের বায়ুমণ্ডলকে জরিপ করতে ল্যাডি আমাদের উপগ্রহের বিভিন্ন কক্ষপথে ছিল ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪-র এপ্রিল পর্যন্ত। ৬ মাস। চাঁদের বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব আর সেখানকার বাতাসে মিশে রয়েছে কোন কোন মৌল বা যৌগ, তা বুঝতে ল্যাডির সঙ্গে ছিল বিশেষ একটি যন্ত্র। নিউট্রাল মাস স্পেকট্রোমিটার (এনএমএস)। যার আরও একটি কাজ ছিল। চাঁদের বাতাসে কতটা ধুলো কী পরিমাণে মিশে রয়েছে, সেটাও খুঁজে দেখা।

কুমারমঙ্গলম বলছেন, ‘‘একটি নয়। উল্কার আঘাতে চাঁদের মাটির নীচ থেকে জলের কণা উঠে এসে বাষ্পীভূত হয়ে মিশে যাচ্ছে চাঁদের বায়ুমণ্ডলে, এমন অন্তত ২৫ থেকে ৩৬টি ঘটনা দেখা গিয়েছে। আর সেটা চাঁদের বিশেষ কোনও একটি জায়গায় দেখা গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। দেখা গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। কোথাও কোথাও একটি বড় এলাকা জুড়ে। আর প্রায় সবক’টি ঘটনারই মূলে ছিল চাঁদের বুকে উল্কাপাত।’’

উল্কাপাতের ঘটনাগুলি ঘটেছিল কবে?

কুমারমঙ্গলম জানাচ্ছেন, ওই উল্কাপাতের ঘটনাগুলি ঘটেছিল ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি, ২ এপ্রিল, ৫ এপ্রিল এবং ৯ এপ্রিল। তার মধ্যে উল্কাপাতের বড় ঘটনা ছিল তিনটি। ৯ জানুয়ারি, ৫ এপ্রিল আর ৯ এপ্রিলের ঘটনা। ওই তিনটি দিনেই এমন ঘটনা বেশি চোখে পড়েছে ল্যাডির। ওই সব উল্কাপাতের পর চাঁদের মাটিতে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। উল্কাগুলি চাঁদের মাটি ফুঁড়ে ঢুকে গিয়েছিল অন্তত ৩ ইঞ্চি বা ৮ সেন্টিমিটার। যার মানে, আমাদের হাতের কনিষ্ঠার চেয়েও কম গভীরতায়। আর তাতেই উঠে এসেছে জলের কণা।

কী দেখেছে ল্যাডি? দেখুন নাসার ভিডিয়ো

যা এই প্রথম জানাল, জলের খোঁজে চাঁদের খুব বেশি গভীরতায় যাওয়ার দরকার হবে না হয়তো কোনও কোনও জায়গায়। সামান্য গভীরতাতেই জল মিলতে পারে চাঁদে।

জল-চিন্তা কমবে চাঁদের পিঠের সভ্যতার...

সন্দীপের কথায়, ‘‘কী ভাবে জল এসেছিল চাঁদে, সেই অজানা ইতিহাসের পাতাগুলি এ বার আমাদের সামনে হয়তো খুলে যাবে। আর ২০ কি ৩০ বছরের মধ্যে আমরা চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার যে ভাবনাচিন্তা করছি, তার মূল অন্তরায় ছিল একটাই। বাঁচার জন্য জল ওই মুলুকে জুটবে কোথা থেকে? এই আবিষ্কার সেই বড় মাথাব্যথা কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিল। তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ বার সেই জল ভেঙে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যায়, তা হলে আগামী দিনে তা চাঁদে জ্বালানির অভাব মেটানোরও পথ খুলে দিতে পারে।’’

তিন বিশেষজ্ঞ: (বাঁ দিক থেকে) নাসার গৌতম চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার সন্দীপ চক্রবর্তী ও বেঙ্গালুরুর সুজন সেনগুপ্ত

তবে সেই জল কোথা থেকে এসেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয় বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইএপি)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুজন সেনগুপ্তের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘চাঁদে অক্সিজেন মৌলিক অণু হিসেবে রয়েছে, এমন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে চাঁদের জন্ম হয়েছিল কী ভাবে, তার জন্মের পরের সময়টা কেমন ছিল, এই ঘটনা অবশ্যই সেই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি এটাও জানতে হবে সেই জল কী অবস্থায় রয়েছে? সেখানে কি হাইড্রোক্সিল আয়নেরই প্রাবল্য বেশি? ওই জল উল্কা থেকে আসেনি তো? পৃথিবীতে জলের উৎসও তো তেমনই কোনও ঘটনা।’’

না, ওই জল উল্কা থেকে আসেনি: নাসা

গবেষকরা অনেকটাই নিশ্চিত, সেই জল এসেছে চাঁদেরই অন্দর ফুঁড়ে। কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা? কুমারমঙ্গলমের কথায়, ‘‘আমরা দেখেছি, যে সব উল্কাপাত হয়েছে, তাদের মধ্যে জলের পরিমাণ যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি জলীয় বাষ্প মিলেছে চাঁদের বায়ুমণ্ডলে।’’

আরও পড়ুন- ফসল চাঁদের মাটিতে? রহস্যের জট খোলেনি, বলছেন নাসার বিজ্ঞানী​

আরও পড়ুন- সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস, রাজস্থানে দাসত্বের ছবি উপগ্রহের চোখে!​

পৃথিবীর জন্মের ৫০ কোটি বছর পরেই জন্ম হয়েছিল চাঁদের। মানে, চাঁদের বয়সও হয়ে গেল ৪০০/৪৫০ কোটি বছর।

সুজনের কথায়, ‘‘চাঁদের জন্ম-বৃত্তান্ত নিয়ে অনেক তত্ত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি তত্ত্ব বলছে, সুদূর অতীতে পৃথিবীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হয়েছিল কোনও উল্কা বা সুবিশাল কোনও মহাজাগতিক বস্তুর। সেই অভিঘাতের জেরেই পৃথিবী থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল একটি অংশ। সেটাই চাঁদ। তাই আমাদের উপগ্রহটি আদতে পৃথিবীরই একটি অংশ। তাই চাঁদের পাথরের সঙ্গে এত মিল পৃথিবীর পাথরের। তাই যে ঘটনা ল্যাডি দেখেছে, তাতে খুব অবাক হচ্ছি না। এখন মনে হচ্ছে, এই সৌরমণ্ডলের সবক’টি পাথুরে গ্রহ, উপগ্রহেই জল রয়েছে।’’

সন্দীপ অবশ্য মনে করছেন, জল লুকিয়ে থাকতেই পারে চাঁদের মাটির সামান্য নীচে। চাঁদের অভিকর্ষ বল খুব কম বলে উপরের স্তরের জল উড়ে গিয়েছে। সেখানে জলের হদিশ মেলার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু নীচের স্তরের জল তো থেকে‌ই যেতে পারে পাথরের মধ্যে। চার পাশে। সেটাই উল্কাপাতের অভিঘাতে উঠে আসতে পারে চাঁদের পিঠের উপরে।

নাসার বিজ্ঞানী গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘লুনার ফ্লাশলাইট নামে নতুন একটি যন্ত্র বানানো হচ্ছে। সেটাও নাসার অ্যাডভান্সড এক্সপ্লোরেশান সিস্টেম (এইএস)-এর অংশ হিসেবে চাঁদের মাটির নীচে থাকা জলের খোঁজখবর নেবে। উল্কার মতোই কৃত্রিম ভাবে চাঁদে আঘাত হানার কথাও ভাবা হয়‌েছে। সেই অভিঘাতের ফলে চাঁদের মাটির নীচ থেকে যে জলের অণু ও হাইড্রোক্সিল আয়ন বেরিয়ে আসবে, তার পরিমাণ মাপা হবে।’’

গৌতম অবশ্য স্বীকার করেছেন, ‘‘ঠিক কতটা জল এখনও রয়েছে চাঁদে, তা জানা সম্ভব হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘গবেষণাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ল্যাডির আবিষ্কার শেষ কথা নয়। বরং শুরু। গোড়াপত্তন। আগামী দিনে, নাসার ‘ডালি’ কর্মসূচির যন্ত্রগুলি এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে বলেই আমি মনে করি।’’

ওই জল ভেঙে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন মিললে জ্বালানি সঙ্কটও থাকবে না চাঁদে...

সন্দীপের কথায়, ‘‘চাঁদের জল ভেঙে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে মেলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন, তা হলে আগামী দিনে মঙ্গল বা এই সৌরমণ্ডলের অন্য কোনও গ্রহে যেতে মহাকাশযানের জ্বালানি সে ক্ষেত্রে পৃথিবী থেকে ভরে পাঠাতে হবে না। চাঁদ থেকেই জ্বালানি ভরে মঙ্গল বা অন্য কোনও গ্রহে রওনা হতে পারবে আমাদের পাঠানো মহাকাশযান। শুধু তাই নয়, চাঁদে গিয়ে বা সেখান থেকে মহাকাশের অন্য কোনও লোকেশনে গিয়ে এ বার ব্ল্যাক হোলের ছবি আরও ভাল ভাবে তোলা সম্ভব হতে পারে।’’

ছবি, গ্রাফিক ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE