Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Science News

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস, রাজস্থানে ইটভাঁটায় দাসত্বের ছবি ধরা পড়ল উপগ্রহের চোখে!

হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন রাজস্থানের ইটভাঁটার মালিকরা। ধরা পড়ে গেলেন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে যাঁরা নানা রকমের কৃষিভিত্তিক শিল্প, ব্যবসা চালান, সেই মালিক-ব্যবসায়ীরা। প্রচুর ডলার, ইউরো, পাউন্ডের লোভে যাঁরা ম্যানগ্রোভের অরণ্য কেটে সাফ করে দিয়ে ভূমিকম্পের বিপদ বাড়াচ্ছেন সুন্দরবন ও তার লাগোয়া এলাকায়, তাঁরাও।

রাজস্থানের ইটভাঁটার ছবি। মহাকাশ থেকে উপগ্রহের তোলা ছবি।

রাজস্থানের ইটভাঁটার ছবি। মহাকাশ থেকে উপগ্রহের তোলা ছবি।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৪:২০
Share: Save:

উপগ্রহের গোয়েন্দাগিরির নজরদারি আর এড়াতে পারল না ভারতে চলা দাসত্ব! হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল।

হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন রাজস্থানের ইটভাঁটার মালিকরা। ধরা পড়ে গেলেন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে যাঁরা নানা রকমের কৃষিভিত্তিক শিল্প, ব্যবসা চালান, সেই মালিক-ব্যবসায়ীরা। প্রচুর ডলার, ইউরো, পাউন্ডের লোভে যাঁরা ম্যানগ্রোভের অরণ্য কেটে সাফ করে দিয়ে ভূমিকম্পের বিপদ বাড়াচ্ছেন সুন্দরবন ও তার লাগোয়া এলাকায়, তাঁরাও। ধরা পড়ে গেলেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবৈধ কয়লা খাদান মালিকরা। গোপন নজরদারি এড়াতে পারলেন না চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের ভেড়ির মালিকরা। তাঁরা সকলেই ধরা পড়ে গেলেন পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা বিভিন্ন উপগ্রহের সজাগ, সতর্ক চোখে।

রিপোর্ট পেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে

ভারত-সহ গোটা বিশ্বে কাজের নামে এখনও কী ভাবে চলছে দাসত্ব, কী ভাবে শিশু ও মহিলাদের শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে চালানো হচ্ছে অত্যাচার, বন কেটে সাফ করে কী ভাবে চলছে চোরাপাচার, ২০১৭ সাল থেকেই তার উপর নজর রাখছিল মহাকাশে থাকা বিভিন্ন উপগ্রহ। গোপনে। সেই গত দু’বছরের খুঁটিনাটি তথ্যাদি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশ করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটিতে এক সম্মেলনে। যার স্পনসর ছিলেন ইউনাইটেড নেশনস ইউনিভার্সিটি (ইউএনইউ)। ওই সম্মেলনে ছিলেন ভারত-সহ রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৩২টি দেশের কম্পিউটার তাত্ত্বিক, দাসত্ব বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারকরা।

উপগ্রহ থেকে এতটাই নিখুঁত ভাবে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ির ছবি

রাজস্থানের ইটাভাঁটা থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য

রাজস্থানের ইটভাঁটা থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। কেরলের সোনার খনি থেকে জম্মু-কাশ্মীর। এই একুশ শতকেও কী ভাবে চোরাগোপ্তা দাসত্ব চলছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়, কী ভাবে নির্বিচারে সেই দাসত্বের বলি হচ্ছেন শিশু ও মহিলারা, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি ও তথ্য বিভিন্ন গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠিয়ে দিল একের পর এক উপগ্রহ। তার কোনওটি ‘নাসা’র, কোনওটি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’), কোনওটি আবার রুশ মহাকাশ সংস্থা ‘রসকসমস’-এর। কোনওটি ব্রিটেন বা ইজরায়েলের। জানুয়ারিতে, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘রিমোট সেন্সিং’-এর হালের সংখ্যায় এই গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে।

উপগ্রহ থেকে এতটাই নিখুঁত ভাবে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ির ছবি

কী দেখেছে উপগ্রহগুলি?

ওই সম্মেলনে থাকা কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের অন্যতম আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন বিভাগের অনাবাসী ভারতীয় অধ্যাপক হর্ষ রবিচন্দ্রন ওয়াশিংটন থেকে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘রাজস্থানের শুধু একটি এলাকাতেই এমন ১৬৯টি ইটভাঁটার হদিশ মিলেছে। প্রত্যেকটি ইটভাঁটাতেই নির্বিচারে অত্যাচার চালানো হচ্ছে শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের উপর। তাদের ন্যায্য বেতন দেওয়া হচ্ছে না। দিনে-রাত মিলিয়ে খাটানো হচ্ছে ২২/২৩ ঘণ্টা। এমনকী, তাঁদের মারধরও করা হচ্ছে। উপগ্রহগুলি থেকে সেই অবর্ণনীয় অত্যাচারের খুঁটিনাটি দেখা সম্ভব হয়েছে।’’

উপগ্রহ থেকে কী ভাবে ছবি তোলা হয়েছে, দেখুন ভিডিয়ো

এলাকার নামকরণে শুধুই ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’...

সম্ভাব্য আইনি ব্যবস্থার জন্য সেই এলাকার নাম প্রকাশ করা হয়নি সম্মেলনে পেশ করা বিজ্ঞানীদের রিপোর্টে। এলাকাগুলিকে শুধু ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ এমন সব নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। কখনও কখনও সেই সব উল্লেখ না করে শুধু ‘*’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে।

রহস্যের গন্ধ মিলল কী ভাবে?

রবিচন্দ্রন জানিয়েছেন, উপগ্রহের পাঠানো ছবিতে রাজস্থানের ওই ইটভাঁটাগুলিকে প্রথম দেখেছিলেন ব্রিটেনের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইট্‌স ল্যাবের ডেটা প্রোগ্রাম বিভাগের অধিকর্তা ডোরিন বয়েড। সেটা ছিল ২০১৭ সাল। উপগ্রহের পাঠানো ছবিতে ডিমের মতো চেহারার এলাকাটিকে বাদামি রংয়ের দেখিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল, প্রচুর ধুলোবালি উড়ছে ওই এলাকায়। ছবি দেখেই বয়েড বুঝেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েক লক্ষ ইটভাঁটার মতো ওই বাদামি রংয়ের এলাকাটিতেও রয়েছে ইটভাঁটা। এর পর তিনি গুগ্‌ল ম্যাপ দেখে জানতে পারেন, রাজস্থানের ওই এলাকায় রয়েছে মোট ১৭৮টি ইটভাঁটা। তার মধ্যে ১৬৯টি ইটভাঁটায় শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের উপর কাজের নামে অবর্ণনীয় অত্যচার চলার খবর দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলি।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের এই হাল দেখেছে উপগ্রহ

আরও পড়ুন- আরও দু’টি চাঁদ আছে পৃথিবীর! মিলল একটির হদিশ​

আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডে তলিয়ে যাচ্ছে বড় একটা গ্যালাক্সি!​

দাসত্বের বেড়িবাঁধনে বিশ্বের সাড়ে ৪০ কোটি মানুষ!

জেনিভায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (আইএলও)-এর দেওয়া হালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে দাসত্বের বেড়িবাঁধনে জড়িয়ে থাকা শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ কোটি ৩০ লক্ষ। তার মধ্যে শিশু ও মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ২৮ কোটির কাছাকাছি।

উপগ্রহ থেকে কী ভাবে ছবি তোলা হয়েছে, দেখুন ভিডিয়ো

রবিচন্দ্রনের কথায়, ‘‘পরিসংখ্যানটা জানা থাকলেও দাসত্বের বেড়িবাঁধনে জড়িয়ে থাকা শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য পাওয়া যায় না বেশির ভাগ সময়েই। রাষ্ট্রই সেই পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলির সহায়তাও পাওয়া যায় না সেই ভাবে।’’

কাজ শুরু হয়েছিল কী ভাবে?

সেটা ২০১৫ সাল। কাজটা শুরু করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সাহায্যপ্রাপ্ত একটি সংস্থা ‘ডিজিটালগ্লোব’। পৃথিবীর উপর সব সময় নজর রাখতে তারা ইতিমধ্যেই গোটা দশেক উপগ্রহ পাঠিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে। সেই উপগ্রহগুলি প্রথম ছবি তোলে আফ্রিকার দেশ ঘানার লেক ভোল্টা (ভোল্টা হ্রদ)-র। সন্দেহ করা হচ্ছিল, ঘানার ওই হ্রদ ও তার লাগোয়া এলাকাগুলিতে যত মাছের ভেড়ি রয়েছে, সেগুলিতে শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের উপর চলছে অবর্ণনীয় অত্যাচার। তাদের দিয়েই হ্রদের মাছ চুরি করানো হচ্ছে দেদার। গভীর রাতে নৌকায় চাপিয়ে সেই সব মাছ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। চুপিসাড়ে।

মাছ চুরির ৮০ হাজার নৌকার হদিশ মিলেছিল

রবিচন্দ্রন বলছেন, ‘‘ওই সময় উপগ্রহের মারফত ভোল্টা হ্রদে ৮০ হাজার নৌকার হদিশ মিলেছিল, যা দিয়ে মাছ চুরি করা হয়েছিল। আর সেই সবই করা হয়েছিল গভীর রাতে, শিশু ও মহিলাদের দিয়ে। মাছ ধরার জাল, খাঁচা সবই দেখা গিয়েছিল উপগ্রহগুলি থেকে।’’

‘‘উপগ্রহের মারফত ওই নজরদারির প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে তোলার জন্য এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে’’, বলেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনে থাকা আরও এক অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানী কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বায়োলজিস্ট অভিষেক শ্রীবাস্তব।

কাজে নেমেছে ‘প্ল্যানেট’-এর ১৫০ উপগ্রহও

রবিচন্দ্রন জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত আরও একটি সংস্থা ‘প্ল্যানেট’ও এমন নজরদারি চালানোর জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠিয়েছে ১৫০টি উপগ্রহ। তাদের মূল কাজটা অবশ্য ফি মাসে বা ফি বছরে গোটা বিশ্বের ভূমির ওজন কতটা বাড়া-কমা করছে বা তা পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে কোন দিকে কতটা গতিতে সরে যাচ্ছে তার উপর নজর রাখা।

অভিষেক বলছেন, ‘‘শুনলে অবাক হয়ে যাবেন ওই উপগ্রহগুলির মাধ্যমে শুধু কোনও এলাকা নয়, প্রত্যেকটি বাড়ি, তাদের অন্দরমহল, প্রত্যেকটি বনাঞ্চল, প্রতিটি কয়লাখনির উপরেও নিয়মিত নজর রেখে চলা হচ্ছে। এ বার সেই নজরদারি শুরু হয়েছে অবৈধ কয়লা খাদানগুলির উপরেও।’’

কতটা নিখুঁত ভাবে চলছে সেই নজরদারি?

রবিচন্দ্রনের কথায়, ‘‘তুর্কমেনিস্তানের চাষের জমিতে তুলোর বীজ থেকে রাশি রাশি তুলো বেরিয়ে আসার ছবিও ধরা পড়েছে উপগ্রহগুলির নজরে। খেত ভরে থাকা তুলো কী ভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছে, কখনও যন্ত্রের মারফত, কখনও বা মাফিয়াদের দৌলতে, তারও ছবি তুলেছে উপগ্রহগুলি।’’

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ডিজিটালগ্লোব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE