দৈর্ঘ্য সাকুল্যে ০.০৩ ইঞ্চি থেকে ২.৫ ইঞ্চি। এতটুকু আকার, অথচ এই পিঁপড়েরাই নাকি ভেঙেচুরে দিয়েছে জীববিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক ধারণা। এই পিঁপড়ে-রহস্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ পত্রিকায়।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ইউরোপের অত্যন্ত পরিচিত একটি প্রজাতির পিঁপড়ে-কুল চমকে দিয়েছে তাঁদের। তাঁরা প্রথমে দেখেন, ওই পিঁপড়েদের রাজত্বে রানি পিঁপড়েটি যে সব পুরুষ সন্তানের জন্ম দেয়, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির! কিন্তু তা কী করে সম্ভব? রহস্য-সমাধানে শুরু হয়েছিল গবেষণা। তাতেই সামনে এল অভাবনীয় তথ্য। জানা গেল, পুরুষের অভাব দেখা দিয়েছিল। তাই নিজেই ‘ক্লোন’ করে ভিন্ন প্রজাতির পুরুষ পিঁপড়ের জন্ম দেয় রানি পিঁপড়েটি। তার পরে নিজের সৃষ্টি পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করে একাই এগিয়ে নিয়ে যায় ‘বংশের প্রদীপ’।
‘মেসর ইবেরিকাস’ নামে ওই পিঁপড়ে প্রজাতিটির রানি যৌন-পরজীবী। তারা শুক্রাণু (স্পার্ম)-র জন্য ‘মেসর স্ট্রাক্টর’ নামে পিঁপড়ে প্রজাতির পুরুষদের উপর নির্ভরশীল। মেসর ইবেরিকাস রানি পিঁপড়েটি ওই ভিন্ন পরিবারের ছেলে-পিঁপড়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে।তার পরে জন্ম দেয় শ্রমিক পিঁপড়েদের বাহিনী। স্বাভাবিক ভাবেই এই শ্রমিকেরা হয় মিশ্র প্রজাতির। দুই পিঁপড়ে পরিবারের এই ‘পরকীয়া’ এত দিন জানাই ছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু তাঁরা দেখেন, ‘মেসর ইবেরিকাস’ পিঁপড়েদের পরিবারেরকাছাকাছি যদি ‘মেসর স্ট্রাক্টর’-এর কলোনি না-ও থাকে, ‘ইবেরিকাস’-দের রানি ‘ক্লোন’ করে ফেলে পুরুষ ‘মেসর স্ট্রাক্টর’-দের। রানি যে ডিম পাড়ে, তাতেই মিলেছে প্রমাণ। ওই ডিমে পাওয়া গিয়েছে‘মেসর স্ট্রাক্টর’-দের ডিএনএ।
‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে কোপেনহাগেন ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী (বিবর্তন বিষয়ক) জ্যাকোবাস বুমসমা বলেছেন, ‘‘অসাধারণ ঘটনা। প্রকৃতির বিচিত্র কিন্তু অকল্পনীয় কাহিনি।’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ইউরোপের কিছু অংশে ‘মেসর ইবেরিকাস’ পিঁপড়েদের দেখা যায়। এরা মোটামুটি সর্বত্রই ‘মেসর স্ট্রাক্টর’-দের সঙ্গে সহাবস্থান করে। ফলে রানি ইবেরিকাসের ‘স্ট্রাক্টর পরিবার’ থেকে প্রেমিক খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ফ্রান্সের ‘ইনস্টিটিউট অব ইভোলিউশনারি সায়েন্স অব মঁপেলিয়ে’-র জীববিজ্ঞানী জনাথন রোমিগুয়ের ও তাঁর সহকর্মীদের নজরে পড়ে বিচিত্র এক কাণ্ড। ইটালির সিসিলি দ্বীপে তাঁরা দেখেন, শুধুই ‘মেসর ইবেরিকাস’-দের বাস। কোনও ‘মেসর স্ট্রাক্টর’ কলোনি নেই।
এর পরেই ‘ইবেরিকাস’ পরিবারে অন্তর্তদন্ত শুরু করেন জনাথনরা। দেখেন, একই পরিবারে দু’ধরনের পিঁপড়ের বাস। তাদের দেখতেও পুরো আলাদা। জেনেটিক বিশ্লেষণ করেও দেখা যায়, একই পরিবারে রয়েছে ‘মেসর ইবেরিকাস’ ও ‘মেসর স্ট্রাক্টর’। বিজ্ঞানীদের মনে সন্দেহ জাগে, কারণ, এমনটা হওয়ার নয়। দীর্ঘ তদন্তে রহস্যজাল ভেদ হয়। জানা যায়,‘মেসর ইবেরিকাস’-দের রানি ক্লোন করে ‘মেসর স্ট্রাক্টর’ প্রজাতির পিঁপড়ের জন্ম দেয়, যাতে তাদের থেকে শুক্রাণু (স্পার্ম) পাওয়া যায়। ক্লোন করে তৈরি ‘মেসর স্ট্রাক্টর’-দের সঙ্গে জনন করে রানি ‘মেসর ইবেরিকাস’ জন্ম দেয় মিশ্র প্রজাতির শ্রমিক পিঁপড়েদের। এই শ্রমিকেরা সংসারেরযাবতীয় কাজ করে। কলোনির যত্ন নেয়, বাসা তৈরি করে, খাবার সংগ্রহ করে। ‘মেসর ইবেরিকাস’ শুধু তার সঙ্গীটিকে তৈরি করে, তার দেখভাল করে। এই মাতৃতান্ত্রিক সংসারে ‘বংশ’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সব দায়িত্বতো রানিরই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)