ভারতে খরা। -ফাইল ছবি।
পাক্কা তিন বছর পর আবার ভয়াবহ চেহারায় আসছে ‘এল নিনো’। ১৫ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে। ডিসেম্বর পড়তেই তা তৈরি হতে শুরু করেছে। এ মাসের শেষাশেষি তা নেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ।
জোর আশঙ্কা, প্রশান্ত মহাসাগরের চিলি ও পেরু উপকূল এবং মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে তৈরি হওয়া সেই ‘এল নিনো’র জেরে এ বার ওলটপালট হয়ে যেতে পারে ভারতের বর্ষার মরসুম। উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যেতে পারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। হতে পারে ভয়াবহ খরা। যার অনিবার্য প্রভাব পড়বে দেশের কৃষিকাজে। যার জেরে দারুণ ভাবে মার খেতে পারে ভারতের ফসল উৎপাদন।
ওই ভয়ঙ্কর ‘এন নিনো’র জন্য চিলি, পেরু-সহ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটতে পারে প্রচণ্ড খরা, একের পর এক দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও।
According to @WMO there is a 75–80% chance of a fully-fledged #ElNino starting soon. Satellites can help predict it: #Sentinel3 radiometer measures changes in the temperature of the sea-surface, one of the first signs of an oncoming El Niño. https://t.co/uULuS6ZrRp pic.twitter.com/9RTL7D1cT9
— ESA EarthObservation (@ESA_EO) December 8, 2018
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’)-র উপগ্রহ ‘কোপার্নিকাস সেন্টিনেল-৩’-র পাঠানো তথ্য ও ছবি ওই দুঃসময়ের পূর্বাভাস দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড মেটিরিওলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও)-এর দেওয়া তথ্য বলছে, আর দেড় মাসের মধ্যেই খুব শক্তিশালী এল নিনোর সম্ভাবনা ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ।
আবহবিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছেন, চিলি, পেরু-সহ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলের জলস্তরের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এ মাসের শেষে তা আরও বাড়বে।
কোথায়, কেন ঘটে এল নিনো?
এল নিনোর ঘটনা মূলত ঘটে চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী দেশগুলিতে। মোটামুটি ভাবে ২ থেকে ৭ বছর অন্তর। সেই সময় মহাসাগরের জলস্তরের (সি সারফেস) তাপমাত্রা অন্তত ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। ফলে, উপকূলবর্তী এলাকার বায়ুমণ্ডলও তেতে ওঠে।
ওই সময় মহাসাগরের পিঠের (সি সারফেস) জল দ্রুত হারে অসম্ভব গরম হয়ে যায়। কারণ, ওই সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে গরম জলের স্রোত ধেয়ে আসে মহাসাগরের পূর্ব দিকে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের জলস্তর অনেকটাই গরম। তুলনায় ঠান্ডা চিলি, পেরু-সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী জলস্তর।
এল নিনোর সময় পূর্ব উপকূলের সেই গরম জল তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় মহাসাগর সংলগ্ন স্থলভাগের বিভিন্ন দেশের বহু এলাকার। ওই সময় সুমুদ্রের তলদেশ থেকে ঠান্ডা জলও উপরে উঠে আসতে পারে না, মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তের উপরে থাকা জলস্তরকে। ফলে, সেখানকার সমুদ্রের পিঠের জলস্তর ঠান্ডা হওয়ার সুযোগই পায় না।
এল নিনো হয় কেন? দেখুন ভিডিয়ো
এই অবস্থা চলে প্রায় এক বছর। তার পর শুরু হয় ‘লা নিনা’। যার জেরে সমুদ্রের জল দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করে, পূর্ব প্রান্তে। কারণ, এল নিনোর সুবাদে গরম হয়ে ওঠা মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তের জলস্তর আবার পশ্চিম দিকে বইতে শুরু করে।
মূলত বড়দিনের সময় থেকেই পেরু ও চিলির উপকূলে এই এল নিনো বড়সড় হয়ে উঠতে শুরু করে। স্পেনিয় ভাষায় এল নিনোর অর্থ ‘বালক’। আর ‘লা নিনা’র মানে, ‘বালিকা’।
এল নিনো: ভারতের অভিজ্ঞতা
এই ধরনের ভয়াবহ ‘এল নিনো’র জন্য এই শতাব্দীতে এর আগে ভারতকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল, তিন বছর আগে। ২০১৫-য়। প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু এলাকা। সে বছর সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। ভারতের বর্ষার মরসুমে ততটা প্রভাব না ফেললেও, ২০০৯ সালের ‘এল নিনো’ও শক্তির দাঁড়িপাল্লায় ছিল যথেষ্টই ভয়াবহ। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭২, ১৯৮২, ১৯৮৩ সালে। ওই বছরগুলিতেও পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে জন্মানো ‘এল নিনো’ বড়সড় প্রভাব ফেলেছিল ভারতের বর্যার মরশুমে। তবে ১৯৯৭, ২০০২ ও ২০০৪ সালের ‘এল নিনো’র ততটা প্রভাব পড়েনি এ দেশে। আর ’৯২ সালের এল নিনোর দুঃসহ প্রভাব এখনও ভারতীয়রা সম্ভবত ভুলতে পারেননি।
আরও পড়ুন- পৃথিবী থেকে দ্রুত উধাও হচ্ছে অক্সিজেন, কারণ খুঁজতে মেরুতে নাসা
আরও পড়ুন- এল নিনো দুর্বল, তবু ২০১৭-র মাথা গরম
পুণেয় কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর (আইএমডি)-এর দায়িত্বে থাকা বিশিষ্ট আবহবিদ ডি এস পাই বলছেন, ‘‘প্রশান্ত মহাসাগরের ওই ‘এল নিনো’র প্রভাব সব সময়েই পড়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কোনও না কোনও প্রান্তে। তা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে নিয়ে আসে খরা। বাড়িয়ে দেয় দাবানলের মতো ঘটনা। তবে ‘এল নিনো’র জন্যই যে শুধু কোনও দেশের আবহাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন হয়, তা নয়। আরও নানা কারণ থাকে তার। তাই, সাম্প্রতিক কালে, ১৯৯৭ সালের ‘এল নিনো’ সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও, তার তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি ভারতের বর্ষাকালে।’’
তবে ‘এল নিনো’র জন্য অতীতে ভারতকে বার বারই ভুগতে হয়েছে। হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট আবহবিদ কে অশোক বলেছেন, ‘‘৭২ সালের এল নিনোয় ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছিল ১৫ শতাংশ। ’৮২-’৮৩-তে তা কমেছিল ১৯ শতাংশ। ’৮৭-তে ১২ শতাংশ। আবার ২০০৯ সালের এল নিনো বেশ শক্তিশালী বলেও, তার তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি ভারতে।’’
সরে আসছে পেরু উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে
অশোক জানিয়েছেন, গত কয়েক দশকে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূল থেকে এল নিনোর ‘জন্মস্থান’ অনেকটাই মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে সরে গিয়েছে। সেটা এল নিনোর আরও একটি ‘প্রজাতি’। যার নাম- ‘এল নিনো-মোদোকি’। ফলে, ভারতের মতো দেশগুলিতে তার জেরে বিপদ ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে গিয়েছে।
পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিরিওলজি (আইআইটিএম)-র সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা আর কৃষ্ণণ বলছেন, ‘‘এল নিনো ইতিমধ্যেই তৈরি হতে শুরু করেছে। তার বড়সড় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে এ বার ভারতে। যাতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যেতে পারে উল্লেখযোগ্য ভাবে। হতে পারে ভয়াবহ খরাও। তবে খরা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাসের জন্য এল নিনো ছাড়াও অন্য অনেক কারণ রয়েছে। সেই কারণগুলির জন্য এল নিনোর প্রভাব আবার নাও পড়তে পারে ভারতে।’’
সঙ্গে ‘এল নিনো-মোদোকি’ জুড়লে তা খুবই চিন্তার!
অশোকের কথায়, ‘‘এই এল নিনোর সঙ্গে এল নিনো-মোদোকি জুড়লে তা আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্টই। যা হয়েছিল ১৯৯২ সালে।এল নিনো-মোদোকি তৈরি হয়, বেড়ে ওঠে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যাঞ্চলে। তবে এখনই বলা যাচ্ছে না, এ বারের এল নিনো কতটা ভয়াবহ হবে। তার জন্য ফেব্রুয়ারি, মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’’
বিজ্ঞানীরা অবশ্য এও জানিয়েছেন, এই এল নিনো যদি মার্চ, এপ্রিলের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে তার ততটা প্রভাব পড়বে না ভারতের বর্ষাকালের উপর। তবে যদি তার মেয়াদ বাড়ে, তা হলে তা যথেষ্টই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ভারতের পক্ষে।
ভয়াবহতা নিয়ে পূর্বাভাস কতটা সঠিক?
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের স্যাটেলাইট মেটিরিওলজি ডিভিশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টর অসীম কুমার মিত্র জানাচ্ছেন, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পাঠানো ওই উপগ্রহে যে সর্বাধুনিক যন্ত্রগুলি রয়েছে, তাতে অন্তত ৯০ শতাংশ পূর্বাভাস মিলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy