Advertisement
E-Paper

পৃথিবী থেকে দ্রুত উধাও হচ্ছে অক্সিজেন, কারণ খুঁজতে মেরুতে নাসা

বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে, নানা রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, যেমনটা ভাবা হয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রায় সেই ভাবেই উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে এলেও, বাতাসের অক্সিজেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৫:০৯
ছবি সৌজন্যে: নাসা।

ছবি সৌজন্যে: নাসা।

দ্রুত পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে আমাদের শ্বাসের বাতাস! অক্সিজেন। এত দ্রুত হারে তা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে যে, রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। ওজনে হালকা হয়ে পড়ছে পৃথিবী।

নাসার বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে, নানা রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, যেমনটা ভাবা হয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রায় সেই ভাবেই উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে এলেও, বাতাসের অক্সিজেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে।

দেখা গিয়েছে, সেই হারে কিন্তু পৃথিবী খুইয়ে ফেলছে না গাছপালাদের রান্নাবান্নার (সালোকসংশ্লেষ) জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড। অক্সিজেনের মতো অত দ্রুত হারে পৃথিবীতে কমে যাচ্ছে না বাতাসের নাইট্রোজেন ও মিথেন। যা বেঁচে থাকার জন্য খুব কাজে লাগে অণুজীবদের। বিজ্ঞানীদের অনুমান, বহু কোটি বছর আগে এমন দশাই হয়েছিল আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের।

অরোরা বোরিয়ালিসের এলাকায় ঢুকে যাবে রকেট

উদ্বেগ বাড়ছে বলেই ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে বিজ্ঞানীদের, কেন প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত হারে উধাও হয়ে যাচ্ছে শ্বাসের বাতাস, তার কারণ জানতে। মঙ্গলবার রাতে সেই লক্ষ্যেই নরওয়ের উত্তর উপকূল থেকে পাঠানো হয়েছে ‘ভিশন্‌স-২’ সাউন্ডিং রকেট। অভিনব রকেট। যাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাঠানোর কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরিয়ে আনা যাবে পৃথিবীতে। এই সময়ে নরওয়ের উত্তর উপকূলে আকছারই দেখা যায় অরোরা বোরিয়ালিস। মেরুজ্যোতি। কয়েক লহমায় তারই মধ্যে ঢুকে গিয়ে খবরাখবর নিয়ে ফিরে আসবে ওই সাউন্ডিং রকেট।

পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছে অক্সিজেন (0)। শিল্পীর কল্পনায়।

তবে শুধু রকেট ছুড়েই তাঁদের কাজ শেষ করেননি বিজ্ঞানীরা, মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গর্ডার্ড স্পেস সেন্টারের একটি গবেষকদলও পৌঁছে গিয়েছে নরওয়ের উত্তর উপকূলে। কী ভাবে বাতাসের অক্সিজেন, আমাদের শ্বাসের বাতাস মহাকাশে দ্রুত উধাও হয়ে যাচ্ছে, তার উপর নজর রাখতে।

নাসার ওই গবেষকদলের অন্যতম সদস্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিমাদ্রি সেনগুপ্ত অসলো থেকে বলেছেন, ‘‘অরোরা বোরিয়ালিসের সৌন্দর্য দেখতে আসিনি আমরা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পাতলা হয়ে যাওয়া, শ্বাসের বাতাস অক্সিজেনের মহাকাশে দ্রুত চলে যাওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে অরোরা বোরিয়ালিসের। আমরা সেটাই দেখতে এসেছি।’’

দিনে কয়েকশো টন বায়ুমণ্ডল খোয়াচ্ছে পৃথিবী!

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যে উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে আসছে, তার ধারণাটা আমাদের প্রথম জন্মেছিল, গত শতাব্দীর গোড়ায়। ১৯০৪ সালে এমন সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন স্যর জেমস জিনস। তাঁর ‘দ্য ডাইনামিক্যাল থিয়োরি অফ গ্যাসেস’ তাত্ত্বিক ভাবে জানিয়েছিল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এক দিন আমাদের ছেড়ে মহাকাশে হারিয়ে যাবে। সেই দিন পৃথিবীর আর কোনও বায়ুমণ্ডল থাকবে না। ফলে, বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপকরণটি আর পাবে না এই নীলাভ গ্রহের জীবজগৎ। তবে সেটা হতে সময় লাগবে আরও অন্তত ১০০ কোটি বছর।

আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডে এ বার আরও উন্নত সভ্যতা খুঁজবে নাসা​

আরও পড়ুন- মাটি খুঁড়ে আগ্নেয়গিরি দেখতে মঙ্গলে নামল নাসার ‘ইনসাইট’​

কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বায়ুমণ্ডলের উত্তরোত্তর পাতলা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা অত ধীরে ঘটছে না। নরওয়ের উত্তর উপকূলে নাসার ‘ভিশন্‌স-২’ মিশনের প্রধান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডগ রাউল্যান্ড আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘প্রতি দিন পৃথিবীর কয়েকশো টন বায়ুমণ্ডল আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে মহাকাশে। তার ফলে, খুব দ্রুত হারে তার ওজন হারিয়ে ফেলছে আমাদের এই গ্রহ। পৃথিবী দ্রুত হালকা হয়ে যাচ্ছে।’’

পৃথিবী থেকে অক্সিজেনের দ্রুত প্রস্থানে কেন অবাক বিজ্ঞানীরা?

হিমাদ্রির কথায়, ‘‘অক্সিজেন পরমাণুর যে পরিমাণ শক্তি রয়েছে, তার অন্ত ১০০ গুণ শক্তি প্রয়োজন বাতাসের অক্সিজেনকে পুরোপুরি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাকাশে চলে যেতে হলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে পৃথিবী ছেড়ে চলে য়াচ্ছে অক্সিজেন। গত শতাব্দীর ছয় বা সাতের দশকেও অক্সিজেনের এই দ্রুত প্রস্থানের আঁচ মেলেনি।’’

পৃথিবীকে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটোস্ফিয়ার

আরও একটি বিষয় খুব চমকে দিয়েছে নাসার বিজ্ঞানীদের। সেটা হল, পৃথিবীর ধারেকাছে যেখান থেকে সত্যি-সত্যি শুরু হচ্ছে আদত মহাকাশের (স্পেস) ‘সীমানা’, তার আশপাশের এলাকা কার্যত, গিজগিজ করছে অক্সিজেনের আয়নের ভিড়ে। গবেষকরা দেখেছেন, সেই অক্সিজেনের ভিড়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া অক্সিজেন আয়নের সংখ্যাই বেশি।

হিমাদ্রি বলছেন, ‘‘আমরা আরও অবাক হয়ে গিয়েছি, হাইড্রোজেন পরমাণু বা আয়নের চেয়ে অক্সিজেন পরমাণু বা আয়ন দ্রুত হারে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাকাশে চলে যাচ্ছে দেখে। এটা তো হওয়ার কথা নয়। কারণ, হাইড্রোজেন পরমাণুর চেয়ে ১৬ গুণ ভারী অক্সিজেন পরমাণু। তা হলে হালকা হাইড্রোজেন পরমাণুর চেয়ে কেন দ্রুত হারে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছে অক্সিজেন, এখনও তার কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ খুঁজে পাইনি আমরা।’’

কোন ফাঁক গলে মহাকাশে পালিয়ে যাচ্ছে শ্বাসের বাতাস অক্সিজেন?

সৌরবায়ু এসে পৃথিবীর দুই মেরুর চৌম্বক ক্ষেত্রে আছড়ে পড়লে যাকে বলে, রীতিমতো ঝমঝম করে ওঠে এই গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র। সৌরবায়ুকণার শক্তিতে উত্তেজিত হয়ে উঠে মেরুর বায়ুমণ্ডলের পরমাণু আয়নে ভেঙে যায়। বেরিয়ে আসে খুব শক্তিশালী ইলেকট্রন কণা। তার ফলেই তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের অরোরা। পৃথিবীর আশপাশের বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক ক্ষেত্রে পড়ে সেই ইলেকট্রন কণাগুলির গতিবেগ আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়। সেটাই ভেঙে দেয় বায়ুমণ্ডলকে আরও দ্রুত হারে। কিন্তু ওই ‘উন্মাদ’ ইলেকট্রন কণাদের ভয়ঙ্কর ছোটাছুটি যে প্রচণ্ড শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের জন্ম দেয়, তা বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরগুলিকে ভীষণ তাতিয়ে দেয়। তার মধ্যে ‘ছিদ্র’ তৈরি করে। ওই বাড়তি তাপই বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন পরমাণু ভেঙে আয়ন বানিয়ে তাকে পৃথিবীর মায়া কাটানোর প্রয়োজনীয় শক্তি দেয়।

ছবি সৌজন্যে: গর্ডার্ড স্পেস সেন্টার, নাসা

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy