‘অবতার’-এর সেই ‘প্যান্ডোরা’ উপগ্রহের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? যেখানে পাওয়া গিয়েছিল ভিন্গ্রহীদের সন্ধান। ‘আলফা সেন্টোরি’ নক্ষত্রমণ্ডলের এক কাল্পনিক গ্যাসীয় গ্রহকে চক্কর কাটত সেই কাল্পনিক উপগ্রহ। এ বার সেই নক্ষত্রমণ্ডলে সত্যি সত্যিই এক গ্যাসীয় গ্রহের উপস্থিতি জোরালো হল। ‘অবতার’ সিনেমা আত্মপ্রকাশের দেড় দশক পেরিয়ে বিজ্ঞানীরা ওই একই নক্ষত্রমণ্ডলে খুঁজে পেলেন এক সম্ভাব্য গ্যাসীয় গ্রহ।
পৃথিবী থেকে ‘আলফা সেন্টোরি’ নক্ষত্রমণ্ডলের দূরত্ব মাত্র চার আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করতে পারে, সেই দূরত্বকে এক আলোকবর্ষ ধরা হয়)। সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্রমণ্ডল এটিই। আমাদের সৌরমণ্ডলে যেমন একটিই সূর্য রয়েছে, ‘আলফা সেন্টোরি’তে রয়েছে তিনটি সূর্য (নক্ষত্র)— ‘আলফা সেন্টোরি এ’, ‘আলফা সেন্টোরি বি’ এবং ‘প্রক্সিমা সেন্টোরি’। এর মধ্যে ‘আলফা সেন্টোরি এ’ এবং ‘আলফা সেন্টোরি বি’ অনেকটা আমাদের সূর্যের মতোই। তৃতীয়টি অর্থাৎ, ‘প্রক্সিমা সেন্টোরি’ একটি বামন নক্ষত্র। এর তেজ অনেকটাই কম। তুলনামূলক শীতল, কম ভরের নক্ষত্র এটি।
‘আলফা সেন্টোরি’ নক্ষত্রমণ্ডলে এখনও পর্যন্ত তিনটি গ্রহের সন্ধান মিলেছে। তিনটিই বামন নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরির চারপাশে চক্কর কাটে। ‘আলফা সেন্টোরি এ’ বা ‘আলফা সেন্টোরি বি’-কে ঘিরে কোনও গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে এত দিন পর্যন্ত বিশেষ কোনও তথ্য ছিল না মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে। সম্প্রতি নাসার জেম্স ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন এক মহাজাগতিক গ্যাসীয় পিণ্ড। ‘আলফা সেন্টোরি এ’-কে প্রদক্ষিণ করছে এটি। প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীদের অনুমান, এটি একটি গ্যাসীয় গ্রহ।
আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এটির অবস্থান। এই গ্যাসীয় পিণ্ডটি নক্ষত্রমণ্ডলের ‘হ্যাবিট্যাট জ়োন’ (যেখানে গ্রহের পৃষ্ঠদেশে জল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে)-এর মধ্যেই রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এটি গ্রহ বলে নিশ্চিত হলে, এটিই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি অন্য কোনও নক্ষত্রমণ্ডলের ‘হ্যাবিট্যাট জ়োন’-এ থাকা গ্রহ। গ্যাসীয় গ্রহ বলতে বোঝায় যে গ্রহগুলির পাথুরে পৃষ্ঠদেশ থাকে না। সেখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়ামের মতো বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান থাকে। যেমন আমাদের সৌরমণ্ডলে চারটি গ্যাসীয় গ্রহ আছে— বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন। ‘আলফা সেন্টোরি এ’-এর চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া গ্যাসীয় পিণ্ডটিও অনেকটা সেই রকমই।
সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার (এই দূরত্বকে এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বলা হয়)। ‘আলফা সেন্টোরি এ’ থেকে এই সম্ভাব্য গ্যাসীয় গ্রহটির দূরত্ব এর দ্বিগুণ। অর্থাৎ প্রায় ৩০ কোটি কিলোমিটার। তবে ‘অবতার’-এর মতো এই সম্ভাব্য গ্রহের চারপাশে ‘প্যান্ডোরা’র কোনও উপগ্রহ চক্কর কাটছে কি না, তা এখনও জানা যায়নি। তা ছাড়া এটি গ্যাসীয় অবস্থায় থাকার ফলে এখানে প্রাণের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই জানাচ্ছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন:
তবে মহাজাগতিক এই গ্যাসীয় পিণ্ডটি নক্ষত্রমণ্ডলের যে জায়গায় অবস্থান করছে, তা মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, ‘আলফা সেন্টোরি এ’ এবং আমাদের সূর্যের বয়স এবং তাপমাত্রা প্রায় কাছাকাছি। তার উপর নক্ষত্রমণ্ডলের ‘হ্যাবিট্যাট জ়োন’-এর মধ্যেই রয়েছে সেটি। ফলে এটি গ্রহ বলে প্রমাণিত হলে, তা অধ্যয়ন করে সৌরজগতের বাইরের গ্রহের বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
দক্ষিণ ক্যালিফর্নিয়ায় নাসার জেট প্রপালশন গবেষণাগারের বিজ্ঞানী চার্লস বেইচম্যানের কথায়, “এই নক্ষত্রমণ্ডলটি (আলফা সেন্টোরি এ) আমাদের ভীষণ কাছে রয়েছে। ফলে এখানে যে কোনও গ্রহ পাওয়া গেলে, তা বহির্বিশ্বের গ্রহের বিষয়ে জানতে আমাদের দারুণ সাহায্য করবে।” আগামী দিনে জেমস্ ওয়েব টেলিস্কোপের পাশাপাশি অন্য আধুনিক টেলিস্কোপেও এই সম্ভাব্য গ্রহকে বিশ্লেষণ করতে চান বিজ্ঞানীরা। ২০২৭ সালের মে মাসে ‘ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ’-এর ব্যবহার শুরু হওয়ার কথা। সেটি দিয়েও গ্যাসীয় পিণ্ডটিকে পর্যবেক্ষণ করতে চান তাঁরা। তাতে এই বিষয়ে আরও পোক্ত প্রমাণ মিলতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সম্প্রতি মহাকাশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত একটি জার্নালে প্রকাশের জন্য এই নতুন খোঁজের দু’টি গবেষণাপত্র জমা পড়েছে। সেগুলি ইতিমধ্যে গৃহীতও হয়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালের অগস্টে প্রথম বার ওই মহাজাগতিক পিণ্ডটি টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। তবে এর পরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিলে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের সময় এমন কোনও বস্তু ধরা পড়েনি। গবেষকদের অনুমান, ওই সময়ে ‘আলফা সেন্টোরি এ’-র কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ওই গ্যাসীয় পিণ্ডটি। সম্ভবত সেই কারণেই টেলিস্কোপে তা ধরা পড়েনি।