Advertisement
E-Paper

দিকে দিকে হিংসা, সন্ত্রাস, কে ‘মূল চক্রী’? কী বলছে বিজ্ঞান?

দিকে দিকে কেন এত হিংসা? কেন এত সন্ত্রাসের ঘটনা? কেন এত সংঘর্ষ, খুনোখুনি, রক্তপাত? আর পৃথিবীর কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলের দেশগুলোতে কেন হিংসা আর সন্ত্রাসের ঘটনার এত বাড়াবাড়ি? তার একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর মিলল মনস্তত্ত্ববিদ্যার সাম্প্রতিক গবেষণায়।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ১৯:৪০

দিকে দিকে কেন এত হিংসা? কেন এত সন্ত্রাসের ঘটনা? কেন এত সংঘর্ষ, খুনোখুনি, রক্তপাত?

আর পৃথিবীর কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলের দেশগুলোতে কেন হিংসা আর সন্ত্রাসের ঘটনার এত বাড়াবাড়ি? কেনই-বা তা বিশ্বের অন্য প্রান্তে তুলনায় অনেকটা কম? কে তার জন্য মূলত দায়ী? এই হিংসা, সন্ত্রাসের ‘মূল চক্রী’ কে?

এত দিনে তার একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর মিলল মনস্তত্ত্ববিদ্যার সাম্প্রতিক গবেষণায়।

জানা গেল, নিরক্ষরেখার (লাইন অফ ইক্যুয়েটর) ঠিক নীচে বা তার আশপাশের এলাকায় থাকা দেশগুলোতে হিংসা, সন্ত্রাস, খুনোখুনি, রক্তপাতের ঘটনা অনেক অনেক বেশি ঘটছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশগুলোর চেয়ে। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, নি্রক্ষরেখার নীচে থাকা আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার (দক্ষিণ আমেরিকা) একটি বড় অংশই হিংসায় বেশি উন্মত্ত, সন্ত্রাসে অনেক বেশি দীর্ণ ওই দুই মহাদেশের একটি বিস্তীর্ণ এলাকা। আর সেই এলাকায় পড়া বহু দেশ। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন বিজ্ঞান-জার্নাল ‘বিয়েভিয়রাল অ্যান্ড ব্রেন সায়েন্সেস’-এ।

কিন্তু কেন সেটা হচ্ছে? হিংসা, সন্ত্রাসের এই ‘ভৌগোলিক বৈষম্য’ কেন?

মনস্তত্ত্ববিদ্যার সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, তার ‘নাটের গুরু’ প্রকৃতি, পরিবেশ। জলবায়ু। শীত-গ্রীষ্মের তাপমাত্রার ফারাকটা যে যে দেশে বা এলাকায় যত কম, হিংসা আর সন্ত্রাস বিশ্বের সেই সব দেশেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দিনের পর দিন তা দুদ্দাড়িয়ে বাড়ছে।

গবেষকরা্ জানাচ্ছেন, শুধুই অসম্ভব গরম দেশ হলে হবে না, যে দেশের জলবায়ু যত বেশি নাতিশীতোষ্ণ ( মানে, শীত আর গ্রাষ্মের তাপমাত্রার তারতম্য যেখানে প্রায় নেই বললেই চলে), সেই সব দেশের মানুষ বেশি হঠকারী। দুমদাম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, মাথা গরম করে ফেলেন বেশি। আর রেগে গেলে তাঁরা হয়ে যান বড়ই উড়নচণ্ডী, বেসামাল। দিগ্বিদিকশূন্য। তাঁরা খুব একটা ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। জাবনটাকে তাঁরা দেখেন, ‘আজকের দিনটা চলে গেলেই হল! কালকের কথা কাল ভাবা যাবে!’ নিরক্ষরেখার নীচে থাকা দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষেরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বিশ্বের অন্য প্রান্তের দেশগুলোর নাগরিকদের চেয়ে অনেকটাই কম। আর ওই সব কারণেই তাঁরা অনেক বেশি হিংস্র আর মারমুখী হয়ে ওঠেন, চটজলদি।

এর আগেও মনস্তত্ত্ব ও আধুনিক বিবর্তন তত্ত্বের বিভিন্ন গবেষণায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বেশি হিংস্র হয়ে ওঠার জন্য তার বসবাসের এলাকার তাপমাত্রার প্রাবল্যকেই মূল কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু, হালের গবেষণা জানাচ্ছে, শুধুই তাপমাত্রার প্রাবল্য নয়, সেই সব এলাকার তাপমাত্রার কম তারতম্যই সেখানকার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে বেশি হিংস্র আর মারমুখী করে তুলছে।

গবেষণাপত্রে মূল গবেষক নেদারল্যান্ডসের ‘ভ্রিজে ইউনিভার্সিটেইট আমস্টারডাম’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব ও যোগাযোগ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পল ফন ল্যাং এবং আমেরিকার ওহায়ো ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক ব্র্যাড বুশম্যান লিখেছেন, ‘‘মানুষের জীবনচর্যা কেমন হবে, তার কেমন ঘর-বাড়ি হবে, তার পোশাকআশাক কেমন হবে, তার অনেকটাই জলবায়ু ঠিক করে দেয়। কোনও দেশের জলবায়ুই সেই দেশের মানুষের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে, তাদের অজান্তেই! আমাদের নতুন মডেল বুঝতে সাহায্য করবে, কেন নিরক্ষরেখার নীচে থাকা দেশগুলোতে হিংসা আর সন্ত্রাসের প্রাবল্য এত বেশি।’’

সহযোগী গবেষক আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ববিদ্যার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর দেবারতি বসু চৌধুরীর ব্যাখ্যায়, ‘‘এ ব্যাপারে এত দিন দু’টি চালু মডেল ছিল। তার একটির নাম- ‘জেনারেল অ্যাগ্রেসন মডেল’ বা ‘গ্যাম’। এই মডেল বলেছিল, অত্যন্ত গরম আবহাওয়া আর অত্যধিক আর্দ্রতা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। তার ফলে, তাঁরা চট করে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এটাই মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীকে বেশি হিংস্র আর মারমুখী করে তোলে। কিন্তু তার জন্য কেন খুনোখুনি, রক্তপাত বেশি হবে, তা ওই মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয় মডেলটি ছিল ‘রুটিন অ্যাক্টিভিটি থিওরি’ বা ‘র‌্যাট’। ওই মডেল বলে, অত্যন্ত গরম দেশগুলোর মানুষ ঘরের চেয়ে বাইরে সময় কাটান বেশি। আর গরমে তাঁদের অস্বস্তি আর একাকীত্ব অনেকটা বেড়ে যায় বলে, তাঁরা তা কাটাতে যত বেশি করে পারেন, অন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে চান, কথা বলতে চান। বাইরে তো বটেই, ঘরে‌ থাকলেও। তাঁরা টেলিফোনে বেশি কথা বলেন পরিজন, প্রতিবেশী বা অন্য মানুষের সঙ্গে। এ ভাবে যত বেশি মানুষের সঙ্গে তাঁরা মেশেন, ততই অন্যের সঙ্গে তাঁদের বাদা্নুবাদে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই পরিণতিতে বাড়ে সংঘর্ষের ঘটনা্। কিন্তু যে দেশের গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানকার মানুষ যত বেশি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে মেশেন, ততটাই মেশেন সেই সব দেশের মানুষ, যেখানকার গড় তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দেশে কেন হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাতের ঘটনা বেশি ঘটবে, তা ওই মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।’’

তাই এ বার নতুন মডেল দেওয়া হয়েছে। যার নাম- ‘ক্ল্যাশ’ বা ‘ক্লাইমেট অ্যাগ্রেশন অ্যান্ড সেল্ফ-কন্ট্রোল ইন হিউম্যানস্‌’।

আরও পড়ুন- ইস্তানবুল বিমানবন্দরে নির্বিচারে গুলি জঙ্গিদের! হত ৩৬, জখম শতাধিক

কী বলছে ‘ক্ল্যাশ’ মডেল?

দেবারতি বলছেন, ‘‘নতুন মডেল বলছে, শুধুই অত্যন্ত গরম আবহাওয়া নয়। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আচার-আচরণকে বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। নিরক্ষরেখার নীচে মূলত শাত ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রার কম হেরফের থাকা দেশগুলোতে মানুষজন যেহেতু জানেন, শীত এলেও তো খুব একটা কষ্ট করতে হবে না, তাই শীত আসবে বলে তাঁদের অতটা ভাবনা ভাবতে হয় না। আলাদা করে ভাবতে হয় না, তাঁরা শীতের সময় কেমন চাষবাস করবেন, পশুপালন কী ভাবে করবেন, কী ভাবে শীতের পোশাকে মুড়ে রাখবেন নিজেকে বা ঘরে কতটা গরম রাখতে হবে ‘ফায়ার-প্লেস’। ফলে, তাঁরা ভবিষ্যতের ভাবনা কম ভাবেন। আর সেটাই তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয় অনেকটা। তাঁরা বরং অনেক বেশি ভাবেন, গরমে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের হানাদারির হাত থেকে কী ভাবে রেহাই পাবেন, সাপের কামড়ের হাত থেকে বাঁচবেন কী ভাবে? মানে, তাঁরা অনেক বেশি করে বর্তমান নিয়ে ভাবেন। তাঁরা হুটোপাটি করে কাজ করেন, তেমন ভাবনা-চিন্তা নেই বলে। তাঁদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা (ডিসিপ্লিন) ও সময়ানুবর্তিতার (পাঙচ্যুয়ালিটি) অভাবটা বেশি চোখে পড়ে। জন্ম-নিয়ন্ত্রণের ওপর তাঁদের আস্থা অনেকটাই কম। এটাও আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবেরই প্রমাণ। আর এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবই তাঁদের বেশি বেশি করে হিংস্র আর মারমুখী করে তোলে।’’

Why So Many Murders, So Many Violences In Equatorial Countries CLASH Model in Psychology
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy