Advertisement
E-Paper

অক্সফোর্ডের টিকা কি হার মানবে লেকটাউনের সুমির উদ্ভাবনের কাছে?

বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, অক্সফোর্ড বা মডার্নার বানানো টিকার চেয়ে সুমির উদ্ভাবিত কোভিড টিকা সস্তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১২:৪৩
ইনসেটে, অধ্যাপক সুমি বিশ্বাস। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

ইনসেটে, অধ্যাপক সুমি বিশ্বাস। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

ভারতে জনপ্রিয়তার দৌড়ে কি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড টিকাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হবে কলকাতার লেকটাউনের বাসিন্দা সুমি বিশ্বাসের উদ্ভাবনের কাছে? সুমির বানানো কোভিড টিকা আরও সস্তা হবে? হবে আরও জনপ্রিয়? তা তৈরি করাও যাবে অনেক সহজে?

টিকা বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, অক্সফোর্ড বা মডার্নার বানানো টিকার চেয়ে সুমির উদ্ভাবিত কোভিড টিকা সস্তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তা তৈরির জন্য যে টিকার উপর বাজি ধরেছেন সুমি, বাজারে হেপাটাইটিস-বি-র সেই টিকা বহু বছর ধরেই চালু রয়েছে। আর ভারতের মূল টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট তা ফিবছর তৈরি করে প্রচুর পরিমাণে। ফলে, সুমির উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে নতুন কোভিড টিকার হিউম্যান ট্রায়াল পর্ব উতরে যেতে ততটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পদ্ধতিতে অনেকটাই অভ্যস্ত থাকায় সেই কোভিড টিকা উৎপাদনও হবে অনেক সহজে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফফিল্ড মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুমি বিশ্বাস তিন বছর হল তৈরি করেছেন একটি টিকা-প্রযুক্তি সংস্থা। ‘স্পাইবায়োটেক’। সুমি সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার।

ট্রায়াল চলছে অস্ট্রেলিয়ায়, হবে ভারতেও

অক্সফোর্ড থেকে টেলিফোনে সুমি ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বললেন, ‘‘আমার সংস্থার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে কোভিড টিকা বানানোর জন্য পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট আমাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। সিরাম যেহেতু বহু দিন ধরেই প্রচুর পরিমাণে হেপাটাইটিস-বি-র টিকা বানিয়ে থাকে তাই এই চুক্তিতে আগ্রহ ছিল দু’পক্ষেরই। সেই টিকার তিন দফার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। তা ভারতেও হবে শীঘ্রই।’’ সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সর্বাধিক টিকা উৎপাদক সংস্থা।

অক্সফোর্ডের টিকার সঙ্গে ফারাকটা কোথায়?

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার যৌথ উদ্যোগ বা মার্কিন সংস্থা ফাইজার বা মডার্নার বানানো কোভিড টিকার চেয়ে সুমির প্রযুক্তিতে বানানো টিকার ফারাকটা থাকছে কোথায়?

স্পাইবায়োটেকের গবেষণাগারে সুমি (পিছনে)।

সুমি বললেন, ‘‘মোটামুটি সকলেই কোভিড টিকা বানাতে খুবই অল্প চেনা-জানা কোভিড-১৯ ভাইরাসের উপরেই বাজি ধরছেন। অক্সফোর্ডের টিকা ‘ভেক্টর ভ্যাকসিন’। আর মডার্নার টিকা ‘মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন’। আমরা কিন্তু এই বাজিটা জিততে চাইছি আরও সহজে। চেনা হেপাটাইটিস-বি টিকার অ্যান্টিজেনের উপর অনেকটাই কম চেনা-জানা কোভিডের অ্যান্টিজেনটিকে বসিয়ে দিয়ে আমরা নতুন কোভিড টিকা বানিয়েছি। যে প্রযুক্তিতে সেটা করেছি তার নাম- ‘সুপারগ্লু’। এতে সুবিধা, বহু দিন ধরে কার্যকারিতা ও গুণাগুণ জানা আছে বলে হেপাটাইটিস-বি টিকার অ্যান্টিজেনের উপর ভরসা রাখা যাচ্ছে।’’

অন্যান্য সংক্রমণও সারবে স্পাইবায়োটেকের প্রযুক্তিতে: সুমি

সুমির বক্তব্য, হেপাটাইটিস-বি টিকার অ্যান্টিজেনের উপর সুপারগ্লু প্রযুক্তিতে কোভিডের অ্যান্টিজেন আঁটোসাটো ভাবে বসিয়ে বানানো স্পাইবায়োটেকের টিকা প্রাণীদের উপর পরীক্ষায় সফল হয়েছে।

‘‘তিন দফার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরীক্ষাতেও তা অনায়াসে উতরে যাবে। আর যে প্রযুক্তিতে এই টিকা বানানো হয়েছে তা দিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব হবে আরও নানা ধরনের সংক্রমণও। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সারানো যাবে নানা ধরনের ক্রনিক রোগ। ক্যানসার চিকিৎসাতেও বড় ভূমিকা নেবে এই প্রযুক্তি’’, বললেন যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী সুমি।

এও বললেন, ‘‘অনেকে এটা শুনে অবাক হতে পারেন ক্যানসার চিকিৎসায় টিকা! এ আবার সম্ভব নাকি? কিন্তু ক্যানসারের টিকা নিয়েও দেশে দেশে বহু দিন ধরেই গবেষণা চলছে।’’

পুণের সিরাম ইনস্টিটিউটের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার আদর পুনাওয়ালা জানিয়েছেন, স্পাইবায়োটেকের এই ভ্যাকসিন গবেষণার তত্ত্বাবধানে ছিল অক্সফোর্ডের সারা গিলবার্টের নেতৃত্বাধীন গবেষকদল ও জেনার ইনস্টিটিউটের ভাইরোলজিস্টরা। গবেষণাগারে ‘সেফ্‌টি ট্রায়ালে’ উতরে যাওয়ার পরেই সিরামের সঙ্গে টিকার উৎপাদন ও ট্রায়াল সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তা হয় স্পাইবায়োটেকের। সিরাম ইনস্টিটিউটে যেহেতু কয়েক কোটি টিকার ডোজ তৈরির মতো পরিকাঠামো রয়েছে তাই সিরামকেই টিকা তৈরির বরাত দিয়েছে স্পাইবায়োটেক। প্রথম দুই পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে সিরামকেই।

অক্সিলিয়াম কনভেন্ট থেকে অক্সফোর্ডে

লেকটাউনে জন্ম সুমির। স্কুল দমদমের অক্সিলিয়াম কনভেন্ট। তার পর পড়তে চলে যান বেঙ্গালুরুর রামাইয়া কলেজে।

মা, বাবা, বোন, স্বামীর সঙ্গে সুমি (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)।

২০০৫-য় যান অক্সফোর্ডে। গবেষণা শেষ করে অক্সফোর্ডেই শুরু হয় অধ্যাপনা। ২০১৭-য় অধ্যাপনার পাশাপাশি গড়ে ফেলেন নতুন সং‌স্থা স্পাইবায়োটেক।

সুমির ফেলে আসা দিনগুলিকে মনে রেখেছে স্কুল

সুমির জন্য গর্বিত তাঁর সেই ছোটবেলার স্কুল দমদমের অক্সিলিয়াম কনভেন্ট। স্কুলে সুমির সেই ফেলে আসা দিনগুলিকে এখনও মনে রেখেছেন শিক্ষিকারা।

দমদমের অক্সিলিয়াম কনভেন্টের জীববিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা আয়েষা কোঠিয়া বললেন, ‘‘অনেক ছাত্রীর ভিড়ে সুমিকে আমি আলাদা ভাবে মনে রেখেছি। অসম্ভব মেধাবী ছিল। যেটা ভাল ভাবে শিখবে বলে ঠিক করত সেটা শিখে ফেলত চটপট। ছিল অসম্ভব ফোকাস্‌ড। ব্যবহারটিও ছিল ভারী মিষ্টি। পড়ার সিলেবাসের বাইরে নানা ধরনের একস্ট্রা কারিকুলার কাজেও ওর পারদর্শিতা আমি মনে রেখেছি। সুমি খুব সংস্কৃতিবান পরিবারের মেয়ে। সুমির জন্য আমার খুব গর্ব হচ্ছে। কাজের মাধ্যমে সুমি প্রত্যেকটি ভারতীয়কে গর্বিত করে তুলল।’’

সুমির তুরুপের তাস ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন

সুমি জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড যেমন সর্দি-কাশির ভাইরাস ‘অ্যাডেনোভাইরাস’-এর স্ট্রেনকে দুর্বল করে তার সঙ্গে করোনার স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনকে মিশিয়ে টিকা বানিয়েছে, স্পাইবায়োটেকের পদ্ধতি তার থেকে আলাদা। অক্সফোর্ডের টিকা হল ‘ডিএনএ (ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) ভেক্টর ভ্যাকসিন’। স্পাইবায়োটেক ‘স্পাইক্যাচার’ বা ‘স্পাইট্যাগ’ প্রোটিনকে বেঁধে সুপারগ্লু প্রযুক্তিতে টিকা বানিয়েছে। ‘স্পাইক্যাচার’ বা ‘স্পাইট্যাগ’ প্রোটিনগুলি থাকে ব্যাকটেরিয়াদের শরীরে।

সুপারগ্লু প্রযুক্তিটা কী জিনিস?

সুমি বললেন, ‘‘এই পদ্ধতিতে করোনাভাইরাসের কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিনগুলোকে অন্য একটি টিকার উপর আঠার মতো সেঁটে দেওয়া হয়। যে কোনও প্যাথোজেন বা ভাইরাসের প্রোটিনই সংক্রামক। তাদের সরাসরি মানুষের শরীরে ঢোকালে প্রতিলিপি তৈরি করে তারা দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে থাকবে। তাই করোনার স্পাইক প্রোটিনগুলোকে আগে গবেষণাগারে ‘পিউরিফাই’ করে নেওয়া হয়। সংক্রামক প্রোটিন থেকে টিকা তৈরির সময় আগে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় করা হয়, আবার কোনও ক্ষেত্রে দুর্বল করে তার আগাগোড়া সাফসুতরো করে নেওয়া হয় যাতে মানুষের শরীরে ঢুকে কোনও ক্ষতি করতে না পারে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ‘পিউরিফাই’ করা।’’

কোভিড টিকা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে স্পাইবায়োটেকের গবেষণাগারে।

কেন বাজি ধরলেন হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেনের উপর?

সুমি জানিয়েছেন, ‘পিউরিফাই’ করার পরে স্পাইক প্রোটিনগুলোকে হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেনের উপর বিশেষ উপায়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। হেপাটাইটিস-বি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’)-র লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কাজেই মানুষের শরীরে এই টিকার সুরক্ষা ও কার্যকারিতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত এই টিকার উপরেই করোনার স্পাইক প্রোটিন সেঁটে দিয়ে নতুন রকমের টিকা বানানো হয়েছে।

কী ভাবে শরীরে কাজ করবে এই টিকা?

সুমি জানিয়েছেন, এই টিকা শরীরে ঢুকলে কাজ হবে দু’ভাবে। প্রথমত, হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেন শরীরের বি-কোষকে সক্রিয় করে তুলবে। দ্বিতীয়ত, হেপাটাইটিস-বি অ্যান্টিজেনের সঙ্গেই থাকা করোনার স্পাইক প্রোটিনও তার খেলা দেখাতে শুরু করবে। এর প্রভাবেও বি-কোষ সক্রিয় হয়ে উঠে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়া দ্রুত চালু করে দেবে। যেহেতু দু’রকমের অ্যান্টিজেন এই টিকায় ব্যবহার করা হয়েছে, তাই শুধু করোনা নয়, যে কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধেই ‘অ্যাডাপটিভ ইমিউন রেসপন্স’ তৈরি হবে শরীরে। শক্তপোক্ত রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।

সুমির আশা, সব ঠিকঠাক চললে আগামী বছরের মে বা জুনের আগেই ভারতের বাজারে এই কোভিড টিকা এসে যাবে।

ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক সুমি বিশ্বাস ও স্পাইবায়োটেক, অক্সফোর্ড।

coronavirus Covid Vaccines SpyBiotech Sumi Biswas Oxford University Superglue Technology
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy