Advertisement
১১ মে ২০২৪

আছাড় খেয়েও ফের ছুট জনতার

কুকুরদের টানা ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ঘুম চটকে গিয়েছিল অনেকের। দাওয়ার বিছানা ছেড়ে বাইরে উঁকি মারতেই চক্ষু চড়কগাছ! চোখ কচলেও দেখেন— ঠিকই তো দেখছেন! আধো অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হয় না। দু-দু’টো দাঁতাল হেলেদুলে রাস্তা ধরে যে এদিকেই আসছে। জান-প্রান বাঁচাতে শুক্রবার ভোরে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছিলেন বিষ্ণুপুরের কাদাকুলি বাউরিপাড়ার বাসিন্দারা। রাস্তার পাশেই কাঁচা দেওয়ালের ঘুপচি ঘর।

কাকভোরে বিষ্ণুপুর শহরে ঢুকে পড়ল দুই দাঁতাল। তাড়া খেয়ে হাতিরা ঢুকে পড়ে বেন্দা গ্রামে।

কাকভোরে বিষ্ণুপুর শহরে ঢুকে পড়ল দুই দাঁতাল। তাড়া খেয়ে হাতিরা ঢুকে পড়ে বেন্দা গ্রামে।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০১:৫৩
Share: Save:

কুকুরদের টানা ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ঘুম চটকে গিয়েছিল অনেকের। দাওয়ার বিছানা ছেড়ে বাইরে উঁকি মারতেই চক্ষু চড়কগাছ! চোখ কচলেও দেখেন— ঠিকই তো দেখছেন! আধো অন্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হয় না। দু-দু’টো দাঁতাল হেলেদুলে রাস্তা ধরে যে এদিকেই আসছে।

জান-প্রান বাঁচাতে শুক্রবার ভোরে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছিলেন বিষ্ণুপুরের কাদাকুলি বাউরিপাড়ার বাসিন্দারা। রাস্তার পাশেই কাঁচা দেওয়ালের ঘুপচি ঘর। সেই ঘরে তখনও ঘুমিয়ে বাচ্চা, বুড়ো, মেয়ে-বউরা। হাতি সামান্য ঠেলা দিলেই সেই দেওয়াল ধসে চাপা পড়বে যে মানুষগুলো। দাঁতালদের ভয়ে হইচই পড়ে যায় এলাকায়। সবাই তখন ঘর ছেড়ে পড়িমরি করে ছুটতে ব্যস্ত। তাঁদের চিৎকারেই হোক বা অন্য কারণে হোক, হাতি দু’টি অবশ্য আর শহরের ভিতর মুখো হয়নি। দুলকি চালে তারা বেরিয়ে যায় শহরের প্রান্তে বাইপাস এলাকায়।

বাউরি পাড়া বস্তি এলাকার বাসিন্দা পেশায় বিড়ি শ্রমিক মদন বাউরি, দিনমজুর অশোক বাউরি, রিকশা চালক শঙ্কর সাঁতরা বলেন, “বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছে। গরমের জন্য পাড়ার অনেকেই বাড়ির দাওয়ায় শুয়েছিলাম। হঠাৎ ভোরের দিকে কুকুরের চেঁচামেচি কেন দেখতে গিয়ে ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। দেখি বিশাল দুই দাঁতাল রাস্তায় ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে ঘর ছেড়ে সব দে ছুট্।” এ নিয়ে পাড়ায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। যাঁরা হাতিদের দেখেছিলেন, তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন, ‘পাড়ায় হাতি ঢুকেছে। সবাই বেরিয়ে এসো।’

এ দিন সকালে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাসিন্দাদের মধ্যে তখনও আতঙ্ক। ভয় যেন কাটছে না। দিলীপ বাউরি, পারুল বাউরি, মুরলি বাউরিরা বলেন, “অধিকাংশ বাড়িই মাটির। হাতি ঠেলা মারলেই বাচ্চা-কাচ্চা সহ চাপা পড়তাম। ভাগ্যিস কুকুরগুলো চিৎকার করে সাবধান করে দিয়েছিল। না হলে কী যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যেত, ভাবতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।” তাঁরা এলাকায় রাতে হুলা পার্টির পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য বন দফতরকে জানিয়েছেন।

হাতি দেখার উৎসাহে কাদাজমিতে পড়েও গেলেন অনেকে।

বাউরি পাড়ার গায়েই তৃণমূলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। বস্তির বাসিন্দাদের হাঁকডাক শুনে জেগে ওঠেন তিনিও। ততক্ষণে তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে দাঁতাল দু’টি বেরিয়ে গিয়েছে। এ দিন সকালে ওই ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পবন মাঝিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বলেন, “বাউরি পাড়ার একটি হাইড্রেনের পাড় ভেঙে দিয়েছে হাতি দু’টি। পাড়ার ভিতরে ঢুকে ঘর ভাঙলে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে যেত। নিরাপত্তার জন্য হুলা পার্টি চেয়েছি আমরা।” পাশাপাশি ক’দিন বাসিন্দাদের নিয়ে দুই কাউন্সিলর পাহারা দেবেন বলে জানিয়েছেন।

আগে কয়েকবার বিষ্ণুপুর শহরে হাতি ঢুকলেও সাম্প্রতিক অতীতে আসেনি। এত দিন শহরের আশপাশের জঙ্গল এলাকায় ঘোরাঘুরি করে তারা চলে যেত। কিন্তু এ বার সটান শহরে ঢুকে পড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে গোটা বিষ্ণুপুর শহর জুড়েই। তার উপরে রথ ও উল্টো রথ নিয়ে এই শহরের উন্মাদনা কম নয়। বিষ্ণুপুর তো বটেই, আশপাশের এলাকা উজিয়ে লোকজন ওই সময়ে এই শহরে আসেন। সেই সময় হাতি চলে এলে কী হবে? দুশ্চিন্তায় বাসিন্দারা তো বটেই।

কবে কখন

• ২০০০ সালে বিষ্ণুপুরের বাসুদেবপুর জঙ্গল থেকে প্রথমবার দলছুট হয়ে তিনটি হাতি ঢুকে পড়ে। তাড়া খেয়ে তারা
নেমে পড়ে কৃষ্ণগঞ্জের যমুনাবাঁধের জলে। রাতে জল ছেড়ে বনকর্মীদের সাহায্যে জঙ্গলে ফেরে হাতিগুলি।

• ২০০১ সালে দ্বিতীয় বার বিষ্ণুপুর শহরে এক দলছুট দাঁতালে ঢুকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মল্লেশ্বর এলাকায় তিনটি ঘরের পাঁচিল ভাঙে।

• ২০০৩ সালেও শহরে ঢুকেছিল এক দাঁতাল। কৃষ্ণগঞ্জের লালজিউ মন্দিরের পাশ দিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে একটি
বাস রাস্তায় উঠে হাতির মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার সেটিকে উল্টো পথে ঘুরিয়ে দিতে হয়।

হাতি দু’টি বিষ্ণুপুর শহরে ঢুকল কী করে? বিষ্ণুপুরের রেঞ্জ অফিসার প্রকাশ ওঝা বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে বিষ্ণুপুর রেঞ্জের বাসুদেবপুর জঙ্গলে কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে ১২টি হাতি ঢুকে পড়ে।

দলছুট্ হয়ে দু’টি দাঁতাল এ দিন ভোরে বিষ্ণুপুর শহরে চলে আসে।” তাঁর আশ্বাস, রাতে শহরে হুলা পার্টি মোতায়েন থাকছে। সকালে বাইপাস এলাকা ছাড়িয়ে হাতি দু’টি গোঁসাইপুর গ্রাম পেরিয়ে ঢোকে বেন্দা গ্রামে। সেখানে গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়ে দ্বারকেশ্বর নদের তীরে বাঁশ গাছ ঘেরা ধর্মরাজ ঠাকুরের চাতালে আশ্রয় নেয়। তাদের দেখতে পিলপিল করে লোকজন আসতে শুরু করে। সামাল দিতে পুলিশ আসে। হাতিদের তাড়ায় অনেকেই দৌড়তে গিয়ে কাদা জমিতে আছাড়া খান। তাতেও জনতার উৎসাহ কমেনি। হাতি-দর্শন বলে কথা!

ছবি: শুভ্র মিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

attack of elephant bishnupur swapan bandopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE