Advertisement
E-Paper

মঙ্গলায়ন, রেডি স্টেডি

এই মুহূর্তে আমরা ভারতীয়রা ইসরোর পাঠানো মঙ্গলায়ন-এর খবরে উদগ্রীব। তাই আমাদের ততটা আগ্রহ নেই নাসা-র খবরে। অথচ, মঙ্গলায়ন যখন লালগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের অপেক্ষায়, তখন তাকে অল্পের জন্য পিছনে ফেলে সেই কাজ সমাধা করল নাসা-প্রেরিত মহাকাশ যান ‘মাভেন’ (মার্স অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড ভোলেটাইল ইভলিউশন)। সোমবার ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টায় ওই মার্কিন মহাকাশযান ঢুকে পড়েছে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে। মঙ্গল, মঙ্গলায়ন নিয়ে কিছু অজানা কথা লিখছেন পথিক গুহ। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটে।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২১:৩৯
ইসোরোর সদর দফতরে চলছে শেষ মুহূর্তের পরীক্ষা। ছবি: এএফপি।

ইসোরোর সদর দফতরে চলছে শেষ মুহূর্তের পরীক্ষা। ছবি: এএফপি।

সংবাদ সতত স্থানীয়। এই মুহূর্তে আমরা ভারতীয়রা ইসরোর পাঠানো মঙ্গলায়ন-এর খবরে উদগ্রীব। তাই আমাদের ততটা আগ্রহ নেই নাসা-র খবরে। অথচ, মঙ্গলায়ন যখন লালগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের অপেক্ষায়, তখন তাকে অল্পের জন্য পিছনে ফেলে সেই কাজ সমাধা করল নাসা-প্রেরিত মহাকাশ যান ‘মাভেন’ (মার্স অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড ভোলেটাইল ইভলিউশন)। সোমবার ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টায় ওই মার্কিন মহাকাশযান ঢুকে পড়েছে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে। অর্থাৎ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের পাঠানো মহাকাশ যানের ৪৮ ঘণ্টা আগে একই কাজ করে ফেলল মার্কিন অনুসন্ধানী যান।

যাত্রাপথে দশ মাস সময় নিয়েছে ‘মাভেন’। সেখানে মঙ্গলায়নের সময় লাগল সাড়ে দশ মাস। নাসা কিংবা ইসরো, দুইয়েরই অনুসন্ধিৎসা মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডল ঘিরে। শক্তিশালী যন্ত্রে ওই গ্রহের বাতাবরণের উপাদান বিশ্লিষ্ট হবে। অনেক কিছুর মধ্যে খুঁজে দেখা হবে সেই উপাদানে রয়েছে কি না মিথেন গ্যাসের চিহ্ন।

কেন মিথেন?

ওই গ্যাসটি জৈবিক ক্রিয়ার পরিণাম হিসেবে চিহ্নিত। নানা ভাবে অনুসন্ধানে বহুকাল ধরে খোঁজা হয়েছে মঙ্গলের আকাশে মিথেনের চিহ্ন। পাওয়া যায়নি কিছুই। তবুও আশা, নতুনতর সন্ধানে যদি মেলে ওই গ্যাসের খোঁজ। সুতরাং, ‘মাভেন’ কিংবা মঙ্গলায়ন, বিজ্ঞানী ভারতীয় হোন বা আমেরিকান, তাঁদের অনুসন্ধানে মঙ্গলে প্রাণের খোঁজ এক বড় দায়।

খুব দূরে নয় বলে মঙ্গলগ্রহের দিকে খালি চোখেও মানুষের তাকানোর অভ্যেস বহু পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে মিশরীর পণ্ডিতেরা ওই গ্রহের দিকে তাকিয়ে নানা রকম ধারণা করেছিলেন। ব্যাবিলনের বিশেষজ্ঞেরা তো ওই গ্রহের চলনের নিয়মকানুন দেখে গাণিতিক ফর্মুলাও উদ্ভাবন করে ফেলেছিলেন। দূরবিনে প্রথম মঙ্গল দেখা ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে। কৃতিত্বের দাবিদার গ্যালিলেও গ্যালিলেই।

উনবিংশ শতাব্দীতে দূরবিনের প্রভূত উন্নতি এবং লালগ্রহ সম্পর্কে কৌতূহলের জোয়ার। সে জোয়ারে যতটা না বিজ্ঞান, তার চেয়ে ঢের বেশি ভাবাবেগ। না হলে ১৮৭৭ সালে ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গিওভান্নি সিয়াপারেলি মঙ্গলের বুকে আবিষ্কার করে বসেন কৃত্রিম নালা। তা নাকি কেটেছে মঙ্গলের জীবেরা, জলসেচ করে ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লাওয়েল লিখলেন তিনখানি বই। ‘মার্স’ (১৮৯৫), ‘মার্স অ্যান্ড ক্যানালস’ (১৯০৬) এবং ‘মার্স অ্যাজ দি অ্যাবোড অফ লাইফ’ (১৯০৮)। বলাবাহুল্য, সব বইতেই মঙ্গলগ্রহের ইটি-দের সভ্যতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা। জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্থিরনিশ্চিত যে মঙ্গলে প্রাণের বসবাস আছেই।

অগস্ট ১৯২৪। লালগ্রহ পৃথিবীর কাছাকাছি। ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে মঙ্গল অনুসন্ধানের তোড়জোড়। রীতিমতো ঘটা করে তিন দিন ধরে বন্ধ রাখা হল সরকারি, বেসরকারি বেতার যোগাযোগ। পাছে ও সবের ভিড়ে হারিয়ে না যায় মঙ্গলের জীবেদের পাঠানো বেতার সঙ্কেত। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রধান রেডিও অপারেটর যন্ত্রপাতি সাজিয়ে তৈরি থাকলেন লালগ্রহ থেকে পাঠানো সঙ্কেত বিশ্লেষণের কাজে। তিনি যদিও পেলেন না কিছু, ব্রিটিশ এবং কানাডীয় রেডিও অপারেটররা কিন্তু দাবি করলেন যে, তাঁরা শনাক্ত করেছেন লালগ্রহ থেকে পাঠানো বিচিত্র রেডিও ‘বিপ’। আল্পস পর্বতের বরফে আলো প্রতিফলিত করে অভিবাদন-সঙ্কেত পাঠানো হল মঙ্গলের জীবেদের উদ্দেশে।

এর পর এইচ জি ওয়েলস-রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ‘ওয়্যর অফ দি ওয়াল্ডর্স’। এক গ্রহ বনাম অন্য গ্রহের জীবেদের যুদ্ধ। রেডিওতে সে কাহিনি-নির্ভর নাটক প্রচারে অভিনেতা অরসন ওয়েলস। বেতারে নাটক প্রচারে সূচনা বাক্য: “দ্য মার্সিয়ানস হ্যাভ ল্যান্ডেড।’’ মানুষ ভাবল বুঝি সত্যি সত্যি পৃথিবীর বুকে নেমেছে মঙ্গলের জীব। ধ্বংস সমাসন্ন। কয়েক মিনিট আমেরিকা জুড়ে প্রবল আতঙ্ক।

ভিনগ্রহে প্রাণের ভাবনায় মঙ্গলের উল্লেখ কাল্পনিক হলেও, এর মূলে বিজ্ঞানের ছোঁয়াটুকু এড়ানো যায় না। কারণ? পৃথিবী গ্রহের সঙ্গে তার সাদৃশ্য। পৃথিবীর মতোই মঙ্গলের ভূমি কঠিন। ওই গ্রহের দিন-রাতও পৃথিবীর কাছাকাছি, সময়ের হিসেবে মাত্র আধ ঘণ্টা বেশি। নিজস্ব অক্ষের চার দিকে দু’টি গ্রহই ঘোরে প্রায় একই রকম বেগে। দুই গ্রহই নিজস্ব অক্ষের সঙ্গে একই রকম ভাবে কাত হয়ে আছে। পৃথিবী যেখানে আছে ২৩.৫ ডিগ্রি কাত হয়ে, মঙ্গল সেখানে ২৫ ডিগ্রি। ফলাফল দুই গ্রহের ঋতুচক্র প্রায় কাছাকাছি।

মঙ্গলের কক্ষপথ পৃথিবীর তুলনায় সূর্য্য থেকে দূরে, তাই মঙ্গলের বছর ঘুরতে লাগে পৃথিবীর হিসেবে ৬৮৭ দিন। অবশ্য মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম। আর পৃথিবীর মতো মঙ্গলের বাতাবরণে নেই কোনও ওজন-চাদর যা বিধ্বংসী অতিবেগুলি রশ্মি থেকে বাঁচাতে পারে লালগ্রহের প্রাণীকে। তা হোক, সে তো এখনকার ব্যাপার, অতীতে ওই গ্রহে পরিস্থিতি ছিল কি প্রাণ-সহায়ক? যদি লক্ষ্যকোটি বছরে বদলায় ওই গ্রহের পরিস্থিতি, তবে তা আগে ছিল কেমন? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুব জরুরি।

ইদানিংকালে মঙ্গলে প্রাণ বিষয়ে ফলাও খবর প্রচারিত হয়েছিল ১৯৯৬-তে। সংবাদ শিরোনামে এসেছিল ‘এএলএইচ ৮৪০০১’ নামে এক উল্কাপিণ্ড যা পাওয়া গিয়েছিল আন্টার্কটিকায় ১৯৮৪-র ২৭ ডিসেম্বর। ওই উল্কাপিণ্ডে মঙ্গলে ব্যাক্টেরিয়া জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্ম রয়েছে এমন দাবি করেছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। দাবি পেশ করা হয়েছিল বিজ্ঞানের জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। এ বাবদে দুনিয়াকে সংবাদ পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন স্বয়ং। নাসার তরফে এ হেন দাবি এবং ক্লিন্টনের ঘোষণা, দু’য়ে মিলে পৃথিবীতে শোরগোল পড়েছিল। মঙ্গলে প্রাচীন ‘প্রাণ’-এর ওই চিহ্ন আন্টার্কটিকায় এল কী ভাবে? তত্ত্ব এই ছিল যে, প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের বুকে আছড়ে পড়ে এক ধূমকেতু। তার ধাক্কায় মঙ্গলের বুকে তৈরি হয়েছিল গভীর খাদ। এবং শূন্যে উৎক্ষিপ্ত লালগ্রহের এক খণ্ড। সেই খণ্ড চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঘুরতে থাকে মহাশূন্যে। তার পর এক সময় তারই কিছু আকৃষ্ট হয় পৃথিবীর অভিকর্ষে। যারা উল্কাপিণ্ড হিসেবে ঝরে পড়েছিল পৃথিবীর নানা জায়গায়। তা পড়ুক, কিন্তু ‘এএলএইচ ৮৪০০১’ যে মঙ্গলের একদা-বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়ার জীবাশ্ম নয়, তা প্রমাণ হতে বেশি দেরি হয়নি। নিন্দুকেরা এমন অভিযোগও করে থাকেন যে, নাসার তরফে ওই ‘আবিষ্কার’ ঘিরে বড় বেশি ঢাকঢোল পোটানো হয়েছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে। আর্থিক অনুদান কমে যাওয়ায় নাসার তখন দীন দশা। চমকপ্রদ খবর দিয়ে সরকারি নজরকাড়া নাকি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে।

মঙ্গলের উদ্দেশ্যে মহাকাশযান পাঠানো আধুনিক মহাকাশচর্চায় খুবই প্রচলিত এক উদ্যোগ। এ ব্যাপারে সাফল্য কিংবা অসাফল্যের প্রসঙ্গ এলে গবেষকেরা স্মরণ করেন ‘মার্স ক্লাইমেট অরবিটার’ যানের কথা। ১৯৯৮-এর ১১ ডিসেম্বর নাসা পাঠিয়েছিল ওই যান। ওটির উদ্দেশ্য ছিল ‘মাভেন’ বা মঙ্গলায়নের মতোই লালগ্রহের বাতাবরণের বিশ্লেষণ। ১৯৯৯-এর ২৩ সেপ্টেম্বর ওই গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছেছিল ‘মার্স ক্লাইমেট অরবিটার’। কিন্তু লালগ্রহকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়েই বিপত্তি। সে একই সঙ্গে হাস্যকর এবং দুঃখজনক বৃত্তান্ত। মহাকাশযানটির সঙ্কেত প্রেরণকারী যন্ত্র তৈরি করেছিল এক বেসরকারি সংস্থা। যন্ত্রে দূরত্বের হিসেবকিতেবের জন্য সংস্থাটি একক হিসেবে ‘মাইল’ ব্যবহার করেছিল। আর নাসা দূরত্বের হিসেব করে ‘কিলোমিটার’-এ। দুই এককে ফারাক বিস্তর। যেমন, ৬০ মাইল হল ১০০ কিলোমিটার। সুতরাং, ‘মার্স ক্লাইমেট অরবিটার’-এর পাঠানো তথ্য আর নাসার বিজ্ঞানীদের তা বোঝায় ফারাক। এবং মহাকাশ যানের লালগ্রহকে প্রদক্ষিণের বদলে তার মাটি লক্ষ করে ঝাঁপ। সাড়ে বারো কোটি ডলার জলে।

আবার ২৩ সেপ্টেম্বর। এ বার ও রকম ‘তুচ্ছ’ অথচ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভুলের আশঙ্কা নেই।

pathik guha mars orbitor isro mangalyan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy