Advertisement
E-Paper

সবার জন্য বাঁচাই জীবন ‘সিস্টারের’

চিত্তরঞ্জনের কল্যাণগ্রামের মেয়ে সায়ন্তীদেবী ২০১৩ সাল থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:১৫
সায়ন্তী ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র

সায়ন্তী ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র

তাঁর শরীর জুড়ে রেললাইনের মতো আঁকিবুঁকি। পাঁচ বছর আগে ডানকুনির কাছে চলন্ত ট্রেন থেকে এই রেললাইনেই পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিকটজনেরাও আশা করেননি বেঁচে ফিরবেন ঘরের মেয়ে। কিন্তু শরীরের জোর হারালেও মনের জোরে তিনি জিতেছেন সে লড়াই। দেবীপক্ষে বর্ধমান মেডিক্যালের নার্সিং কলেজের ‘হস্টেল সিস্টার’ সায়ন্তী ভট্টাচার্যের প্রার্থনা, নকল হাত-পা নিয়েই আর্তদের সেবা করে যাবেন তিনি।

এখন আফতাব অ্যাভিনিউয়ের ওই হস্টেলে হবু নার্সদের দেখাশোনা করেন তিনি। আবাসনের সমস্ত প্রশাসনিক ভার সামলান। খাওয়া-দাওয়ার তদারকি থেকে রাতবিরেতে অসুস্থ হয়ে পড়া আবাসিক, কর্মীদের দেখতে ছুটে হুইলচেয়ারে ভর করেই। দায়িত্বের বাইরেও তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে হাত বাড়িয়ে দেন। কারও জামা, কারও বই— পাশে থাকেন ‘সিস্টার দিদি’।

চিত্তরঞ্জনের কল্যাণগ্রামের মেয়ে সায়ন্তীদেবী ২০১৩ সাল থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই বছরেরই ১৫ নভেম্বর স্নাতকস্তরের মার্কশিট আনতে কলকাতা যাওয়ার সময় ট্রেন থেকে পড়ে যান তিনি। চার দিন জ্ঞান ছিল না। যে দিন চোখ খোলে সে দিন বোঝেন দুটো পা, বাঁ হাতের কনুই থেকে নীচের অংশ আর নেই। এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল যে হিমগ্লোবিন দাঁড়িয়েছিল ২.৪। রক্তচাপও ছিল না। ডাক্তারেরাও প্রায় জবাব দিয়েছিলেন, বাঁচবেন না সায়ন্তী। পরে ৫০টির বেশি সেলাই, একের পর এক অস্ত্রোপচারে নকল হাত-পা বসানো হয় শরীরে। ‘হেমারেজিক শক’ থেকে ধীরে ধীরে ফিরে আসেন সায়ন্তী। গত তিন বছর ধরে কারও সাহায্য ছাড়াই হুইলচেয়ারে হস্টেলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছোটেন তিনি।

সায়ন্তীদেবী জানান, বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে নার্সিংয়ে স্নাতকোত্তর করবে। প্রবেশিকা পরীক্ষার মেধা তালিকায় নামও উঠেছিল। কিন্তু ৯৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী হওয়ায় পড়ার সুযোগ পাননি তিনি। তিনি জানান, অভাব ছিল না। টাকাপয়সা, সাহস সব জুগিয়েছেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু কাজ না করে ঘরে বসে থাকা মানতে পারেননি তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘একটা সময় ভয় লাগত, আর কাজ করতে পারব না। কিন্তু প্রচুর মানুষের ভালবাসা, শক্তি, ভরসা আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। একটা কাজের মাধ্যমেই পরের কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।’’

ওই হস্টেলের আবাসিকেরা জানান, সায়ন্তীদেবী দায়িত্ব নেওয়ার পরে নিয়মানুবর্তিতা ফিরেছে। নিরাপত্তার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। জঙ্গল সাফ করে বাগান তৈরি হয়েছে। তাঁর সহকর্মী শ্রাবণী মণ্ডল, উমা দত্তরাও বলেন, “সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হস্টেল নিয়েই পড়ে থাকেন উনি। পুজোতেও বাড়ি যাবেন না।’’ কেন? সায়ন্তীদেবী বলেন, ‘‘আমার পুজো ঘরেই। গান শুনি, লেখালেখি করি। মণ্ডপে গিয়ে কাউকে বিব্রত করতে চাই না।’’

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা বলেন, “কঠিন লড়াইয়ে না গিয়ে সায়ন্তীদেবী বাড়িতেই থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি নার্সিংয়ের কাজ ভালবাসেন। সেই টানেই ফিরে এসেছেন। আমরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’’

আর সায়ন্তীদেবী বলেন, ‘‘আমার মতো পরিস্থিতি কারও হলে তাঁকে যা বলতাম, সেটাই নিজেকে বলেছি। আর ভেবেছি, যে জীবন ফিরে পেয়েছি, তা শুধু নিজের জন্য নয়। সবার জন্য বাঁচাটাই জীবন।’’

Burdwan Nurse Artificial Limb
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy