Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘মি টু’ এবং তারও অনেক আগে

গোদা ভাবে বলতে গেলে নারীদের মাথা পিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এখনও পুরুষদের চেয়ে কম। নারীদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা পুরুষদের উপরে অত্যাচারের তুলনায় বেশি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবেশ মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০১:৪৯
Share: Save:

বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। অথচ, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নারীর অবস্থান যেন কিছুতেই পুরুষের তুল্য হয়ে ওঠে না। আজ, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, বিভিন্ন ক্ষেত্রে (বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক) নারীদের সাফল্য উদ‌্‌যাপনের দিন। অথচ, এই দিনটিতেও লিঙ্গবৈষম্য মেটানোর আহ্বান রাখতে হয়!
কেন?
গোদা ভাবে বলতে গেলে নারীদের মাথা পিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এখনও পুরুষদের চেয়ে কম। নারীদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা পুরুষদের উপরে অত্যাচারের তুলনায় বেশি। আর পুরুষ এবং নারীর পারিশ্রমিকে ফারাকও চোখে পড়ার মতো। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’-এর ২০১৭ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে নারী এবং পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য ঘুচতে আরও একশো বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।
অথচ, বৈষম্য ঘোচানোর লড়াই কিন্তু শুরু হয়েছে অনেক আগে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে সনাতন রাজতন্ত্রের অবসান হলে, সে দেশের জনতা ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন’ (১৭৮৯) তথা স্বাধীনতার সনদ তৈরি করে। কিন্তু তাতে নারীদের দাবিদাওয়ার কোনও উল্লেখ ছিল না। তারই পাল্টা হিসেবে ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান অ্যান্ড ফিমেল সিটিজেন’ (১৭৯১) তৈরি করেন মহিলা সমাজকর্মী, নাট্যকার ওলাঁপ দ্য গুজ। কিন্তু তা প্রকাশ্যে আসতেই রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে তাঁকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়।
ওলাঁপ তাঁর লেখা শুরু করেছিলেন এ ভাবে— ‘পুরুষ, তুমি কি ন্যায় করতে পার? এক নারী জানতে চায়: সেটুকু সুযোগ নিশ্চয় দেবে?’ (Man, are you capable of being fair? A woman is asking: at least you will allow her that right)। তাঁর অনুপ্রেরণায় ইংল্যান্ডে নারীদের দাবিদাওয়া সম্বন্ধে সচেতন মহিলাদের অন্যতম ছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট। ‘এ ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান’ (১৭৯২)-এ মেরি বোঝাতে চেষ্টা করেন, নারী স্থাবর সম্পত্তি নয়। মানুষ। পুরুষের মতো একই মৌলিক অধিকার তারও প্রাপ্য।
সে সময়ের ইংল্যান্ডে এই দাবিদাওয়া প্রকাশ্যে আনার প্রয়োজন ছিল। কারণ, সে দেশে তখন মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারতেন না। কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে অথবা কোন রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেওয়ার অধিকারও ছিল না। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হত না তাঁদের। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল নানা বাঁধন। নারীরা সম্পত্তির অধিকারী হতে, ব্যবসায় যুক্ত থাকতে, নিজেদের নামে ঋণ নিতে পারতেন না। আইনের দৃষ্টিতে তাঁরা ছিলেন নিম্নমানের সাক্ষী। বিবাহ বিচ্ছেদ করার অধিকার তখনও তাঁরা পাননি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল বৈষম্য। প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডী পেরনো ছিল নারীর জন্য নিষিদ্ধ।
এই বি-সম পরিস্থিতিতে ইওরোপের নারীরা সমতার লক্ষ্যে তাঁদের আন্দোলন অক্লান্ত ভাবে চালিয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁদের এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং তা ইউরোপের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। লিঙ্গসমতার অনুপ্রেরণা জোরদার ভাবে এসেছে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেখানে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক গৃহীত ‘Declaration of Universal Human Rights’ অর্থাৎ, বিশ্বজনীন মানবাধিকারের সনদ। এই সনদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংযোজন হল ‘CEDAW’ (CONVENTION FOR THE ELIMINATION OF DISCRIMINATION AGAINST WOMEN) তথা নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত সমঝোতা।
একটু একটু করে পৃথিবীতে নারী আন্দোলন গতি পায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৭৫ ‘নারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-১৯৮৫ সাল ‘নারীদশক’ রূপে পালিত হয়। ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের (‌‌বেইজিং) কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। নারী সশক্তিকরণ এবং লিঙ্গবৈষম্য ঘোচানোর লক্ষ্যে সেখানে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যা বিশ্বের ১৮৯টি দেশ মানার অঙ্গীকার করে। অথচ, তার পরেও অন্ধকার পুরোপুরি ঘুচেছে, তা বলা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি হলিউডের এক প্রযোজকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের দৌলতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছে, যৌন-হেনস্থার প্রতিবাদী আন্দোলন ‘মি টু’। প্রতিবাদীদের সামনের সারিতে রয়েছেন অনেক যশস্বী মহিলা। তাঁদের প্রতিবাদী স্বর মনে করিয়ে দিচ্ছে, লিঙ্গ-সাম্য আসতে এখনও বহু দূর যেতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল না হলে এ লড়াই থামানো অর্থহীন।

লেখক শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE