কুর্নিশ: টুপি খুলে ভারত অধিনায়ক কোহালির অভিবাদন শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার ঘাতক যশপ্রীত বুমরাকে। টুইটার
বিরাট কোহালি বনাম অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট জনতার লড়াই যেন থামার লক্ষণ নেই। সেই ২০১২-তে আক্রমণাত্মক ভারতীয় ব্যাটসম্যানের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফর থেকেই চলছে!
অ্যাডিলেডে ব্যাট করতে নামার সময় ভারত অধিনায়ককে ধিক্কার ধ্বনি শুনতে হয়েছিল। শুক্রবার মেলবোর্নের গ্যালারির একাংশ থেকে আরও খারাপ মন্তব্য ভেসে এল। যা নিয়ে কোহালি নিজে মেজাজ না হারালেও ভারতীয় শিবির অধিনায়কের প্রতি এই অপমানজনক মন্তব্য নিয়ে ফুঁসছে। শেষ ইনিংসে বাইশ গজেই জবাব দিতে চান সবাই।
ভারতীয় দল ফিল্ডিং করার সময় অপ্রীতিকর এই ঘটনা ঘটে। এমসিজি গ্যালারির খুব কুখ্যাত অংশ হচ্ছে ‘বে ১৩’। সফররত মহাতারকাদের উদ্দেশে নানা সময়ে এই গ্যালারি থেকেই আপত্তিজনক মম্তব্য ভেসে আসার ঘটনা রয়েছে। এমনকি, স্যর রিচার্ড হ্যাডলিকেও এরা ছাড়েনি। ভারতীয় দল ফিল্ডিং করার সময়ে এই গ্যালারি থেকেই কোহালিকে উদ্দেশ্য করে অপমানজনক মন্তব্য ভেসে আসে। যে কথাটি তাঁর উদ্দেশে বলা হয়েছে, তা ছাপার অযোগ্য। তবে কিশোর বয়সের ছেলেদের কুঅভ্যাসের সঙ্গে জড়িত। একই মন্তব্য করে অবমাননা করা হয়েছিল হ্যাডলির মতো কিংবদন্তিকেও।
কোহালি ফিল্ডিং করতে করতেই শুনতে পান, তাঁর নাম করে কী বলা হচ্ছে। কিন্তু একেবারেই উত্তেজিত হননি বা নিয়ন্ত্রণ হারাননি। উল্টে টুপি খুলে গ্যালারির দিকে অভিবাদন নেওয়ার ভঙ্গি করেন। তাঁর এই প্রতিক্রিয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে অনেকে প্রশংসা করেছেন। তেমনই নিন্দিত হচ্ছে মেলবোর্নের কুখ্যাত গ্যালারির আচরণ। এমনকি, অনেক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরাও প্রথম তিন দিনে বার বার শুনেছেন, ভারতীয় দল বা ভারতীয় সমর্থকদের উদ্দেশে নানা কটূ মন্তব্য গ্যালারি থেকে করা হয়েছে। বিশেষ করে কোহালির প্রতি অসম্মানজনক উক্তিতে তাঁরা অনেকেই ক্ষুব্ধ।
আরও পড়ুন: এক্সপ্রেস গতি ও সুইংয়েই বাজিমাত
তাঁদের অধিনায়কের প্রতি যে অবমাননাকর ধ্বনি ভেসে আসছে গ্যালারি থেকে, সেটা মাঠে দাঁড়িয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারেরাও বুঝতে পারেন। তা শুনে যশপ্রীত বুমরাদের বলের গতি আরও বেড়ে গিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার নেই। দলের বাকিরাও জানেন, কী বলা হচ্ছে। কেউ ভাল ভাবে নেননি। কারও কারও আশঙ্কা, চতুর্থ দিনে তীব্র সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভারতীয় দল থেকে কেউ না অস্ট্রেলীয় দর্শকদের এই অভব্য আচরণের জেরে উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেন।
আরও পড়ুন: পূজারাদের মতো ব্যাটিং চান কামিন্স
এমসিজির একই স্ট্যান্ড থেকে ভারতীয় দল এবং ভারতীয় সমর্থকদের প্রতি বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য করারও অভিযোগ উঠেছে। বার বার সুর করে বলা হয়েছে, ‘তোমার ভিসা দেখাও, তোমার ভিসা দেখাও।’ যে কোনও খেলায় প্রত্যেকটি মাঠে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য নিয়ে তীব্র কড়াকড়ি থাকে। বার বার এ নিয়ে খেলা চলাকালীন মাইকে ঘোষণা করা হয়। তার পরেও কথা না শুনলে সেই মাঠকে সাসপেন্ডও করা হতে পারে। দর্শকেরা যে টিকিট কেনেন, তার পিছনেও অঙ্গীকারমূলক ঘোষণা দেওয়া থাকে: ‘‘বর্ণবৈষম্যমূলক কোনও মন্তব্য আমি করব না। এমন কোনও আচরণ করব না যা, কোনও খেলোয়াড়, দর্শক, আম্পায়ার বা ম্যাচ পরিচালকদের প্রতি অসম্মানজনক বা তাঁদের বর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয় বোধে আঘাত দিতে পারে।’’
এ দিন এমসিজি-র ‘বে ১৩’ স্ট্যান্ড থেকেও কয়েক জনকে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। গত দু’দিন ধরে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে এই স্ট্যান্ডে বেশি করে পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয়েছিল। তারাই এ দিন যথাযথ পদক্ষেপ করেছে। তার পরেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া থেকে সতর্কবার্তা জারি করে বলা হয়েছে, বর্ণবৈষম্যমূলক প্ররোচনা কেউ দিলে বা আপত্তিজনক মন্তব্য করা হলে পুরো স্ট্যান্ড খালি করে দিতেও দ্বিধা করবে না তারা। ভিক্টোরিয়া পুলিশ এবং স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকেও সতর্ক করা হয়েছে এবং নজর রাখতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে কুখ্যাত ওই গ্যালারির দিকে। শনিবার, চতুর্থ দিনেও বাড়াবাড়ি দেখলে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হবে।
এ দিকে, স্লেজিং নিয়েও উত্তেজনার পারদ ক্রমশ বাড়ছে। পার্থে কোহালির আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম। এই টেস্টে এখনও পর্যন্ত ভারত অধিনায়ককে কোনও স্লেজিং করতে শোনা যায়নি। কিন্তু একই রকম কিচিরমিচির চালিয়ে যাচ্ছেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেন। গত কাল রোহিত শর্মা যখন ব্যাট করছিলেন, স্টাম্পের পিছন থেকে বলেছেন, ‘‘রোহিত যদি ছয় মারে, আমি এখনই আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ভক্ত হয়ে যাব।’’ উদ্দেশ্য, তাঁকে তাতিয়ে ছক্কা মারায় প্রলুব্ধ করে আউট করা। তাঁর সেই মন্তব্য শুনে রোহিত মাঠের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। উল্টে ১১৪ বলে ৬৩ করে মুখের উপর যোগ্য জবাব দিয়ে যান। শোনা গেল, পরে মাঠ থেকে বেরিয়ে রোহিত সতীর্থদের বলেছেন, ‘‘ভেবেছিলাম পেনকে বলব, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের তোর মতো সমর্থক না পেলেও চলবে। আর আমি এমনিই ছক্কা মারি আইপিএলে, তোর পুরস্কার দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাব না ঠিক করে নিয়েছিলাম বলে মুখ খুলিনি।’’
আইপিএলে ক্রিস গেলের পরেই সব চেয়ে বেশি ছক্কা মারার রেকর্ড রোহিতের। তাই ভারতীয় শিবিরের কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘‘টিম পেন রান তো করতেই পারছে না। স্লেজিং করার আগে অন্তত হোমওয়ার্কটা সেরে আসুক।’’ অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র নন। এ দিন আবার তিনি ঋষভ পন্থকে টার্গেট করেন। ঋষভ ব্যাট করার সময়ে তাঁকে বলেন, ‘‘ধোনি তো ওয়ান ডে দলে চলে এল। তুমি এ বার বিগ ব্যাশে চলে এসো। হোবার্ট হ্যারিকেনসে তোমাকে নিয়ে নেব। আমাদের এক জন ব্যাটসম্যান দরকার।’’ এখানেই থামেননি তিনি। স্টাম্প মাইক্রোফোনে শোনা যায়, অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ভারতীয় উইকেটকিপারকে বলছেন, ‘‘তুমি কি বাচ্চাদের দেখাশুনো করতে পারো? আমি যদি স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাই, তুমি বাচ্চাদের দেখতে পারবে?’’
পেনের এই শেষ উক্তিটি খুব ভাল ভাবে না-ও নিতে পারে ভারতীয় শিবির। পার্থে কোহালির সঙ্গে তীব্র বাগ্যুদ্ধে জড়িয়েছেন পেন। কিন্তু দুই অধিনায়কই ম্যাচের পরে এসে বলেছেন, কেউ সীমানা অতিক্রম করেননি। ঋষভ পন্থ নিজে প্রচুর কথা বলছেন অস্ট্রেলীয়রা ব্যাট করার সময়ে। কিন্তু ‘‘ক্যান ইউ বেবিসিট? আমার বাচ্চাদের সামলাতে পারবে তো?’’ জাতীয় মন্তব্য এই সিরিজে এর আগে হয়নি। ঋষভ যদিও হাসি মুখে সব শুনছিলেন এবং মনে হল না, খুব ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে নিয়েছেন।
তবু নানা ঘটনা নিয়ে পরিবেশ এমন উত্তপ্ত যে, লক্ষ্মণরেখা পার হব-হব করছে। মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে নিয়ে কেরি ও’কিফের করা রেলওয়েজ ক্যান্টিনের মন্তব্য প্রথম সুর কেটে দিয়েছিল। তার যোগ্য জবাব দিয়ে এসেছেন ভারতের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। সঙ্গে গ্যালারির একাংশের অভব্য আচরণ এবং অধিনায়কের অপমান। ধরেই নেওয়া যায়, অস্ট্রেলিয়া শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে এলে কথার ফোয়ারা ছুটবে ঋষভদের মুখেও। মেলবোর্নে এখনও অনেক নাটক বাকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy