Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

করোনা-ধাক্কায় সেই পিছোতেই হল অলিম্পিক্স

অলিম্পিক্সের ইতিহাসে বেনজির ভাবে পিছিয়ে গেল গেমস। এর আগে বিশ্বযুদ্ধের জন্য বার কয়েক বাতিল হয়ে গিয়েছিল এই ক্রীড়া মহাযজ্ঞ।

প্রতিবাদ: অলিম্পিক্স পিছনোর দাবি জাপানে। মঙ্গলবার। এএফপি

প্রতিবাদ: অলিম্পিক্স পিছনোর দাবি জাপানে। মঙ্গলবার। এএফপি

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২০ ০৫:৫৬
Share: Save:

২৪ মার্চ: করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পেল না অলিম্পিক্সও। এই বছর আর হবে না ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। চলতি বছরের ২৪ জুলাই থেকে নয়, এক বছর পিছিয়ে গিয়ে টোকিয়ো অলিম্পিক্স এখন হবে ২০২১ সালে। পাশাপাশি এক বছর পিছিয়ে যাচ্ছে প্যারালিম্পিক্সও। তবে এর পাশাপাশি একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সেটা হল, অলিম্পিক্স আদৌ হতে পারবে তো?

অলিম্পিক্সের ইতিহাসে বেনজির ভাবে পিছিয়ে গেল গেমস। এর আগে বিশ্বযুদ্ধের জন্য বার কয়েক বাতিল হয়ে গিয়েছিল এই ক্রীড়া মহাযজ্ঞ। কিন্তু এই ভাবে পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনা কখনও ঘটেনি। মঙ্গলবার আইওসি প্রধান টমাস বাখের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সের পরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জানিয়ে দিয়েছেন, বাতিল নয়, পরের বছর গ্রীষ্মে হবে অলিম্পিক্স।

এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত ক্রীড়া দুনিয়া। একের পর এক প্রতিযোগিতা হয় বাতিল হচ্ছে, না হয় পিছিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত আইওসি কর্তারা এবং জাপান সরকার ও টোকিয়ো অলিম্পিক কমিটির সদস্যরা জোর গলায় বলে চলেছিলেন, অলিম্পিক্স ঠিক সময়েই হবে, পিছিয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু গত ৭২ ঘণ্টায় ছবিটা ভীষণ ভাবে বদলে যায়। বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যত বাড়তে থাকে, অলিম্পিক্স পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তত জোরদার হতে থাকে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া তো সরেই দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাও প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এই চাপের মুখে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, অলিম্পিক্স পিছনো ছাড়া রাস্তা নেই সংগঠকদের। সেটাই হল।

এ দিন আইওসি প্রেসিডেন্ট টমাস বাখের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব দেন, অলিম্পিক্স এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার। পরে টোকিয়োয় সাংবাদিকদের জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে বলেন, ‘‘আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হোক অলিম্পিক্স। যে প্রস্তাবে একশো ভাগ সায় দেন প্রেসিডেন্ট বাখ।’’

গেমস-অঙ্ক: ১ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে জাপান

আয়োজনের খরচ

• গত ডিসেম্বরে সংগঠকেরা বলেছিলেন, সব মিলিয়ে গেমসের জন্য খরচ হবে ১.৩৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা)।
• এর মধ্যে জাপানের অলিম্পিক্স অর্গ্যানাইজিং কমিটি দিচ্ছে ৬০৩ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৪১,৩৪১ কোটি টাকা)। টোকিয়ো শহরের কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ৫৯৭ বিলিয়ন ইয়েন (৪০,৯৪০ কোটি টাকা)। জাপানের কেন্দ্রীয় সরকারের অবদান ১৫০ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ১০,২৬৬ কোটি টাকা)।
• এর বাইরেও ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৯৩ কোটি টাকা) অতিরিক্ত অর্থ রাখা হয়েছিল ম্যারাথন এবং হাঁটা প্রতিযোগিতা অন্যত্র সরানোর খরচ হিসেবে।

প্রভাব কী হতে পারে

• সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাপানের পর্যটন ব্যবসা। গত বছর জাপানে ৩১.৯ মিলিয়ন পর্যটক (তিন কোটি ১৯ লক্ষ) এসেছেন, যাঁরা ৪.৮১ ট্রিলিয়ন ইয়েন (৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা) খরচ করেছেন।
• মনে করা হচ্ছিল, টোকিয়ো অলিম্পিক্সকে কেন্দ্র করে বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭,৫৯৬ কোটি টাকা জমা পড়তে চলেছে জাপানের পর্যটন কোষাগারে।
• অলিম্পিক্সের প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন টিকিট (৪৫ লক্ষ) বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবারের ঘোষণার পরে পর্যটকেরা সে সবই বাতিল করতে না ছোটেন।

স্পনসরশিপ বাজার

• শুধু জাপানের স্থানীয় সংস্থার সঙ্গে চুক্তির দৌলতেই ২০২০ অলিম্পিক্সের স্পনসরশিপ মূল্য দাঁড়িয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২০,২৪০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে রেকর্ড।
• তা-ও এই অর্থের মধ্যে জাপানের বিখ্যাত গাড়ি সংস্থা বা অন্য দেশের জনপ্রিয় মোবাইল সংস্থার সঙ্গে বিশাল টাকার চুক্তি ধরা নেই। এই সব সংস্থাদের চুক্তি রয়েছে সরাসরি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আসে।
• অন্তত ৭২টি স্থানীয় সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে জাপান অলিম্পিক্সে। তাদের কী হবে?

বিমা সংস্থাদের উদ্বেগ

• অলিম্পিক্স না-হলে মাথায় হাত পড়বে বিমা সংস্থাদের। প্রত্যেকটি গেমসের জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থা (আইওসি) ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৫০৯ কোটি টাকার কাছাকাছি ‘কভারেজ’ রাখে। প্রত্যেকটি আয়োজক শহরে মোটা টাকা লগ্নি করে আইওসি। এর জন্য মোট অর্থের দুই বা তিন শতাংশ দিতে হয় আইওসি-কে। অর্থাৎ, টোকিয়ো অলিম্পিক্সের বরাদ্দ বিমা অর্থের জন্য তাদের খরচ হয়েছে হয়তো ভারতীয় মুদ্রায় ১৬৭ কোটি টাকা মতো।

সম্প্রচার চুক্তিতে ধাক্কা

• এনবিসি ইউনিভার্সাল ডিসেম্বরে ঘোষণা করেছিল, শুধু আমেরিকাতেই টিভি সম্প্রচারের জন্য তারা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৬৮৭৪ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিক্রি করে ফেলেছে। সব মিলিয়ে সেই অঙ্ক প্রায় ৮২৭৭ কোটি টাকার আশেপাশে হওয়ার কথা ছিল।
• আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে ছয় বছরের জন্য ডিসকভারি কমিউনিকেশনসের বিশাল চুক্তি হয়েছে। ছয় বছরে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৮০০ কোটি টাকা দিচ্ছে তারা।

কত টাকার ক্ষয়ক্ষতি

• টোকিয়ো অলিম্পিক্স যদি বাতিল করতে হয়, টিভি সম্প্রচার স্বত্ব থেকে কমপক্ষে ভারতীয় মুদ্রায় ১৮,৪৯৪ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
• এর সঙ্গে স্পনসরশিপ এবং বিমা থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরলে বেসরকারি সংস্থাদের জন্য ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৬,৩৪৭ কোটি টাকার ধাক্কা অনিবার্য।
• আপাতত শুধু পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনও কারণে যদি অলিম্পিক্স পুরোপুরি বাতিল হয়, জাপানের মোট ক্ষতি হতে পারে ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। প্রায় ৮৪,৫৪০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে অলিম্পিক্সের মোট খরচ বাবদ। প্রচুর টাকা খরচ করে নতুন স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে।
• জাপান পর্যটন বিভাগ হারাতে পারে ভারতীয় মুদ্রায় ১৪,৯৮০ কোটি টাকা। বিশাল আর্থিক ক্ষতির ভয়ে গেমস বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে।

সন্ধ্যায় টোকিয়ো সংগঠক কমিটি এবং আইওসির তরফে এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, এ দিন সকালে বাখ এবং প্রধানমন্ত্রী আবে একটি কনফারেন্স কলের মাধ্যমে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। যে কনফারেন্স কলে আরও ছিলেন সংগঠক কমিটির প্রেসিডেন্ট মোরি ইয়োশিরো, টোকিয়োর গভর্নর এবং গেমসের সঙ্গে জড়িত আরও অনেকে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ডিরেক্টর টেডরস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস এ দিন জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্ব জুড়ে তিন লক্ষ ৭৫ হাজার আক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় এই সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে। হু-র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং আইওসি প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নেন, অলিম্পিক্স পিছিয়ে দেওয়ার। ঠিক হয়, এ বছরে নয়, তবে পরের বছর গ্রীষ্ম শেষ হওয়ার আগেই হবে অলিম্পিক্স।’’ বিবৃতিতে এও জানানো হয়েছে, পরের বছর হলেও অলিম্পিক্স এবং প্যারালিম্পিক্সের নাম একই থাকছে। অর্থাৎ— ‘টোকিয়ো ২০২০ অলিম্পিক এবং প্যারালিম্পিক গেমস’। এও ঠিক হয়েছে, অলিম্পিক্সের ঐতিহ্যশীল শিখা জাপানেই থেকে যাবে।

তবে অলিম্পিক্স পিছিয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যা এ বার ভেসে উঠবে। অলিম্পিক্সের সঙ্গে জড়িত কেউ, কেউ বলেছেন, ‘‘চার বছর ধরে একজন অ্যাথলিট তৈরি হয় এই প্রতিযোগিতার জন্য। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন, সূর্য সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে উঠছে, তা হলে যে রকম মনোভাব হবে আপনাদের, অ্যাথলিটদের ক্ষেত্রেও অলিম্পিক্স পিছিয়ে যাওয়ার প্রভাবটা সে রকমই হবে।’’

কত দিন পিছিয়ে যাবে, নতুন সূচি কী হবে, তা ঠিক করতে এখন ঘুম ছুটে যাবে সংগঠকদের। ২০২১ সালের ক্রীড়াসূচি ইতিমধ্যেই ঠিক হয়ে আছে। তার মধ্যে অলিম্পিক্সের জায়গা বার করা রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। তবে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স সংস্থা বলেছে, তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অগস্টে পিছিয়ে নিয়ে যাবে। যেটা খানিকটা স্বস্তি দেবে অলিম্পিক্সের সংগঠকদের। কিন্তু অলিম্পিক্সের জন্য কতগুলো স্টেডিয়াম পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় থাকবে। পাশাপাশি হোটেল থেকে শুরু করে গেমস ভিলেজ তৈরি করা নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে বলে অনেকে মনে করছেন।

অলিম্পিক্স পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ফিফাও। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থার তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ফিফা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে, ক্রীড়াবিদদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা সবার আগে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যে কারণে আমরা আইওসি-র এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।’’ ফিফা এও জানিয়েছে, অলিম্পিক্সের সূচি কী ভাবে নতুন করে তৈরি করা যায়, সে ব্যাপারে তারা সংশ্লিষ্ট সংগঠনদের সঙ্গে আলোচনা চালাবে।

সব মিলিয়ে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে আইওসি এবং টোকিয়ো অলিম্পিক সংস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Tokyo Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE