Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lalthuammawia Ralte

একদিন ফুটবল খেলার মতো জুতোও ছিল না, আজ তিনিই ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার

তিনি ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের শেষপ্রহরী। লাল-হলুদ ভক্তদের অন্যতম ভরসা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন একদিন ইস্টবেঙ্গলে খেলবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে কথোপকথনে সেই যাত্রাপথই তুলে ধরলেন কোয়েস ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার লালথুয়ামমাওয়াইয়া রালতে। তিনি ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের শেষপ্রহরী। লাল-হলুদ ভক্তদের অন্যতম ভরসা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন একদিন ইস্টবেঙ্গলে খেলবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে কথোপকথনে সেই যাত্রাপথই তুলে ধরলেন কোয়েস ইস্টবেঙ্গলের গোলকিপার লালথুয়ামমাওয়াইয়া রালতে।

ইস্টবেঙ্গলের শেষপ্রহরী রালতে।

ইস্টবেঙ্গলের শেষপ্রহরী রালতে।

ঋষভ রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:২০
Share: Save:

আপনার কাছে দিল্লি ডায়নামোজ-সহ একাধিক ক্লাবে খেলার প্রস্তাব ছিল। কোয়েস ইস্টবেঙ্গলে সই করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

ইস্টবেঙ্গল মানেই ঐতিহ্য। লিগ্যাসি ক্লাব এবং আবেগপ্রবণ সমর্থকদের জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ইস্টবেঙ্গল এক পরিচিত নাম। সমর্থকরাই ক্লাবের সম্পদ। তাঁদের স্পিরিটটাই যেন চালিকাশক্তি। কলকাতা ফুটবলের সুনাম রয়েছে। অসংখ্য ফ্যান ফলোয়ার। ফুটবলের প্রতি তাঁদের ভালবাসার অন্ত নেই। সেই ছোটবেলা থেকে কলকাতার ফুটবল আর ইস্টবেঙ্গলের কত যে গল্প শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। মিজোরামের প্রতিটি ঘরে ইস্টবেঙ্গল এখন এক পরিচিত নাম। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। লাল-হলুদ জার্সি চাপিয়ে মিজোরামের একাধিক ফুটবলার খেলেছে ইস্টবেঙ্গলে। সাইলো মামা (তুলুঙ্গা) দাপটের সঙ্গে খেলেছে এই ক্লাবে। তুলুঙ্গার জন্যই ভারতের ফুটবল মানচিত্রে উঠে আসে মিজোরাম। আমরা যখন বড় হয়ে উঠছি, তখন থেকেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। সেই সময় থেকেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সামনে খেলার স্বপ্ন দেখতাম। আমার স্বপ্ন এখন পূরণ হয়েছে। ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাব একজন ফুটবলারের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। এই ক্লাবে খেলে আমি গর্বিত।

ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কবে নিলেন?

ফুটবল আমার আবেগ। আমার ভালোবাসা। মিজোরামে থাকতে আর পাঁচটা ছেলের মতোই রাস্তায় ফুটবল নিয়ে নেমে পড়তাম। তখন ফুটবল খেলার মতো ভাল জুতোও ছিল না আমার পায়ে। ফুটবলের টানেই নেমে পড়তাম। সিনিয়রদের বিরুদ্ধে খেলতে খেলতে অনেক কিছু শিখি। মিজোরামের বয়সভিত্তিক (অনূর্ধ্ব ১৬, ১৭ এবং ২৩) দলের হয়ে আমি খেলেছি। আর সেই সব দলের হয়ে ভাল খেলার ফলে উপলব্ধি করেছিলাম, পেশা হিসেবে ফুটবলকে আমি এ বার গ্রহণ করতেই পারি। শিলং লাজং এফসি আমার প্রথম পেশাদার ক্লাব।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফুটবলারদের শরীরের ভরকেন্দ্র নীচুতে হওয়ায় বলের উপরে নিয়ন্ত্রণ ভাল হয়, গতি হয় চোখধাঁধানো। অন্য পজিশনে না খেলে আপনি গোলরক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

ছোটবেলা থেকেই আমার উচ্চতা অন্য সতীর্থদের থেকে বেশিই ছিল। সেই কারণে মিজোরামের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে এবং স্কুল গেমসে গোলরক্ষক হিসাবেই নামাতেন আমাদের স্কুল টিচার। গোলকিপার হিসেবে খেলতে আমার বেশ ভালই লাগত। গোলকিপার হিসেবে উন্নতি করার জন্য আমি কঠিন পরিশ্রম করেছি। ধীরে ধীরে গোলকিপিংয়ের সমস্ত স্কিল রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। কঠিন অধ্যবসায় ও পরিশ্রম আমাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।

স্বপ্ন সফল রালতের।

আধুনিক ফুটবলে যে কোনও দলের আক্রমণ তৈরি হয় গোলকিপারের পা থেকেই। এই আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে আপনি নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন?

ফুটবল শেখার সময় থেকেই গোলকিপিংয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ফুটওয়ার্কের উন্নতি ঘটানোরও চেষ্টা করতাম। গোলকিপার শুধু বিপক্ষের পা থেকে বল তুলে নেবে, তা তো হতে পারে না। আধুনিক ফুটবলে এক জন গোলকিপার নিজের দলের হয়ে আক্রমণও শুরু করে। এরকম এক জন গোলকিপার পিছনে থাকলে ডিফেন্সও খেলা তৈরি করার অতিরিক্ত অপশন পেয়ে যায়। শিলং লাজং, বেঙ্গালুরু এফসি এবং এফসি গোয়ার জার্সিতে আমি এ ভাবেই খেলার চেষ্টা করে গিয়েছি। আমাদের কোচ আলেয়ান্দ্রো স্যরের দৃষ্টিভঙ্গিও একই রকম। আগের ক্লাবগুলোয় ঠিক যে ভাবে আমি খেলেছি, আলেয়ান্দ্রোও একই ভাবে খেলাচ্ছেন। আমার দক্ষতা যে দলকে সাহায্য করছে, তাতেই আমি খুশি।

গত তিন-চার বছর ধরে ইস্টবেঙ্গল হাইলাইন ডিফেন্স খেলছিল। তবে বছর দুয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে, সে ভাবে আর খেলছে না লাল-হলুদ শিবির। গোলকিপার হিসেবে কোন সিস্টেমে আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?

ফুটবলার হিসাবে সব ধরনের সিস্টেমেই খেলতে জানতে হয়। নির্দিষ্ট কোনও একটা সিস্টেমের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব নেই। কী ভাবে খেলতে হবে, কোন সিস্টেমে দল খেলবে, তা তো স্থির করেন কোচ। কোচের কথামতোই আমরা ট্রেনিং করি। এক জন ফুটবলার হিসেবে সমস্ত সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় একজন ফুটবলারকে। ছোটখাটো পরিবর্তনের সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এর ফলে একজন ফুটবলারই আসলে উপকৃত হয়। আমি ফুটবলের এক জন ভাল ছাত্র। সব সময়ে শিখতে পছন্দ করি। কোচ এবং সতীর্থদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

লাল-হলুদ জনতার নয়নের মণি রালতে।

বহুদিন ধরে ইস্টবেঙ্গলের আই লিগ জেতার স্বপ্ন অধরা রয়েছে? আপনার কি মনে হয় সেই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান আপনারাই ঘটাতে পারবেন?

আমরা প্রতিদিন কঠিন অনুশীলন করছি। একটা কথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। প্র্যাকটিস মেকস আ ম্যান পারফেক্ট। সেই মতোই প্রতিদিনের প্র্যাকটিসে ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি। শুধু আমি নই, গোটা দলই আগের ম্যাচের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। পরের ম্যাচে সেই ভুল যেন না হয়, সে দিকে আমাদের সবার নজর থাকে। দল হিসেবে আমরা বেশ ভাল। টেকনিক্যাল স্টাফরাও দুর্দান্ত। ডুরান্ড কাপের ম্যাচগুলোয় আমরা বেশ ভাল খেলেছি। কলকাতা ফুটবল লিগে বেশ ভাল জায়গায় রয়েছি। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ খুব ভাল। আশা করি এই মরসুমে আমরা দেশের সমস্ত ক্লাবকে বেগ দিতে পারব। আই লিগ ট্রফি ঘরে আনতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস।

এএফসি কাপ ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

এএফসি কাপ ফাইনাল এখনও পর্যন্ত আমার ফুটবল জীবনের সেরা ম্যাচ। বেঙ্গালুরু এফসির হয়ে এএফসি ফাইনালে নামার অভিজ্ঞতা আমার কাছে স্মরণীয়। খুব চ্যালেঞ্জ‌িং একটা ম্যাচ ছিল। ফাইনাল আমরা জিততে পারিনি ঠিকই। তবে আমি মনে করি ফাইনালে নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছি। নিজেদের শক্তির পরিচয় দিতে পেরেছি। বেঙ্গলুরু এফসির হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতিটাই ছিল অন্যরকম। গোটা দেশের সমর্থন ছিল আমাদের দিকে। এএফসি কাপ ফাইনাল থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

ভরা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ডার্বি ম্যাচ খেলার অনুভূতিটা কেমন ছিল?

এক কথায় সাররিয়াল অনুভূতি। আমি এর আগে শুধুমাত্র টেলিভিশনের পর্দাতেই এই ম্যাচ দেখেছি। ইস্ট-মোহনের লড়াই নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। মাঠে নেমে এই ম্যাচের পালস অনুভব করতে পেরেছি। দর্শক সমর্থন, তাঁদের আবেগ এক আলাদা আবহ সৃষ্টি করে। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কখনওই সম্ভব নয়। এই ধরনের ম্যাচে নামা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। একজন ফুটবলারকে পরিণত করে তোলে রুদ্ধশ্বাস ডার্বি ম্যাচ। পরের ডার্বিতে মাঠে নামার জন্য আমি এখন থেকেই মুখিয়ে রয়েছি।

ভারতীয় ফুটবল ক্লাবগুলি গত কয়েক বছরে অনেক বেশি পেশাদার হয়েছে। একজন ফুটবলার এতে কীভাবে উপকৃত হয়?

অবশ্যই। ক্লাব পেশাদার হলে একজন ফুটবলারও তার সেরাটা দিতে পারে। ভারতীয় ক্লাবগুলো এখন পেশাদার হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তনটা সকলেরই চোখে পড়বে। পড়ছেও। শুধুমাত্র মাঠ নয়, মাঠের বাইরেও ক্লাবগুলি এখন অনেক বেশি পেশাদার। ফুটবলারদের সব রকমের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে ক্লাবগুলো। ফুটবলারদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সব সময়ে নজর রাখছে। ক্লাব যখন ফুটবলারদের কথা এতটাই ভাবছে, তখন ফুটবলারদেরও দায়িত্ব ক্লাবকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE