Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
World Cup Football

আইসল্যান্ড: বরফের দেশে ফুটবল রূপকথা, আমরা শুধু দেখে যাই

এ ভাবেই হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম উত্তর গোলার্ধের একটি ছোট্ট দ্বীপ— যার পরে মানুষ আর জনবসতি গড়ে তুলতে পারেনি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে। দ্বীপের নাম আইসল্যান্ড।

আইসল্যান্ডের ফুটবল দলের অধিনায়ক। নিজস্ব চিত্র।

আইসল্যান্ডের ফুটবল দলের অধিনায়ক। নিজস্ব চিত্র।

অতনু চন্দ
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ১৪:১০
Share: Save:

ছোটবেলায় আমরা যারা বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় পড়েছি, অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণে বড় হয়ে ভূপর্যটক হতে চেয়েছি অনেকেই। সেই সময় আমাদের অতি প্রিয় সঙ্গী ছিল ভূগোলের ম্যাপ বই। সেই বইয়ের পাতায় একের পর এক অজানা দেশ খুঁজে বের করার নেশায় বুঁদ থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ ভাবেই হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম উত্তর গোলার্ধের একটি ছোট্ট দ্বীপ— যার পরে মানুষ আর জনবসতি গড়ে তুলতে পারেনি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে। দ্বীপের নাম আইসল্যান্ড।
উত্তর গোলার্ধের একেবারে ওপরের দিকে গ্রিনল্যান্ডের গা ঘেঁষে উত্তর অতলান্তিক সমুদ্রে এর অবস্থান। আয়তনে মাত্র ১ লক্ষ ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার, ভারতের আয়তনের প্রায় ৩০ ভাগের ১ ভাগ। জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৮০ (২০১২ সালের গণনা অনুযায়ী)। এই সীমিত সংখ্যক মানুষের দুই তৃতীয়াংশ বাস করেন উত্তর গোলার্ধের শেষ রাজধানী শহর রেইক্যাভিক-এ।
ভৌগোলিক প্রেক্ষিতে আইসল্যান্ড এক অতীব আশ্চর্য দেশ। দেশের উত্তর প্রান্তে জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ এখানে রয়েছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি, বরফে ঢাকা দুর্গম পাহাড়, গ্লেসিয়ার, লাভা স্রোত ইত্যাদি। পায়ে পায়ে বিপদের হাতছানি।

আরও পড়ুন: ইরান-পর্তুগাল ম্যাচে কে খেললেন ভাল, কেই বা খারাপ​

সামনে নাইজিরিয়া, আজ রাতে অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে মেসিরা​

ইতিহাস বলছে— রেইক্যাভিক পৃথিবীর অন্যান্য শহরের তুলনায় বয়সে অনেকটাই ছোট। ১৭৮৬ সালে জন্ম এই শহরের। শুরুতে নরওয়ে-র অধীনে থাকলেও, ১৯১৮ সালে আইসল্যান্ড স্বাধীনতা পায় এবং ১৯৪৪ সালে এখানে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত আইসল্যান্ডের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা আর চাষবাস। অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপের গরিব দেশগুলির অন্যতম ছিল এই দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মাছ শিকারের বাণিজ্যকরণ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় আইসল্যান্ড ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যতম ধনী এবং উন্নত দেশ হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর ভ্রমণপ্রেমী মানুষের কাছেও অন্যতম সেরা গন্তব্য এই দেশ। গ্রীষ্মে গড় তাপমাত্রা ১০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর শীতকালে তা নেমে যায় হিমাঙ্কের নীচে।

এ হেন আইসল্যান্ড এ বার সারা পৃথিবীর মানুষের নজর কেড়েছে এক সম্পূর্ণ অন্য কারণে। বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথমবার অংশ নিয়েই তারা রুখে দিয়েছে বিশ্বের তাবড় ফুটবল খেলিয়ে দেশ লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনাকে। সারা পৃথিবীর মেসি ভক্তদের সব আশাকে আশঙ্কায় পরিণত করেছে প্রতিযোগিতার শুরুতেই। অনবদ্য ফুটবল খেলে তামাম দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে ১১ জন নর্ডিক যোদ্ধা।

এখন মনে হতেই পারে, এ আর এমন কী ব্যাপার! এর আগেও বহুবার এ রকম অঘটন খেলার জগতে আমরা ঘটতে দেখেছি। এই বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরেই রজার মিল্লার ক্যামেরুন হারিয়ে দিয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্তিনাকে। কিন্তু আইসল্যান্ডের এই সাফল্যের কাহিনি উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে ঘেঁটে দেখতে হবে এই দেশের ফুটবল ইতিহাস।

অন্যান্য দেশ যখন বহু আগেই এই খেলা রপ্ত করে ফেলেছে, সেখানে আইসল্যান্ড ফুটবল খেলতে শুরু করে অনেক দেরিতে। ১৯১২ সালে আইসল্যান্ডে ফুটবল লিগ শুরু হলেও প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৩০ সালে। কিন্তু এই ম্যাচে ফিফার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। আইসল্যান্ড প্রথম ফিফা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৪৬ সালে ডেনমার্কের সঙ্গে। সেই থেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকে এই দেশটি। মাত্র ৬ বছর আগেও এই দেশ ফিফা ক্রমতালিকায় ছিল ১৩১ নম্বরে। কিন্তু অসম্ভব প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে যাদের দিন কাটে, তাদের দমিয়ে রাখে কার সাধ্য।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে আইসল্যান্ড প্রথম সাফল্যের মুখ দেখে ২০১৬ সালে। উয়েফা ইউরো কাপে শুধুমাত্র যোগ্যতা অর্জনই নয়, তারা পৌঁছে যায় এই প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত। এই সাফল্যের দৌড়ে তারা হারিয়ে দেয় হল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মতো তারকা দেশকেও। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসাবে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে প্রথমবার নিজেদের জায়গা করে নেয় আইসল্যান্ড এবং রুখে দেয় আর্জেন্তিনাকে। এখানে মনে রাখতে হবে— আইসল্যান্ড ফুটবল দলের সদস্যরা প্রত্যেকে অপেশাদার। এখনও পর্যন্ত তারা বিশ্বের নামীদামি ক্লাবগুলিতে খেলেনি। কিন্তু অসীম সাহস আর মনের জোরকে ভর করে তারা কাটিয়ে উঠেছে সব রকম প্রতিকুলতা। উদাহরণ হয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।

আরও পড়ুন: প্রতিটি ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এই দলগুলি

নর্ডিকদের এই লড়াই কি আমাদেরও উৎসাহিত করবে? বিশ্ব ফুটবলের আঙিনায় ভারতীয় ফুটবল দল জাতীয় সঙ্গীতের সুরে গলা মেলাচ্ছেন, এই দৃশ্য আমাদের কাছে শুধু স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। কবে সেই স্বপ্নপূরণ হবে, কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

FIFA World Cup 2018 Iceland Football FIFA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE