Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ডজনের স্বপ্নপূরণ করে ছুটছে অশ্বমেধের ঘোড়া

করল, লড়ল, জিতল রে...সেমিফাইনাল চলল রে! রাত সাড়ে এগারোটার উপ্পলে ওঁরা কারা? যাঁরা পীযূষ চাওলার মোক্ষম ক্যাচটা পড়তে দেখে চেয়ার থেকে ছিটকে লাফিয়ে উঠে নাচতে শুরু করে দিলেন?

এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সেমিফাইনালে নাইটরা। ছবি: পিটিআই

এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সেমিফাইনালে নাইটরা। ছবি: পিটিআই

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫০
Share: Save:

করল, লড়ল, জিতল রে...সেমিফাইনাল চলল রে!

রাত সাড়ে এগারোটার উপ্পলে ওঁরা কারা? যাঁরা পীযূষ চাওলার মোক্ষম ক্যাচটা পড়তে দেখে চেয়ার থেকে ছিটকে লাফিয়ে উঠে নাচতে শুরু করে দিলেন? কী বললেন, বাঙালি? নাহ্, ওঁরা নির্জলা হায়দরাবাদি। কেকেআর এখনও শুধু বাংলার, কে বলল? কেকেআর এখন ভারতের। যে টিম বারোয় বারো করে, রূপকথাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে যায়, যারা একটা ম্যাচ অবহেলায় ফেলে রেখে এক ধাক্কায় খুলে ফেলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শেষ চারের দরজা— সেই টিমকে আর ভূখণ্ডের সীমানায় আটকে রাখা সম্ভব কী ভাবে? চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে ওঠার জন্য আজ থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির চেন্নাই লড়বে। ম্যাড-ম্যাক্সের কিংস ইলেভেন পঞ্জাব লড়বে। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা বিদেশি টিমগুলো চেষ্টা করবে, কিন্তু কেকেআর আর লড়বে না। হায়দরাবাদে স্রেফ একটা নিয়মরক্ষার গ্রুপ ম্যাচ খেলবে। আসলে আজ থেকে তারা অপেক্ষা করবে সেমিফাইনাল যুদ্ধের প্রতিপক্ষের।

এক-এক সময় বিশ্বাস হবে না দেখলে। শত মস্তিষ্কপ্রয়োগেও বোধগম্য হবে না, আড়াই মাস ধরে কী ভাবে একটা টিমের সব কিছু এমন ঠিকঠাক চলতে পারে? মনে রাখতে হবে, তার মাঝে আরও আড়াই মাস ছিল। আইপিএল সেভেন জয়ের পর টিমটা প্রায় আড়াই-তিন মাস পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলছে। মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় কয়েকটা টিমের সঙ্গে ম্যাচ, সাইক্লিং, ট্রেকিং। সেই মন্ত্রে কি না কে জানে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যেন আরও ধারালো হয়ে ফিরেছে টিমটা। ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞরা এক কাজ করতে পারেন এখন। ‘ল অব অ্যাভারেজ’ শব্দটা ক্রিকেট-অভিধান থেকে এ বার তুলে দিতে পারেন। ক্রিকেটের কোনও সংজ্ঞারই তো আর স্থায়িত্ব রাখতে দিচ্ছে না কেকেআর। গম্ভীররা যে যুদ্ধে নামবেন সেটা আর ‘যে কেউ জিততে পারে’ থাকছে না। পাল্টে যাচ্ছে, ‘আমরাই শুধু জিততে পারি’-তে!

আচমকা চাপ? ৮ বলে ১৭ চাই? ওই যে, ক্রিজের মাঝে পাগলের মতো ব্যাট ঘোরাতে থাকা ছেলেটাকে দেখুন। ও সূর্যকুমার যাদব, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ওকে রাখেনি। ব্যাটিং স্টাইল এমন যে, বাঘা পেসাররা দেখলে নাক কুঁচকোবেন। অফে বিশেষ শট নেই। অফের বাইরে রাখলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বোলারদের অত গবেষণার পরেও অফস্টাম্পের বাইরেরগুলোকেই ফাইন লেগ দিয়ে মাঠের বাইরে ফেলে দেবেন সূর্য। স্তম্ভিত করে দেবেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে মাঝেমধ্যে খেলা কুল্টার-নাইলকে। অস্ট্রেলীয় পেসার প্রথম দিকে পরাক্রম দেখিয়ে, পরের পর উইকেট তুলে কেকেআরকে আস্তে আস্তে ম্যাচ থেকে বার করে দিচ্ছিলেন। সূর্য স্রেফ দু’টো শটে তাঁর সঙ্গে তাঁর টিমকেও হুসেন সাগরের জলে ফেলে দিলেন। ৮ বলে ১৭ থেকে ৭ বলে ১১, শেষে ছ’বলে চাই এ বার পাঁচ!

গম্ভীরের ভুল ক্যাপ্টেন্সি? ও ঠিক আছে। লোয়ার অর্ডার ম্যানেজ করে দেবে। হায়দরাবাদ প্রেসবক্সে একটা সময় বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, আন্দ্রে রাসেলকে আট নম্বরে নামিয়ে আনাটা কেকেআর ক্যাপ্টেনের ভুল সিদ্ধান্ত হল কি না। তখন আর তিন ওভার মতো পড়ে। গোটা পঁয়ত্রিশ চাই। ইউসুফ পাঠান টাইম করতে পারছেন না, একটু বাদে আউট। রাসেল নামলেন কিন্তু বলের সংখ্যা ততক্ষণে অনেক কমে এসেছে। সেট হতে পারছেন না কিছুতেই। ইয়াসির আরাফাতের শেষ ওভারের প্রথম বলটা বুঝতেও পারলেন না রাসেল। স্লোয়ারে বোল্ড। পাঁচ বলে পাঁচ চাই পীযূষ নেমে সিঙ্গলস নিলেন! যে হিমশীতল নার্ভ ধোনির কাছ থেকে লোকে শেষ ওভারে দেখে থাকে। ওই সময় পরপর দু’টো সিঙ্গলস আরও হটিয়ে দিল নাইট রাইডার্সকে। আর যে ক্যাচটা তুলেছিলেন পীযূষ, একশো বারের মধ্যে নব্বই বার ওটা পড়বে। ধরা এতটাই কঠিন।

স্পিনারদের প্রথম রাউন্ডের হার? কোনও ব্যাপার নয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে নকআউট পাঞ্চ দিয়ে প্রতিপক্ষকে সোজা শুইয়ে দেবে। অফব্রেক, লেগব্রেক, চায়নাম্যান, মিস্ট্রি— কোনটা নেই গম্ভীরের স্পিন-ভল্টে! অ্যাডাম ভোজেস তো শিশু। ক্রিকেট-বিশ্বের যে কোনও অধিনায়কের ঈর্ষা হবে। আর এমনই এক স্পিন-ভল্ট যা ভাঙার দুঃসাহস বা দুর্জয় ক্ষমতা— দু’টোর একটাও কোনও ব্যাটসম্যানের থেকে এখনও তো দেখা গেল না। আইপিএল সেভেনের ফাইনালের একটা ঋদ্ধিমান সাহা ব্যতিক্রম। বাকিদের পরাজয়ই এখন নিয়ম।

টিমের লেগস্পিনার যদি কোনও দিন মার খেয়ে যান, কোনও এক উনিশ বছরের চায়নাম্যান আবির্ভূত হবেন স্পিন-সতীর্থের পরিত্রাণে। একটা থেকে দু’টো আসবে, দু’টো থেকে তিনটে। আর এক জন আছেন, ক্যারিবিয়ান। তাঁকে কেউ চরম সাহস দেখিয়ে যদি ছয়-টয় মেরেও ফেলেন, পরের মিনিটেই নিয়তি তাঁকে টানবে ডাগআউটের দিকে। নারিনের ‘প্রতিশোধ-স্পৃহা’ তখন এমন ছিটকে বেরোবে যে, নিজ-ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড একটু-একটু করে ভাঙার আওয়াজ নিশ্চিত ভাবে শুনতে পাবে প্রতিপক্ষ!

বেচারি অ্যাডাম ভোজেস। বুড়ো হাড়েও লড়ে গিয়েছিলেন নাইটদের স্পিনের বিরুদ্ধে। একা। প্রথম রাউন্ডে তিনিও তাঁর টিমই নারিনদের বিরুদ্ধে জিতছিলেন। পীযূষের এক ওভার থেকে সতেরো বেরিয়েছে ওই সময়, নারিনের এত দিনের ওভারপিছু ২.২৫ রান খরচ এক লাফে উঠে গিয়েছিল ওভার পিছু সাড়ে আটে। পরে দেখা গেল নারিন চারটে। তবে ভোজেসের চেয়েও খারাপ লাগতে পারে ব্র্যাড হগের কথা ভেবে। কে জানত, যাঁকে দু’দিন আগে তিনি টুইট করে ‘ওয়েলকাম টু চায়নাম্যান ক্লাব’ লিখেছিলেন, সেই কুলদীপ যাদব নিজের আগমনকে তাঁর সামনেই প্রতিষ্ঠা করে হগকে বুঝিয়ে দেবেন যে, তোমার দিন শেষ, এ বার আমি! কুলদীপকে আজ ম্যান অব দ্য ম্যাচ দেওয়া হল। দুশো শতাংশ সঠিক সিদ্ধান্ত। কেকেআরকে প্রয়োজনীয় ব্রেক থ্রু-টা তিনিই দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, ব্যাটসম্যানকে প্রলুব্ধ করে ক্রিজ ছেড়ে বার করে আনার ক্ষমতা তাঁর আছে, ক্ষমতা আছে তার পর বলটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে কিপারের হাতে জমা করার। যেখান থেকে শুধু স্টাম্পিংই সম্ভব। কুলদীপের তিন উইকেট তাই বুধবার নারিনের চার উইকেটের চেয়েও বেশি দামি। শহরে বোধনের আগমনীর আগেই যে কেকেআরের সংসারে মহাষ্টমীর রাত নামল, তার এক নম্বর কারণ কেকেআরের চায়নাম্যান। দু’নম্বরে আর এক যাদব— সুর্য।

রাতে গৌতম গম্ভীর টিমের অসম্ভব মানসিক শক্তির কথা বলছিলেন। বলছিলেন, সূর্যর ‘ফিয়ারলেস’ ক্রিকেটে তিনি আশ্চর্য নন। সূর্য এ রকমই করে থাকেন। সূর্য এবং কুলদীপকে দেখে তাঁর মনে হচ্ছে, এঁরাই কেকেআরের ভবিষ্যৎ-লগ্নি। প্রেস কনফারেন্সে বেশ ঝকঝকেও দেখাল গম্ভীরকে। নাইট ক্যাপ্টেন ভারতীয় টিমে বহু দিন ধরে অনিয়মিত। কিন্তু বর্তমান ক্লাব টি-টোয়েন্টি পৃথিবীর একচ্ছত্র অধীশ্বর। চোখমুখ যেন বুঝিয়ে দিল, এটা তাঁর সাম্রাজ্য। এখানে তিনি শাসন করবেন, ক্ষুধার্ত ভাবে এ বার থেকে দাঁড়িয়ে থাকবেন সেমিফাইনাল-যুদ্ধের মাঠে।

আয়, কে আসবি আয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

পারথ স্কর্চার্স ২০ ওভারে ১৫১-৭ (অ্যাডাম ভোজেস ন.আ ৭১, নারিন ৪-৩১)

কেকেআর ১৯.৪ ওভারে ১৫৩-৭ (সূর্য ন.আ ৪৩, আরাফত ৩-৩৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE