তিন রেফারি। বাঁ দিকে থেকে, প্রিয়াঙ্কা, সন্ধ্যা, ময়না। নিজস্ব চিত্র।
অভাবের আঁধারে ফুটবল ওদের কাছে আলোর ঝিলিক। তাই বাধা ঠেলে মাঠের লড়াইয়ে সামিল ওরা।
বাঁশি মুখে মাঠে নামতে পারাটাই ওদের কাছে আনন্দের। এই আনন্দের মাঝে শত অভাবের কষ্টও যেন তুচ্ছ।
জঙ্গলমহল কাপে মহকুমাস্তরের খেলা পরিচালনা করতে পেরে তাই খুশি প্রিয়াঙ্কা বেজ, ময়না পাত্র, সন্ধ্যা রানারা। তাঁদের এখন একটাই লক্ষ্য, রাজ্যস্তরের খেলা পরিচালনা করা।
লালগড়ের গোহমির বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা। ময়নার বাড়ি লালগড়েরই বামালে। জঙ্গলমহল কাপে লালগড় সারদা বিদ্যামন্দিরের হয়ে দু’জনেই খেলেছেন। ফুটবলার হিসেবে জীবন শুরু হলেও ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা ও ময়নার লক্ষ্য ছিল রেফারি হওয়া। তাই ঝাড়গ্রামের মহকুমা স্তরে রেফারির পরীক্ষা দেন। ২০১৫-তে জেলা স্তরের পরীক্ষাতেও পাশ করেন তাঁরা।
শালবনির কদমডিহার সন্ধ্যা শালবনি গভর্নমেন্ট কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। স্কুলে পড়াকালীনই জঙ্গলমহল কাপে খেলেছেন। ২০১৪ সালে মহকুমা স্তরের রেফারি হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। জেলা স্তরেও পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। যদিও ইতিমধ্যেই কয়েকটি ম্যাচ পরিচালনা করে নজর কেড়েছেন সন্ধ্যা।
জঙ্গলমহল কাপের খেলা পরিচালনার পরে তিনজনই গত রবিবার মেদিনীপুর সদর মহকুমার মহিলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলাও তাঁরা তিন জন পরিচালনা করেন। ময়না বলেন, ‘‘আগে জঙ্গলমহল কাপে খেলেছি। এখন সেই জঙ্গলমহল কাপের খেলা পরিচালনার সুযোগ পেয়ে খুবই ভাল লেগেছে।’’ প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘‘টাকা রোজগার নয়। হুইশল নিয়ে মাঠে খেলা পরিচালনা করতে পারাটাই খুব আনন্দের।’’ ফুটবল ম্যাচে রেফারির ভূমিকা পালন করতে পেরে খুশি সন্ধ্যাও। তাঁর কথায়, ‘‘ফুটবল খেলতে ভালবাসি। মাঠে রেফারি শক্তিপদ মাহাতের সঙ্গে পরিচয় হয়। শক্তিবাবুর অনুপ্রেরণাতেই রেফারি হওয়া।’’
তিন জনেরই সংসারের নিত্য সঙ্গী অভাব। সামান্য জমিতে চাষ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে সন্ধ্যার। তাঁর বাবা সৃষ্টিধর রানা বলেন, ‘‘সামান্য যে জমি জায়গা রয়েছে, তাতে একবার মাত্র চাষ হয়। তা থেকে কোনও মতে সংসার চলে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘খেলা থাকলে মাঝেমধ্যে লোকের থেকে টাকা ধার করে মেয়েকে নিয়ে যাই।’’ প্রিয়াঙ্কার বাবাও বাজারে মাছ-মাংস বিক্রি করেন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘‘বাবা দিলীপ বেজ ঝাড়গ্রাম থেকে মাছ, মাংস এনে লালগড়ের বাজারে বিক্রি করেন। বাড়িতে জমি জায়গা কমই রয়েছে।’’ ময়নারাও চার বোন ও এক ভাই। নিজেদের জমিজমা নেই। তাই জেঠার জমিতেই ভাগে চাষ করেন ময়নার বাবা অনিল পাত্র।
জেলা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য শক্তিপদ মাহাত ঝাড়গ্রামের দুধকুণ্ডির বাদলমারা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৪ সাল থেকে রেফারি হিসেবে ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করছেন শক্তিপদবাবু। জঙ্গলমহল কাপে খেলা দেখে শক্তিপদবাবুই সন্ধ্যা, প্রিয়াঙ্কাদের রেফারি হওয়ার পরীক্ষা দিতে বলে। শক্তিপদবাবুর কথায়, ‘‘জঙ্গলমহল কাপের ম্যাচেই ওদের তিন জনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখনই তাঁদের রেফারির পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলি।’’ ঝাড়গ্রাম রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক ভট্টচার্য বলেন, “জঙ্গলমহলের মেয়েরা রেফারির কাজ শেখার জন্য এগিয়ে আসছে এটা ভাল। চলতি বছরে তিন জন মেয়েকে রেফারি হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’’
পশিম মেদিনীপুর রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ পাণিগ্রাহি বলেন, “নতুন রেফারিদের প্রথমে জঙ্গলমহল কাপের মহকুমা স্তরের খেলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে জেলা স্তরের খেলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে রাজ্য স্তরেও তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’’ এ নিয়ে প্রাক্তন ফিফা-র রেফারি চৈতালী পাল বলেন, ‘‘ওরা কলকাতায় এলে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে। কলকাতায় নবাগত ছেলেমেয়েদের নিখরচায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy