Advertisement
E-Paper

ব্যান্ডমাস্টারের কবিতা ইউরোয় ভুলিয়ে দিচ্ছে বন্ধুর যুদ্ধের গদ্য

গাল থেকে ঝুলে পড়া দাড়িটা একই রকম, কিন্তু চুলটা অত পর্যন্ত আসে না। আলেসান্দ্রো পির্লোর চুল অনেক বড়, কাঁধ ছুঁয়ে চুমু দিত পিঠে। তাঁর ও রকম নয়। পির্লোর মতো মায়াবী চোখ নেই, চেহারাতেও খুঁজে পাওয়া যায় না বিখ্যাত ইতালীয় রোম্যান্স।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৯:১২
পির্লো (ইনসেটে) নয়। ইতালি এখন তাকিয়ে ডি’রোসির দিকে।

পির্লো (ইনসেটে) নয়। ইতালি এখন তাকিয়ে ডি’রোসির দিকে।

গাল থেকে ঝুলে পড়া দাড়িটা একই রকম, কিন্তু চুলটা অত পর্যন্ত আসে না। আলেসান্দ্রো পির্লোর চুল অনেক বড়, কাঁধ ছুঁয়ে চুমু দিত পিঠে। তাঁর ও রকম নয়। পির্লোর মতো মায়াবী চোখ নেই, চেহারাতেও খুঁজে পাওয়া যায় না বিখ্যাত ইতালীয় রোম্যান্স। এঁর একগাদা ট্যাটু। ট্যাটু নাকি তিনি প্রচণ্ড ভালবাসেন। চুলও কেমন যেন, অতীব ছোট করে ছাঁটা। দেখলে গ্ল্যাডিয়েটর লাগে, মনে পড়ে যায় কোনও এক ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরি।

পির্লোর মতো ফ্রি-কিকটাও তো নিতে পারেন না ইনি। ডেড বল সিচুয়েশন থেকে শটগুলো বড় বেশি অবাধ্যতা করে, উড়ে যায় এ দিক-ও দিক। সৃষ্টিকর্তার সম্মানকে পাত্তা না দিয়ে, আপন খেয়ালখুশি মতো।

কেউ তাঁকে ব্যান্ডমাস্টার বলে না। বলে না, তুমি তো মাঠে নেমে ফুটবল খেলো না, অর্কেস্ট্রা সঙ্গীতে মোহাবিষ্ট করে রাখো দর্শককে। এত দিন হয়ে গেল, তবু। এত দিন ধরে পির্লোর সঙ্গে খেলছেন, একই পজিশনে খেলেছেন, একই রকম দুর্দান্ত থ্রু পাস বাড়াতে পারেন, তবু। আলেসান্দ্রো পির্লো নামের পর্বতমালার প্রজা হয়ে থাকতে হয়েছে বরাবর।

কিন্তু তবু আলেসান্দ্রো পির্লো এবং ড্যানিয়েল ডি’রোসি খুব ভাল বন্ধু।

প্যারিস এত বড় শহর যে কে কোথায়, কখন কোথায়, খুঁজে বার করা মুশকিল নয়, প্রায় দুঃসাধ্য। ইতালি এবং স্পেন, হিসেব মতো দু’টো টিমেরই সমর্থককুলের এখন প্যারিসে থাকা উচিত। স্তাদ দ্য ফ্রাঁসে দু’দিন পরেই খেলা, খুব সহজে বললে গত ইউরো ফাইনালের রিপিট টেলিকাস্ট, নীল-লাল সমর্থকে-সমর্থকে তো চার দিক সমুদ্র হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্যারিসের কয়েকটা বার-এ পর্যন্ত ঢুকেও কোনও ইতালি সমর্থক শনিবার পাওয়া গেল না। শোনা গেল, ম্যাচের দিন সকাল থেকে ভিড়টা আস্তে আস্তে বাড়ে। হাতে যাদের টিকিট থাকে, তারা যায় স্টেডিয়ামের দিকে। যাদের থাকে না, যারা ছুটে আসে শুধুমাত্র ফুটবলের প্রতি নিখাদ প্রেমে, তাদের ঠিকানা ফ্যান জোন। বিশাল স্ক্রিন, প্রেমিকা, বিয়ার এবং ফুটবল।

দু’একজনের সঙ্গে দেখা হলে সুবিধে হত। একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করা যেত যে, ব্যাপারটা সত্যি কি না? সত্যিই পির্লো আর ডি’রোসি বন্ধু? ইতালীয় মিডফিল্ডার যে বলেছেন, তিনি পির্লোকে মিস করেন। ড্রেসিংরুমে পুরনো সেই আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা খুব মিস করেন। খোলাখুলিই বলেছেন, কোনও আন্তোনিও কন্তের তোয়াক্কা না করে।

আন্তোনিও কন্তে! টিমের উপর কর্তৃত্বে, দাপটে, একনায়কতন্ত্রের মনোভাবে সময়-সময় তো ভারতীয় ক্রিকেটের কুখ্যাত এক অস্ট্রেলীয়কে মনে করিয়ে যান। গ্রেগ চ্যাপেল কী বস্তু, কেমন লোক, খুব ভাল বলতে পারবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ঠিক তেমনই আন্তোনিও কন্তে কী বস্তু, কেমন লোক, সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন বোধহয় আন্দ্রে পির্লো। ইতালীয় ফুটবলে রোমের কলোসিয়ামের মতো মর্যাদাসম্পন্ন তিনি। খেলায় শুধু নয়, টিমের উপর প্রভাবের বিচারেও।

অপরাধ বলতে একটাই করেছিলেন পির্লো। মেজর লিগ সকারে যাওয়া। আন্তোনিও কন্তের বিষদৃষ্টিতে পড়ে যাওয়াও তার পর থেকে। পির্লোকে ইউরো টিম থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে কন্তে খুব সহজ ভাবে রূঢ় একটা কথা বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, কারও এমএলএসে (মেজর লিগ সকার) যাওয়া নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য নেই। যে কেউ যেতেই পারে। কিন্তু সে যেন খেয়াল রাখে, দেশের ফুটবলে তার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াতে পারে। খুব সহজে বলে দেওয়া, ওহে পির্লো এমএলএস নামের কবরে যেতে চাইছ যাও, কিন্তু নিজেকে ইতালীয় ফুটবলে আর অপরিহার্য ভেবো না। রোমের সিংহদরজা তোমার মুখের উপর আমি যত দিন আছি, বন্ধ করে দিলাম! মেজর লিগ সকারকে কন্তের বিদ্রুপ করা নিয়ে তখন তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি। কন্তে আর ফেরাননি পির্লোকে। শান্ত ভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন নিজের দর্শন— আমার ‘স্প্রেজাটুরার’ প্রয়োজন নেই। কোনও ফুটবলারকে অলস সৌন্দর্যে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে হবে, তার দরকার নেই। আমার যোদ্ধা দরকার। পাশবিক যোদ্ধা।

কে জানে, সে কারণেই ডি’রোসি থেকে গেলেন কি না। ইউরো দল নির্বাচনের আগে ইতালীয় মিডিয়ায় তীব্র চর্চা হয়েছিল দু’জনের মধ্যে কে থাকবেন, তা নিয়ে। পরে দেখা গেল পির্লো বাদ, আছেন ডি’রোসি। পির্লোর ‘স্প্রেজাটুরার’ ধারেকাছে থাকেন না, বরং কিছুটা বদনামই আছে মারকুটে প্লেয়ার বলে। তাঁর ফুটবল-সৌন্দর্য পির্লোর মতো নয়, কিন্তু ডিফেন্স পির্লোর চেয়ে অনেক ভাল। পির্লো ভাবতেন আক্রমণ, ডি’রোসি আগে ভাবেন ডিফেন্স। তার পর আক্রমণ।

এত পর্যন্ত পড়লে পাঠক ভাবতে পারেন, তা হলে এই দুইকে নিয়ে লেখার দরকার কী? পির্লো সৃষ্টি হলে, ডি’রোসি ধ্বংস। পির্লো কবিতা হলে, ডি’রোসি শুষ্কং-কাষ্ঠং গদ্য। রোম্যান্স কোথায়, কোথায় মুগ্ধতা?

কিছুটা ঠিক, কিছুটা নয়। খুঁজলে আছে, অনেক কিছু আছে। ইতালির যে ক্লাবে খেলেন ডি’রোসি, সেই রোমা বহু বছর সেরি আ পায়নি। ষোলো বছর ওই এক ক্লাবে খেলছেন ডি’রোসি, এক বারও পাননি। তবু রোমা তাঁকে ঈশ্বর মনে করে। তাঁর ফুটবল-বোধ, টিমের প্রতি আনুগত্য দেখে। কন্তের ইতালিতেও তো তাই। ডিফেন্সের যে ফর্মেশন ভেঙেচুরে, মিডফিল্ডে ঝড় তুলে নতুন যে ইতালি গঠনের মন্ত্রে নেমেছেন কন্তে, তার নেপথ্যে এই দাড়িওয়ালা, ছোট চুলের লোক। মিডফিল্ডে নেতৃত্ব— সেটাও এখন পির্লোর মতো দেন। বেখাপ্পা প্রশ্নের জবাবে সশব্দ কষাঘাত, তা নিয়েও দু’বার ভাবেন না। ইউরো শুরুর আগে কন্তের টিম নিয়ে লোকে বলছিল ‘টিম অব লেসার ট্যালেন্টস’। শুনেটুনে ক্ষিপ্ত ডি’রোসি বলে দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, আমাদের একটা জ্লাটান নেই। একটা হ্যাজার্ড নেই। কিন্তু আমাদের কী আছে, আমরা কী করতে চাইছি, সেটাও আপনাদের বুঝতে হবে।” সরকারি ভাবে টিমের অধিনায়ক বুফন, কিন্তু ইনিও কি অদৃশ্য টিম লিডার নন?

আর রোম্যান্স? রোমা আজও তাঁকে ঈশ্বর মনে করে। তা কি এমনি করে? ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির কিটম্যান পিয়ের্তো লোম্বার্ডির সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ডি’রোসির। শোনা যায়, অসম্ভব ভালবাসতেন ওই বুড়ো মানুষটাকে। লোম্বার্ডির মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্যে গিয়েছিলেন ডি’রোসি। গিয়ে সযত্নে নিজের বিশ্বকাপ জয়ের মেডেলটা রেখে আসেন কফিনে! বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করে, বন্ধুর প্রতি সম্মানে।

ক’জন পারবেন এমন? আর যিনি বিশ্বকাপ জয়ের মেডেল বন্ধুর কফিনে রেখে আসতে পারেন, ইউরো জিতলে তিনি মেডেলটা নিয়ে আন্দ্রে পির্লোর কাছে চলে যাবেন না, তারও বা গ্যারান্টি কোথায়? আফটার অল, তিনিও তো লোম্বার্ডির মতো ডি’রোসির খুব, খুব ভাল বন্ধু!

Alessandro Daniele De Rossi euro cup 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy