Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কোন অমল দত্ত মনে পড়বে? এক না দুই?

অদ্ভুত ভাবে কালকেই অমল দত্তের কথা মনে পড়ল! দূর বিদেশ-বিভুঁইয়ে বসেও। মনে পড়ার কারণ তাঁর পুরনো একটা লেখা। সিয়াটল ডাউনটাউন ছাড়িয়ে শহরের পুব শহরতলির বুকে শনিবার সকালে ফার্মার্স মার্কেট বসেছে। যেখানে গ্রামের চাষারা সরাসরি তাদের পণ্য নিয়ে কাস্টমারের মুখোমুখি।

গৌতম ভট্টাচার্য
সিয়াটল শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪৭
Share: Save:

অদ্ভুত ভাবে কালকেই অমল দত্তের কথা মনে পড়ল! দূর বিদেশ-বিভুঁইয়ে বসেও। মনে পড়ার কারণ তাঁর পুরনো একটা লেখা। সিয়াটল ডাউনটাউন ছাড়িয়ে শহরের পুব শহরতলির বুকে শনিবার সকালে ফার্মার্স মার্কেট বসেছে। যেখানে গ্রামের চাষারা সরাসরি তাদের পণ্য নিয়ে কাস্টমারের মুখোমুখি। যার কাছাকাছি তর্জমা হতে পারে, কম টাকায় কেনার হাট বসেছে। কিন্তু কলকাতার ময়দান পথিকের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রষ্টব্য একটু এগিয়ে দক্ষিণ কোণের মাঠটা।

যেখানে পাশাপাশি মাঠে ফুটবল খেলছে ছেলেরা আর মেয়েরা। অমল লিখেছিলেন বিদেশে যখন যেখানে ফুটবল হচ্ছে, সেটা যে মানের, যে রকমেরই হোক, দেখার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে যান। ফুটবলের মাধ্যমে একটা গোটা জাতি আপনার চোখের সামনে প্রকাশিত হতে থাকবে। ইংল্যান্ডের কোনও কাউন্টি শহরে দাঁড়ালে দ্রুত চোখে পড়বে বলিষ্ঠ ইংরেজ স্টাইল। লম্বা বল প্রতিনিয়ত দু’দিক থেকে তুলে দেওয়া। গাঁট্টাগোট্টা স্ট্রাইকার তার পর হেড করতে তৈরি থাকবে। প্যারিসের এক কোণে আবার খেলা দেখতে বসলে বাচ্চাদের ফুটবলেও পেলবতা। ছোট ছোট শিল্পের ফুলকি। ঠিক ফ্রান্স দেশটা যেমন!

কিন্তু এই সিয়াটলের ফুটবল মাঠে দাঁড়িয়ে কোন দেশটাকে খুঁজব? এখানকার ফুটবলাররা তো প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি। মাইক্রোসফট ক্যাম্পাসের ভেতর বিকেলে যে বড় ফুটবল মাঠটা দেখে এলাম, সেটাও তো তার ওয়ার্কফোর্সের বিশাল দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের কথা ভেবে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবস্থাপনা। তা হলে কি এ সব পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশীয় মানচিত্র ফুটে উঠবে মার্কিন মুলুকে? অমল দত্ত উত্তর দিয়ে যাননি।

কিন্তু একটা জবাব অবশ্যই পেশ করে গিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাঙালির বিশ্ব ফুটবল দর্শনের তিনিই সর্বোত্তম ট্যুর গাইড। আজকের পৃথিবীতে তো ইউটিউবে সংরক্ষিত ফুটবল ভিডিও আছে। অ্যামাজন ডট কম থেকে মেসির ওপর বই বা মারাদোনার নাপোলি ম্যাচের সব সি়ডির নিমেষে মালিক বনে যাওয়া সম্ভব। এখন আম বাঙালির ছাদের ওপর ডিশ অ্যান্টেনা আর তাতে ঝুলতে ঝুলতে ড্রয়িংরুমে বিশ্ব ফুটবলের দেদার বুফে। সে ইউরো কাপ হোক কী ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ।

অমল দত্ত এমন যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন যখন মুক্ত আকাশ আর সময়ের উদারিকরণ আবির্ভূত হয়নি। একটা সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা সাম্রাজ্যের কাছে তিনি পৌঁছতেন নিজের অদম্য চেষ্টায়। তার পর তাকে তুলে আনতেন বাঙালি ফুটবল প্রেমিকের জন্য। যে সময় প্রজেক্টর সমেত তিনি কখনও পঞ্চাশ, কখনও একশো টাকার বিনিময়ে অফিসে-অফিসে খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছেন, তখন সত্তর দশক। দ্রোণাচার্য হওয়ার রাস্তা খুলে গিয়েছে তত দিনে তাঁর। প্রথম বাঙালি কোচ যাঁকে কাঁধে তুলে ধরেছে সমর্থকেরা। ঊনসত্তরের লিগ-শিল্ড দুটোই জিতেছেন। ভবানী রায়কে ওভারল্যাপিং রাইটব্যাক খেলানোর দুঃসাহস এমনই সফল যে, শিল্ড ফাইনালে থঙ্গরাজের ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ হারানোর পর মোহনবাগান কর্তারা বাঁধনহারা। এর আগে দুর্বল ওড়িশা টিম নিয়ে সন্তোষ ট্রফিতে আলোড়ন সৃষ্টি করার রেকর্ডও সিভিতে থেকে গিয়েছে।

তাতে কী! তিনি অমল দত্ত বিশ্ব ফুটবলের সঞ্জয় থাকতে চেয়েছেন। বাংলা ফুটবলের দ্রোণাচার্য হতে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশ্ব ফুটবল দর্শন শুরু করেন ওয়েম্বলিতে স্ট্যানলি ম্যাথিউজকে দিয়ে। কে বলতে পারে রোববারও হয়তো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন মাঝরাত্তিরের মধ্যে প্যারিসে পৌঁছনোর তাড়া ছিল বলে।

মাইক্রোসফটের শহরে বসে এক-এক সময় মনে হচ্ছে এমন অপ্রগতিশীল সময়ে তিনি কী ভাবে যুগের চেয়ে এত এগিয়ে ছিলেন? কী করতেন যদি ঘোর আইটির যুগে ভিডিও প্রযুক্তি আর প্রস্তুতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুযোগ তাঁর সামনে তৈরি থাকত? এই যে ভবানী রায়কে ওভারল্যাপিং করানো। সুদীপকে স্টপার থেকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারে টেনে আনা— সবই তো ইন্সটিঙ্কট। কী হত যদি ডায়মন্ড ফর্মেশন জাতীয় যাবতীয় সিদ্ধান্তের পিছনে একটা আইটি সেলও তিনি সঙ্গে পেতেন?

আনন্দবাজার অফিসে যখন রাতের পর রাত আমাদের সঙ্গে বসে খেলা দেখেছেন, তখনও তিনি সেই সঞ্জয়। কখনও দ্রোণাচার্য নন। রাতের গাড়িতে অবশ্যই অফিস তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা না থাকলে অমল নির্ঘাত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ওপর দাঁড়িয়ে কোনও নিশিরাতের বাস খুঁজতেন। বা মিনিবাস। ট্যাক্সি কখনও নয়। এমনকী শেয়ার ট্যাক্সিও নয়। সত্তর দশকের ওই ফুটবল গনগনে সময়ে বড় ম্যাচের জন্য আসতেন নির্বিকার মুখে মিনিবাস চেপে।

টাকাপয়সার ব্যাপারে সতর্ক শুধু নন, অসম্ভব সন্ত্রস্ত। এই বুঝি কেউ টাকা মেরে দিল। বিভিন্ন সময় গুণমুগ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষ চেয়েছেন সাহায্যের হাত বাড়াতে। চেয়েছেন অমলকে নিজেদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী রাখতে। কিন্তু এমনই বোহেমিয়ান তিনি যে, কখনও বন্ধনীবদ্ধ হতে চাননি। কখনও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাব নিয়ে এক কাগজ থেকে টাকা নিয়ে অন্য কাগজে চলে গিয়েছেন। চরম গোঁয়ার— একই সঙ্গে বোহেমিয়ান। কেউ লিখেছেন ফুটবল মাঠের মোরারজি দেশাই। কেউ লিখেছেন ফুটবল কোচেদের শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যেটাই সত্যি হোক, অমলের কিছু আসে-যায়নি।

এক-এক সময় অবাক লেগেছে— একই মানুষের ভেতরে একই সময় দুটো ভিন্নধর্মী স্রোত কী ভাবে প্রবাহিত থাকতে পারে? একটা অত্যন্ত আধুনিক, যুগের চেয়ে এগিয়ে চলার উদারপন্থী মনন। একটা মানুষ গ্ল্যামারবিমুখ, সৃষ্টির নেশায় বুঁদ, ফুটবলজ্ঞানে অনর্গল ভেলা ভাসানোর মননসম্পন্ন। যার নিয়মিত ঝুঁকি নেওয়া সমস্যা নয়, কারণ খ্যাতিকে সে কখনও নিজের বৈঠকখানার পাশবালিশ হিসেবে দৈনন্দিন অভ্যেসের মধ্যে রাখেনি। ফুটবলের পাশে বরং একটা ছোট মোহনা রেখেছে নিজের জন্য— উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। মানুষটা যেন সব সময় ফুটবল আর সঙ্গীতে শুদ্ধ!

অথচ শরিকি বাড়ির ওই অংশটা একেবারে আলাদা। এটা অমল দত্ত এক হলে ওটা অমল দত্ত দুই। একই শরিকি বাড়ি ভেঙে তীব্র বিপরীতমুখী দুটো সত্তা। এই লোকটা তীব্র অসৌজন্যে ভরপুর। বিনা কারণে দুমদাম এমনই অপমান করেছে বিভিন্ন ব্যক্তিকে যে, আজ মৃত্যুর পরেও কেউ কেউ শোকগাথা লিখতে অস্বীকৃত। এই লোকটা কখনও ঈর্ষাকাতরও যে দুমদাম মিডিয়াকে বলবে, আমার কাছে আসবে কেন ভাই? আমার তো আর বগলকাটা বউ নেই। এই লোকটা হাতে টাকা না নিয়ে এক লাইন লিখবে না। টাকা পেলেও দায়বদ্ধ থাকবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।

কাকে বেশি মনে পড়বে? মৃত্যু পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা অতিক্রান্ত। উত্তরটা খুঁজছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amal Dutta Diamond System Football Coach
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE