Advertisement
E-Paper

উত্তরপাড়া থেকে উত্তরণ, রাজা-মন্ত্রী সামলে রাষ্ট্রপতি ভবনের অলিন্দে বাংলার দৃষ্টিহীন দাবাড়ু যুধাজিৎ

দাবার পাশাপাশি সেতার বাদনেও দক্ষ যুধাজিৎ দে। দৃষ্টিহীন হলেও নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করেন না উত্তরপাড়ার ২৯ বছরের যুবক। এখন তিনি পেশাদার দাবা কোচ।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:২১
Picture of Yudhajeet De

(বাঁ দিকে) রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন যুধাজিৎ দে (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

দৃষ্টিহীন। তবু উজ্জ্বল চোখ। প্রতিবন্ধকতা শুধুই খাতায়-কলমে। বাবা-মার উৎসাহ আর মনের জোরকে সম্বল করে এগিয়ে চলেছেন যুধাজিৎ দে।

হাতি-ঘোড়া-নৌকায় চড়ে বাংলার দৃষ্টিহীন দাবাড়ু পৌঁছে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। গত বুধবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্মানিত করেছেন যুধাজিৎকে।

৬ বছর বয়সে মায়ের কাছে দাবা শেখা শুরু। তার পর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা ২৯ বছরের যুধাজিতের শুধুই উত্তরণ। দাবার পাশাপাশি সেতার বাদনেও দক্ষ তিনি। নিজেকে উদাহরণ হিসাবে তৈরি করেছেন প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীদের সামনে। প্রতিবন্ধকতা কখনও যুধাজিতের সামনে বাধা তৈরি করতে পারেনি। পরিবার-কোচেদের সহযোগিতা এবং মনের জোর সম্বল করে একের পর এক পর্যায় অতিক্রম করেছেন।

প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পে এ বছর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন যুধাজিৎ। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিব্যাঙ্গজন হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মাস খানেক আগে রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে ফোন করে পুরস্কারের কথা জানানো হয়। আনন্দবাজার ডট কম-কে দিল্লি থেকে ফোনে যুধাজিৎ বললেন, ‘‘রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে আসা ফোনটা বাবা ধরেছিলেন। শোনার পর প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করেছিলাম। কী বলব, কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার মুহূর্তের অনুভূতিও বলে বোঝানো সম্ভব নয়। দু’দিন পরও রোমাঞ্চিত লাগছে। এমন একটা সম্মান বা স্বীকৃতি পেতে পারি কখনও ভাবিনি।’’

কেমন ছিল শুরুর সময়টা? যুধাজিত বললেন, ‘‘তখন ছোট। মা (রুমা দে) দাবা খেলতে জানেন। মায়ের কাছেই শেখা শুরু। আমি আর আমার যমজ ভাই দিব্যজিৎ একসঙ্গেই শেখা শুরু করি। আমার ভাইয়েরও চোখের সমস্যা রয়েছে। দৃষ্টি অল্পই। কিন্তু আমরা কখনও নিজেদের প্রতিবন্ধী বলে ভাবিনি। বাবা-মাও কখনও আমাদের প্রতিবন্ধী মনে করেননি। আমার তো মনে হয়, এটা অনেকটাই মনের ব্যাপার।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘মায়ের কাছে দাবা শেখা শুরু হলেও পরে আরও অনেকের কাছে শিখেছি। অনেকগুলোয় জায়গায় শিখেছি। কারও নাম আলাদা করে বলতে চাই না। প্রত্যেকে আমার গুরু। ওঁরা সকলে আমার কাছে সব মর্যাদার।’’

শুধু দাবা নয়, ভাল সেতার বাজাতে পারেন যুধাজিৎ। সেতারে পাঁচ বার সোনার পদক পেয়েছেন। যুধাজিৎ বললেন, ‘‘দাবা আর সেতার নিয়েই থাকি। এগুলোতেই আমার আনন্দ। দু’ভাই একসঙ্গে খেলায় সুবিধা হয়েছে। আমি তো দেখতে পাই না। আমাদের খেলা শেখার সময়,প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। বিভিন্ন বই পড়তে হত। ভাই আমাকে পড়ে দিত। আরও নানা রকম সাহায্য করত। আমার দাবাড়ু হয়ে ওঠার নেপথ্যে বাবা-মা, কোচদের মতো বড় অবদান রয়েছে ভাইয়ের। ২০০৮ সাল থেকে রাজ্য পর্যায়ের প্রতিযোগিতাগুলিতে খেলতে শুরু করি। প্রথম প্রতিযোগিতাতেই রানার্স হয়েছিলাম।’’

যুধাজিৎ এখন মূলত দাবা শেখান। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি এখন খেলা শেখাই। আমার ফিডে রেটিং ১৮১০। বালি দাবা অ্যাকাডেমির অন্যতম সিনিয়র কোচ আমি। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও খেলা শেখাই। ভিন রাজ্যের ছাত্রছাত্রীও রয়েছে আমার। সব মিলিয়ে এখন ৭০-৮০ জনকে খেলা শেখাই। ভাই ডানকুনির একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দাবা শিক্ষক।’’

এখন নিজে খেলেন না? যুধাজিৎ বললেন, ‘‘কোভিডের সময় অনলাইনে শেখাতে শুরু করি। এখন এত ছাত্র সামলে নিজের খুব একটা খেলা হয় না। আমি এখন পেশাদার কোচ। তবে একটা সময় পর্যন্ত প্রচুর প্রতিযোগিতা খেলেছি। দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতায় খেলেছি, তেমন সাধারণ প্রতিযোগিতাতেও খেলেছি অনেক।’’ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির দাবাডুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে কখনও সমস্যা হয়নি? যুধাজিৎ বললেন, ‘‘না। কোনও সমস্যা হয়নি। খুব সাহায্য, উৎসাহ পেয়েছি সব সময়। সকলের কাছে পেয়েছি। স্বাভাবিক প্রতিপক্ষেরাও আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আয়োজকেরা সাহায্য করেছেন। এমনও হয়েছে, প্রতিযোগিতার মাঝে হয়তো কোনও একটা রাউন্ড জিতেছি। তাতেও সকলে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করেছেন। তবে হ্যাঁ, দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতা খেলতে গিয়ে একাধিকবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে।’’

সে কী! সাধারণ প্রতিযোগিতায় সমস্যা হয়নি, আর দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতায় সমস্যা? যুধাজিৎ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও হয়েছে। আমি কারও নাম বলব না। আসলে অ্যাথলেটিক্সে দৃষ্টিশক্তি বিচার করে প্রতিযোগীদের যেমন বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়, দাবায় তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা অল্প দেখতে পায়, তারাও দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতায় খেলতে পারে। এই ধরনের কিছু দাবাড়ুর মধ্যে অসততা দেখেছি। কখনও কেউ চাল পাল্টে দিয়েছে, কখনও কেউ অন্যরকম সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু আমি দেখতে পাই না বলে সে ভাবে প্রতিবাদ করতে পারি না। তা ছাড়া, এ সব প্রমাণ করা কঠিন। আমার তো মনে হয়, দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কারও যদি খুব সামান্য দৃষ্টিশক্তিও থাকে, তা হলে তার চোখ বেঁধে দেওয়া। অ্যাথলেটিক্সে হয়। জানি না, দাবায় কেন হয় না। অথচ দাবা যে কারও সঙ্গে খেলা যায়। যে কোনও বয়সের মানুষের সঙ্গে খেলা যায়।’’

খেলোয়াড়জীবনের এই আক্ষেপ নিয়ে বসে থাকতে চান না যুধাজিৎ। নানা ভাবে সমাজের জন্য অবদান রাখতে চান। ভবিষ্যতের দাবাড়ু তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে চান। গত জুলাইয়ে উত্তরপাড়ায় একটি দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিলেন স্পনসর ছাড়াই। শুধু এন্ট্রি ফি নিয়েছিলেন। মোট ৭০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিল। ১০-১১ জন ফিডে রেটেড দাবাড়ুও ছিল। চলতি মাসেই আয়োজন করছেন একটি কুইজ প্রতিযোগিতা। যুধাজিতের বক্তব্য, ‘‘আমি থামতে চাই না। যা যা করা আমার পক্ষে সম্ভব, সব করতে চাই। সকলকে বোঝাতে চাই, অসম্ভব বলে কিছু হয় না। আমার মতো যারা দেখতে পায় না, অন্য কোনও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তাদের সামনে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরতে চাই।’’

রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পাওয়াকে জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসাবে দেখছেন। কোথায় সাজিয়ে রাখবেন এই পদক? যুধাজিৎ বললেন, ‘‘এটা বাবা-মা ঠিক করবেন। আমি এ সব নিয়ে ভাবি না। আমি শুধু নিজের কাজ করে যেতে চাই। এখনও পর্যন্ত আমার জেতা সব পদক বাবা-মাই সাজিয়ে রেখেছেন।’’

রাজ্য সরকার তাঁকে আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবই ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি’-তে লেখা হয়েছে যুধাজিতের কথা। বাংলার দুই গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া এবং সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে জায়গা পেয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘সেরা সৃজনশীল শিশু’ পুরস্কার।

chess blind Draupadi Murmu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy