Advertisement
E-Paper

এক্সক্লুসিভ বিরাট: আমার এই টিম ব্যক্তিপুজোয় বিশ্বাস করে না

একের পর এক রেকর্ড গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁর রথ। সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা তো বটেই, সচিন-ভিভ-পন্টিংদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সর্বকালের সেরাদের দৌড়েও ঢুকে পড়েছেন তিনি। তবু ব্যক্তিগত মাইলস্টোন নয়, দলগত ভাবনাতেই আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে তাঁকে। এক রাশ নতুন ভাবনা আর পরিণত এক মস্তিষ্কের খোঁজ পাওয়া গেল কথা বলতে গিয়ে। গত এক বছরে ভারতের কোনও সংবাদপত্রে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে তাঁর মনের সন্ধান দিলেন বিরাট কোহালি। সেই সঙ্গে হদিশ দিলেন তাঁর স্বপ্নের টিম ইন্ডিয়ার। অধিনায়ক হিসেবে তাঁর ভাবনা এবং পরিকল্পনা নিয়ে এই প্রথম খোলামেলা। আনন্দবাজার-কে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব।সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম সেরা তো বটেই, সচিন-ভিভ-পন্টিংদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সর্বকালের সেরাদের দৌড়েও ঢুকে পড়েছেন তিনি। তবু ব্যক্তিগত মাইলস্টোন নয়, দলগত ভাবনাতেই আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে তাঁকে।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:২৫
অপ্রতিরোধ্য: বিশ্ব ক্রিকেটে ছুটছে কোহালির রথ। সতীর্থদের কাছে তিনি ক্যাপ্টেন, আবার বন্ধুও। ফাইল চিত্র

অপ্রতিরোধ্য: বিশ্ব ক্রিকেটে ছুটছে কোহালির রথ। সতীর্থদের কাছে তিনি ক্যাপ্টেন, আবার বন্ধুও। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় সেই চারটে সেঞ্চুরি করা টেস্ট সিরিজ থেকে ধরলে দু’বছর হয়ে গেল ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেমন অভিজ্ঞতা হল অধিনায়কত্ব নিয়ে?

বিরাট কোহালি: দারুণ উপভোগ্য একটা যাত্রা। আমি খুব ভাগ্যবান যে, এ রকম তারুণ্যে ভরা, টগবগে একটা দল পেয়েছি। আমরা একটা গ্রুপ। যারা একসঙ্গে কেরিয়ার গড়ছি। এ রকম সৌভাগ্য সবার হয় না। এবং, সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকে সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত। প্রত্যেকে একই ভাবে ভাবছে যে, পরিশ্রম নিয়ে কেউ আপস করব না। সতীর্থদের মধ্যে এ রকম মনোভাব দেখতে পেলে ক্যাপ্টেন উত্তেজিত হয়ে পড়তে বাধ্য। আমারও তাই হচ্ছে।

প্র: এই টিমের কোন জিনিসটা সব চেয়ে উপভোগ্য আপনার কাছে?

বিরাট: প্রত্যেক সিরিজেই আমাদের প্লেটে নতুন কোনও না কোনও খাবার থাকছে। তার কারণ ছেলেরা নতুন অভিযানে ঝাঁপানোর জন্য তৈরি। দলের জন্য যে কোনও ঝুঁকি নিতে তৈরি। এই দু’বছরে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে উপভোগ্য ব্যাপার মনে হয়েছে। ছেলেদের যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসছে। এর পর ক্যাপ্টেনের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে!

প্র: তিন ফর্ম্যাটে অধিনায়কত্ব করাটা কতটা আলাদা চ্যালেঞ্জ?

বিরাট: অনেকটাই আলাদা। আগে যখন টেস্টের অধিনায়ক ছিলাম, শুধু টেস্ট নিয়ে ভাবলেই চলত। এখন তিনটি ফর্ম্যাটেই পরিকল্পনা করতে হয়। ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাটসম্যান হিসেবে কী করতে চান, সেই সময় খুব একটা হাতে থাকবে না। সব কিছু নিয়ে ভাবতে হবে এবং তার মধ্যে থেকেই সাফল্যের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। এটাই চ্যালেঞ্জ আর আমি তাতে বেশ রোমাঞ্চও অনুভব করছি। কেরিয়ারে একটা নির্দিষ্ট সময় কাটানোর পর এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। আর আমি চ্যালেঞ্জকে শুধু মোকাবিলাই করতে চাইনি, বুকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছি বরাবর। কী ভাবে কোনও কঠিন কাজ করা যায়, সেটা আমি আবিষ্কার করতে ভালবাসি। খুব গর্বিতও বোধ করি যে, আমাকে অধিনায়কত্বের এমন একটা গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্র: বলা হয়, ভারত অধিনায়কত্ব মানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পরেই সব চেয়ে কঠিন কাজ। ফুলের মতো কাঁটাও আছে। কয়েক দিন আগে আপনার একটা ছবি দেখলাম। মনে হল চুলে যেন সাদা ভাব দেখা যাচ্ছে।

বিরাট (থামিয়ে দিয়ে): সাদা ভাব না। অনেকই সাদা আছে (হাসি)।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কা সফরে যে রেকর্ডগুলি গড়ল কোহালি অ্যান্ড কোং

প্র: অধিনায়কত্বের চাপ কতটা? কী ভাবে সেই চাপ সামলান?

বিরাট: আমি এম এস-কে (মহেন্দ্র সিংহ ধোনি) খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। মন দিয়ে ওর কথা শুনেছি। কত বছর ধরে এম এস এই চাপটা সামলেছে! মাঝে-মধ্যে মনে হবে, সত্যি এটা একটা অন্য ধরনের কাজ। নিজে খেলোয়াড় হিসেবে যা করতাম, তার চেয়ে অনেক আলাদা। এক-এক সময় ভারাক্রান্তও লাগতে পারে। তবু আমি মনে করি, দায়িত্ব জীবনের একটা দারুণ ব্যাপার। দায়িত্ব ছাড়া পরিণত হওয়া যায় না। শেখা যায় না। বেড়ে ওঠা যায় না। যত বড় দায়িত্ব, তত বড় পরীক্ষা। আমার মনে হয়, ঈশ্বর দায়িত্ব দিয়ে পরীক্ষা নিতে চান, এই লোকটা কত শক্তিশালী।

প্র: কিন্তু এই যে সাফল্য আর ব্যর্থতায় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া, এটা তো ভিতরে-ভিতরে কাউকে খুব মুষড়ে দিতে পারে।

বিরাট: মাঝেমধ্যে তেমন মুহূর্তও আসতে পারে। কিন্তু একটা জিনিস কী জানেন তো, আমি মনে করি যে, অধিনায়কত্বের এই পদটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমি এটার জন্য আলাদা ভাবে পরিশ্রম করিনি যে, প্লেয়ার হিসেবে দিনে আট ঘণ্টা অনুশীলন করতাম তো অধিনায়ক হতে চাই বলে সেটাকে বাড়িয়ে দিলাম। আমি ক্রিকেটার হিসেবে যা যা করতাম, সেটাই করে গিয়েছি। ভারতীয় ক্রিকেটে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিকদের মনে হয়েছে, এই দায়িত্বটা পালনের উপযুক্ত লোক আমি। তাঁরা সেই কারণে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এ বার আমার কাজ হচ্ছে, বাড়তি পরিশ্রম করে দায়িত্বটা ঠিকঠাক পালন করে তাঁদের সেই আস্থার মর্যাদা দেওয়া।

প্র: মানে আলো-আঁধারি মেশানো এক রাস্তা। কখনও হাসি, কখনও কান্না। এটাই অধিনায়কের জীবন?

বিরাট: আনন্দ-হতাশা মিশিয়ে দু’টো দিকই থাকে। যখন টিম ভাল করে, তখন সবাই অধিনায়কের প্রশংসা করে। আমি মনে করি সেটাও ঠিক নয়। আমার মনে হয় সাফল্য আসে টিমের মিলিত পরিশ্রমের জন্য। একা অধিনায়ককে কৃতিত্ব দেওয়াটা কখনও আমি সমর্থন করি না। আমাদের টিমের মধ্যে সেই স্পিরিটেই কিন্তু আলোচনা হয়। ব্যাপারটা কখনওই ব্যক্তি নির্ভর নয়, দলগত। কিন্তু অধিনায়ককে যে জায়গায় সাহস দেখাতে হয়, তা হচ্ছে টিম যখন ভাল না করে। তখন বেশির ভাগ দায়টাই গিয়ে বর্তায় এক জনের উপর— অধিনায়ক। আর এটা তো ঠিকই যে, সমালোচনা করার জন্য লোকে তৈরি হয়ে বসে আছে। সুযোগ পেলেই হল।

প্র: সমালোচনা হচ্ছে দেখলে নিজেকে কী বলেন?

বিরাট: একটা সময়ের পরে সকলেরই মন শক্ত হয়ে যায়। আমারও তাই হয়ে গিয়েছে। এখন আর পণ্ডিতদের মতামত বা সমালোচনায় কিছু এসে-যায় না। বেশির ভাগ সময় এরা তো জানেই না সিদ্ধান্তটা কোন পরিস্থিতিতে নেওয়া হল। এরা শুধু সিদ্ধান্তটা দেখল আর তার পর নিজেদের মতামত দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজেকে এটাই বলি যে, এদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। গর্বিত বোধ করো যে, এত বড় একটা দায়িত্ব তুমি পেয়েছ। একটা দেশের ক্যাপ্টেন আমি— এর চেয়ে গর্বের ব্যাপার আর কী হতে পারে! নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করতে চাই।

প্র: একটা ছবি দেখছিলাম। টিমের জুনিয়র সদস্য হার্দিক পাণ্ড্যর কাঁধে হাত দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ আপনি টিমের ক্যাপ্টেন। আগে কোনও অধিনায়ক এতটা অন্তরঙ্গ ভাবে জুনিয়রদের সঙ্গে সেলফি তুলছে বলে দেখিনি।

বিরাট: আমি তুলনায় যেতে চাই না। প্রত্যেকের পরিস্থিতি প্রত্যেকের চেয়ে আলাদা। তাই তুলনা করাটা ঠিক হবে না। ওই যে বললাম, আমি ভাগ্যবান সমবয়সি অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে খেলতে পারছি। এর ফলে আমাদের সামনে বন্ধু হিসেবে খেলার সুযোগ এসে গিয়েছে। এই টিমে বেশির ভাগ ছেলের সঙ্গেই আমি যে ভাবে মিশি, বাড়ি গিয়ে নিজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও সে রকমই সম্পর্ক। স্বভাবগত দিক থেকেও আমি এ রকমই। বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতে ভালবাসি, যেটা মনে আসে সেটাই বলি, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করি। আমি যখন সতীর্থদের সঙ্গে থাকি, কখনও ভাবি না যে, ওহ্ আমি তো টিমের ক্যাপ্টেন। তাই আমাকে নির্দিষ্ট একটা ভঙ্গিতেই চলতে হবে বা এটা আমার করা শোভা পায় না। যেখানে ক্যাপ্টেন্সি দরকার, সেখানে আমি ক্যাপ্টেন। না হলে সতীর্থদের কাছে আমি ওদের এক জন নর্ম্যাল বন্ধু। আর আমাদের দলেও সকলের মনোভাব এতটাই বন্ধুত্বপূর্ণ যে, খোলামেলা পরিবেশটাও খুব তাড়াতাড়ি গড়ে উঠেছে। একে অন্যের সান্নিধ্যে আমরা উষ্ণতা অনুভব করি, খুব সহজাত ভাবেই সেটা ঘটে। কাউকে জোর করে এই পারস্পরিক ভাল লাগাটা তৈরি করতে হচ্ছে না।

প্র: গ্রুপ হিসেবে আপনার এবং আপনার এই টিমের লক্ষ্য কী?

বিরাট: প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, এই প্রজন্মের সেরা হওয়া। যে সময়টায় আমরা খেলছি, সেই সময়ের সবচেয়ে সফল টিম হওয়া। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ওপর ফোকাস করা নয়, দলগত প্রাপ্তির দিকে আমরা বেশি নজর দিতে চাই। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত মাইলস্টোন বা পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বড্ড বেশি খেলোয়াড়দের মান যাচাই করা হয়। আমাদের এই টিম ব্যক্তিপুজোয় বিশ্বাস করে না। এখানে পুরো ব্যাপারটাই হয় টিমের প্রত্যাশা অনুযায়ী, টিমের চাহিদা অনুযায়ী। টিমের জন্য ১২০ শতাংশ দাও, এটাই হচ্ছে আমাদের টিমের দলগত মন্ত্র। ব্যক্তিগত গৌরবের পৃথিবীতে কেউ বাস করে না আমাদের টিমে। এটা আমরা সিস্টেম থেকেই বাদ দিয়ে দিতে চাইছি। আমার চোখে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

প্র: বন্ধুত্বের পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এ ব্যাপারে অধিনায়কের ভাবনাটা আরও গভীরে গিয়ে শুনতে চাই।

বিরাট: মাঠের মধ্যে জয় করার পাশাপাশি মাঠের বাইরেও আমাদের একটা লক্ষ্য আছে। আমাদের এই গ্রুপটা যেন আজীবন বন্ধুই থেকে যেতে পারি। খেলা ছাড়ার পরে এখন থেকে পনেরো-কুড়ি বছর বাদেও যদি এই সম্পর্কটা ধরে রাখতে পারি, তা হলে সেটা সেরা প্রাপ্তি হিসেবে থেকে যাবে। আমরা সকলেই সেটা করতে চাই। কিছু ব্যক্তি ক্রিকেট খেলার জন্য একজোট হয়েছিল আর কয়েক বছর ধরে তারা একসঙ্গে একটি দলের হয়ে খেলেছিল, এ রকম হয়ে থাকতে চাই না। আমরা হতে চাই এক দল বন্ধু, যারা একসঙ্গে মাঠে খেলতে নেমেছিল। দু’টোর মধ্যে অনেক, অনেক তফাত।

(চলবে)

Virat Kohli Indian Cricket Team Sri Lanka Celebrity Interview বিরাট কোহালি ভারত
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy