বাঙালি মানেই বেশ লুচি-তরকারি, মাছ-ভাত খাওয়া চেহারা। মোটা না হলেও ছোট্ট একটা ভুঁড়ি তো থাকতেই হবে। আর সেই ভুঁড়ি কমাতে গেলে নাকি ওট্স, চিয়া বীজ আরও কী সব যেন খেতে হবে। দু’দিনের বেশি মুখে রোচে নাকি ওসব? কিন্তু এ বছরে ডায়েটের নিত্য নতুন ধারায় গা ভাসিয়েছেন বাঙালিরাও। কেউ খাচ্ছেন শুধু মাছ-মাংস, কেউ আবার আমিষ দেখলেই নাক সিঁটকাচ্ছেন। কেউ খাচ্ছেন এক বেলা, আবার কেউ সব খেয়েও ওজন কমিয়ে ফেলছেন। সে সব ডায়েটের যেমন গালভরা নাম, তেমনই কাজ। এখনকার প্রজন্ম আবার স্রেফ রোগা হওয়ার দিকেই ঝুঁকছেন না। শরীর ভাল রাখাটাও জরুরি। তাই অসুখবিসুখ বিচার করেও একগুচ্ছ নতুন ডায়েট এসেছে। খাওয়ার ধরন, অভ্যাস ও সময়ও সেখানে বিচার্য। নিজের মর্জি মতো খাওয়ায় যে রাশ টানতে হবে, তা বেশ বুঝে নিয়েছেন বাঙালিরাও। খাওয়াদাওয়ার ধরনেও তাই এসেছে বিস্তর বদল। এ বছর ডায়েটে কী কী বদল এল, তা এক বার দেখে নেওয়া যাক।
বাঙালির ‘মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট’
ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট বা ‘মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট’ নিয়ে ইদানীংকালে চর্চা খুব বেশি। ভূমধ্যসাগরের আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা এমন ডায়েট মেনে চলেন যাতে তাঁদের ওজন বাড়ে না, শরীর সুস্থ থাকে এবং বার্ধক্যও আসে দেরিতে। সেই ডায়েট পুরোপুরি উদ্ভিজ্জ খাবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের উপরেই নির্ভরশীল। তবে সে সব দেশের লোকজন যা খান, এ দেশের জলবায়ুতে তা ফলেই না। তা হলে উপায়? ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) ভারতীয়দের জন্যও একটি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডপ্টেড মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট’ (আইএএমডি) তৈরি করে ফেলেছে। রোজ যে সব সব্জি বা ফল খান, তার মধ্যে থেকে বেছে বেছেই তৈরি হয়েছে খাবারের তালিকা। পরিবেশ, আবহাওয়ার কথাও মাথায় রাখা হয়েছে। যেমন, একস্ট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের বদলে দেশি ঘি দিয়ে রাঁধলেই হয়। মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটে বুলগুর, ফারো, কিনোয়ার বদলে খেতে পারেন ডালিয়া, ব্রাউন রাইস, জোয়ার, বাজরা বা রাগি। থাইম, রোজ়মেরির মতো মশলার দেশীয় বিকল্প তুলসি, জিরে, জোয়ান, জায়ফল ও জয়িত্রী। বিভিন্ন রকম ডাল, ছোলা, রাজমাও রয়েছে ডায়েটের তালিকায়।
এ বছর ডায়েটে কী কী বদল এল? ছবি: ফ্রিপিক।
মাছ-মাংস-ডিমে ঠাসা ‘অ্যাটকিন্স ডায়েট’
সকালে খেলেন ডিম আর বেকন। দুপুরে স্মোকড ফিশ। রাতে মাখনে মাখামাখি চিকেন বা মাটন স্টেক বা চিজ়ে ভরপুর বেকড ফিশ। এক দিন-দু’দিন নয়, রোজ৷ এবং খাওয়ার পরও দেখলেন দিব্য কমছে ওজন। পঞ্চব্যঞ্জন খেয়ে অভ্যস্ত বাঙালিও রোজের খাওয়া থেকে ভাত-রুটি ছেঁটে ফেলে, শুধু মাছ-মাংস বা ডিম খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। কম কার্বোহাইড্রেট ও হাই-প্রোটিন এই ডায়েটের নাম অ্যাটকিন্স ডায়েট। অর্থাৎ, শুধু মাছ, মাংস ডিম খেয়ে ওজন কমিয়ে ফেলার কৌশল। অনেকে অবশ্য চিজ়, মাখন এগুলো এড়িয়ে চলেন। বরং বাদাম, অল্প অলিভ অয়েল বা সামান্য ঘি-তে নাড়াচাড়া করা খাবারই খান। এই ডায়েটের প্রথম পর্যায়ে মাছ, মটন, চিকেন, মুসুর ডাল— অর্থাৎ, প্রোটিন খাওয়া যায় ইচ্ছা মতো৷ তবে মাংস থেকে চর্বি কেটে বাদ দিতে হয়৷ প্রোটিন হিসেবে বেশি করে দুধ, দই, ছানা, চিজ়, সয়াবিন, বাদাম ও বীজ খেতেহয়। মোট কথা, নো কার্বস, লো ফ্যাট আর ভরপুর প্রোটিনেই লুকিয়ে ওজন কমানোর মন্ত্র।
ব্যালান্সড ডায়েটের পাশাপাশি একগুচ্ছ নতুন ডায়েটও এসেছে এ বছরে। ছবি: ফ্রিপিক।
ভোজনরসিকদের জন্য ‘ফ্লেক্সিটেরিয়ান ডায়েট’
খেতে ভালবাসেন যাঁরা, আবার ওজনও কমাতে চান, তাঁদের জন্য এই ডায়েট। ক্যালোরি মেপে তরিতরকারি, মাছ, চিকেন—ফ্লেক্সিটেরিয়ান ডায়েটে সবই খাওয়া যায়। শুধু মাছ-মাংস বা কেবল নিরামিষ খাবার যাঁদের পছন্দ নয়, আবার ভিগান হতেও ঘোর অনীহা, তাঁদের জন্য এই ডায়েট মেনে চলা সহজ। ওট্স, কিনোয়া, ব্রাউন রাইস, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, সয়াবিন, আনাজপাতি, মরসুমি ফল খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।দুধ, দই, পনির ইত্যাদি দুগ্ধজাত খাবার, বিভিন্ন ডালও খাওয়া যাবে। সঙ্গে ডিম, গ্রিল করা মাছ, চিকেন সপ্তাহে দু’-তিন দিন খাওয়া যায়। খাবারে তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। পিনাট বাটার, আমন্ড বাটার, অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন।প্যাকেটজাত এবং প্রক্রিয়াজাত কোনও উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ খাবার একেবারেই চলবে না। সঙ্গে চিনি এবং ময়দাও এই ডায়েটে বারণ। প্রয়োজনে মধু খেতে পারেন। ফাইবার সমৃদ্ধ এবং কম ক্যালোরিযুক্ত হওয়ায় নিয়মিত এই ডায়েট অনুসরণে হজমশক্তি বাড়ে, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে। ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। দীর্ঘ সময় যাবৎ এই ডায়েট অনুসরণ করা সহজ।
সব খেয়েও ডায়েট করা যায়। ছবি: ফ্রিপিক।
রজোনিবৃত্তি পর্বের ঝক্কি কমাবে ‘মেনোপজ ডায়েট’
হরমোনের গোলমালে মেদ জমে পেটে। মহিলারাই বেশি ভোগেন এতে। ভারতীয় মহিলারা চল্লিশ পেরনোর পর থেকে এবং রজোনিবৃত্তি পর্বে পৌঁছে, ওজন বৃদ্ধি নিয়ে নানা সমস্যায় পড়েন। এর কারণ হল ইস্ট্রোজেন নামক এক হরমোনের গোলমাল। ঋতুচক্র থেকে শুরু করে শরীরের গড়ন, সন্তানধারণ, বিপাকক্রিয়া— সবেতেই এর ভূমিকা রয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব অনেক মহিলাই পেটের চর্বি নিয়ে চিন্তিত, যাকে বলে ‘মেনোপজ় বেলি ফ্যাট’। এটি কেবল খাওয়াদাওয়ার অনিয়মে হয় না। এর জন্য সেই ইস্ট্রোজেন হরমোনই দায়ী। এই হরমোনকে কব্জা করতে পারবে এমন ডায়েট এসেছে এ বছরে, যার নাম ‘মেনোপজ় ডায়েট’। খুব বেশি কঠিন কিছু নয়, খেতে হবে প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম। নিরামিষের মধ্যে নানা ধরনের ডাল, সয়াবিন, ছানা বা পনির। তাজা ফল খেতে হবে রোজ একটি করে। চা-কফি না খেলেই ভাল, মদ ছোঁয়া যাবে না। চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, পাঁঠার মাংস পুরোপুরি বাদ দিতে হবে।
কী খাবেন সকালে, দুপুরে আর রাতের মিল কেমন হবে, তালিকা বানিয়ে ফেলুন এখনই। ছবি: ফ্রিপিক।
পিসিওএস বড় চিন্তার, সে জন্যও আছে ডায়েট
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) থাকা মানেই নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া, তা নয়। পিসিওএস নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাওয়াদাওয়া নিয়ম মেনে করতে হয় ঠিকই, তবে পছন্দের খাবারও খাওয়া যায়। ভাত-রুটি কম খেয়ে বরং বেশি করে শাকসব্জি, মরসুমি ফল এবং দানাশস্য যেমন ওট্স, কিনোয়া, ডালিয়া খেতে বলেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদেরাই। অন্য দিকে, দুধ, মাখন, ছানা, চিজ়ও কম খেলে ভাল হয়। পিসিওএস হলে শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়। তাই রক্তে শর্করা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। অতএব জাঙ্ক খাবার একেবারেই চলবে না। মাঠাওয়ালা দুধ, দুগ্ধজাত খাবার যেমন মাখন, ঘি, মিষ্টি, সব রকমের মিষ্টিস্বাদযুক্ত খাবার যেমন, চিনি, মধু, গুড়, লজেন্স, আইসক্রিম, কেক, পেস্ট্রি, প্যাকেটজাত ফলের রস, মদ খাওয়া চলবে না। আনাজপাতির মধ্যে মেপে খেতে পারেন রাঙা আলু, কচু, কাঁচা কলা, মুলো, গাজর, কুমড়ো ও এঁচোড়। ফলের মধ্যে মুসাম্বি, কমলালেবু, পাকা পেঁপে, আপেল ইত্যাদি।
‘ওয়ান মিল আ ডে’
দিনে এক বার খেলেই চলবে? পরিণাম যা-ই হোক, চটজলদি ফলের আশায় আকৃষ্ট হয়ে, তারকা থেকে সাধারণ মানুষ বেছে নিচ্ছেন ‘ওয়ান মিল আ ডে’ বা ‘ওম্যাড ডায়েট’। এর আরও একটা নাম আছে ‘ওয়ারিয়র ডায়েট’। দিনে এক বার খাওয়ার ডায়েট চার্ট নিয়ে ইদানীংকালে অনেক তারকাও কথা বলছেন। আর সমাজমাধ্যমেও এই ডায়েট অনুসরণ করার প্রবণতা নিয়ে চর্চা বেড়েছে। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়েরই একটা ধরন হল ওম্যাড ডায়েট, যেখানে টানা ১৪-১৬ ঘণ্টা বা ২২ ঘণ্টা অবধি ভারী খাবার না খেয়ে দিনে মাত্র এক বার সম্পূর্ণ মিল খাওয়া হয়। চটজলদি সুফল বলতে শরীরে মেদবৃদ্ধি হতে না দেওয়া, রক্তে গ্লুকোজ়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা এই ডায়েটের ইতিবাচক দিক। একবেলা সুষম আহার করতে হয়, তাতে ভাত-রুটি, মাছ-মাংস, ডিম, ডাল যা খুশি খেতে পারেন। বেশি করে জলও খেতে হয়। তার পর সারাদিনে আর কিচ্ছুটি মুখে তোলা যাবে না। এই ধরনের ডায়েট প্ল্যান চটজলদি কিছু সুফল দেয় ঠিকই, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কেও সচেতন থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘ দিন ধরে ওয়ান মিল ডায়েট অনুসরণ করলে প্রেশার, সুগার ফল করা কিংবা কিডনি স্টোন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতোই এই ডায়েট করা উচিত।
খেতে হবে ঘড়ি ধরেও। ছবি: ফ্রিপিক।
চেহারায় ফোলা ভাব কমাবে ‘অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ডায়েট’
বিদ্যা বালন, সমান্থা রুথ প্রভুর মতো অভিনেত্রীরা সম্প্রতি এই ধরনের ডায়েটের কথা বলেছেন। হরমোনের গোলমালে শরীর ফুলে গেলে সাধারণ ডায়েটে খুব একটা কাজ হয় না। তখন প্রদাহরোধক খাবারদাবারই খেতে হয়। এই খাদ্যাভ্যাসের মূলে হল এমন খাবার বেছে নেওয়া যা প্রোটিন, ওমেগা ৩, ভিটামিন সি, ফাইবারে ভরপুর। হলুদ বা কমলা রঙের ফল যেমন পেঁপে, পেয়ারা, আম, ডিমের কুসুম ও ছোট মাছ ভিটামিন এ-তে ভরপুর। আমলকি, কমলালেবু, পেয়ারা বা কাঁচা আমে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। মেথি, পালং, সর্ষে শাক খেলে পাবেন অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। ইলিশ বা রুই, কাতলা, সয়াবিন, তিসির বীজ খেলে পাওয়া যাবে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। চিনির বদলে খেতে হবে গুড়। কফির বদলে গ্রিন টি বা যে কোনও ভেষজ চা। ময়দা, চিনি, ভাজাভুজি বা অতিরিক্ত তেল-মশলাযুক্ত খাবারের মায়া কাটিয়ে ফেলতে হবে চিরতরে।
মন ভাল রাখার ‘মাইন্ড ডায়েট’
খুব নতুন কিছু নয়। তবে ড্যাশ ডায়েট এ বছরে নতুন রূপে ধরা দিয়েছে, যার নামকরণ হয়েছে ‘মাইন্ড ডায়েট’। ড্যাশ ডায়েটের নিয়ম আর মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটের বাহার— দুই জুড়ে গিয়ে হয়েছে ‘মাইন্ড ডায়েট’। খাওয়াদাওয়া এমন হবে যাতে স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ কম হয়। পেট ভাল থাকে, সঙ্গে মনও। মানসিক চাপ কমে, পাশাপাশি ওজনও। এই ডায়েটে পেট ভরে খেতে হয় ফল, তাজা শাকসব্জি, বাদাম, বীজ, দানাশস্য, মাছ। বাদ দিতে হয় রেড মিট, চিনি, নুন, মিষ্টি পানীয় ও প্যাকেটজাত খাবার। এই ডায়েটে ফ্যাট খেতে মানা নেই। তবে তা যেন স্বাস্থ্যকর ফ্যাট হয়। ‘মাইন্ড ডায়েট’ গবেষকমহলে এতটাই সাড়া ফেলেছে, যে দাবি করা হচ্ছে এই ডায়েট ঠিকমতো মেনে চললে অবসাদ, স্মৃতিনাশ, অ্যালঝাইমার্সের মতো জটিল রোগেরও মোকাবিলা করা সম্ভব।