জন্মদিনের আগের সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে চুনী গোস্বামী। শনিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
আজ রবিবার তাঁর ৭৯তম জন্মদিন। এখনও নিয়মিত তাঁকে দেখা যায় সাউথ ক্লাবে। মাঝেমধ্যে চলে আসেন ময়দানে। মোহনবাগান তাঁবুতেও। শনিবার জন্মদিনের আগের বিকেলে সেই কিংবদন্তি চুনী গোস্বামী আনন্দবাজারের সামনে। একান্তে দিলেন বহু বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর।
প্রশ্ন: আপনি কয়েক দিন আগে মোহনবাগান মাঠে প্র্যাকটিস দেখতে গিয়েছিলেন। অনেকেই আটাত্তরের টিমের সঙ্গে তুলনা করছেন এ বারের সঞ্জয় সেনের টিমকে। আপনি?
চুনী: তুলনায় যাব না। এক-একটা টিম এক এক সময়ের সেরা। ওভাবে তুলনা হয় না। তবে সনি-জেজে ছাড়াও অনায়াস জয় পাচ্ছে সঞ্জয়ের টিম। তার মানে টিমটা যথেষ্ট শক্তিশালী। আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হতেই পারে। দু’টো ম্যাচেই দেখলাম দ্বিতীয়ার্ধটা তো খুবই ভাল খেলছে। তবে গতি বাড়ানো দরকার। একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা পাস খেলতে হবে।
প্র: সনি নর্ডিকে রিসিভ করতে রাত দু’টোয় শ’দেড়েক বাগান সমর্থক এয়ারপোর্টে। সাম্প্রতিক কালের কোনও ফুটবলারকে নিয়ে এ রকম উন্মাদনা দেখেনি শহর। সনি কি চুনীর চেয়েও বড় মাপের ফুটবলার?
চুনী: বড় না ছোট, সেটা আমার বলা ঠিক হবে না। তবে আমাদের সময়ে জন্মালেও সনির যা প্রতিভা তাতে অনায়াসে সুযোগ পেত তখনকার বাগান টিমে। এটা বলতে পারি, ছেলেটা ঠিক আমার মতো খেলে। গতির সঙ্গে আউটসাইড ও ইনসাইড দুটো ডজই করতে পারে। এবং সেটা বল কন্ট্রোলে রেখে। ড্রিবলটাও ভাল। কমপ্লিট ফুটবলার। ওকে দেখলে আমার নিজের খেলার সময়ের কথা মনে হয়।
প্র: মজিদ বাসকার, চিমা, হোসে ব্যারেটো, সনি নর্ডি— র্যাঙ্কিংটা ঠিক কী হবে?
চুনী: মজিদ, ব্যারেটো, সনি সমমানের। চিমা ওই ক্লাসের নয়। তবে এখন যে বিদেশিরা আই লিগে খেলছে তাদের মধ্যে এক নম্বর কিন্তু সনি-ই।
প্র: আই লিগ এবং আইএসএলের মিলন নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। আপনি কোন দিকে?
চুনী: কী ভাবে মিলবে জানি না। তবে এক দেশে একটাই লিগ থাকা উচিত। আবার এটাও বলছি, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো টিমকে না নিলে আইএসএলের মৃত্যু অনিবার্য। এ বারই তো দেখলাম আইএসএল নিয়ে আগ্রহ কত কমে গেছে। শতবর্ষের ঐতিহ্য যাদের আছে, আছে কোটি-কোটি সমর্থক— তাদের বাদ দিয়ে দেশের এক নম্বর লিগ হয় নাকি?
প্র: কিন্তু আটলেটিকো দে কলকাতার কর্তারা চাইছেন এক শহরে একটাই টিম থাকুক। এটাতে আপনার সমর্থন আছে?
চুনী: এটা একেবারেই ভুল ভাবনা। মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টারের ক’টা টিম ওদের দেশের সেরা লিগ খেলে? আর কলকাতার ফুটবল আবেগ ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান ছাড়া হয় না কি? এই তিনটে ক্লাবের সমর্থক তো ঘরে ঘরে। এটিকে তো গত কালের ক্লাব! ওদের কোনও ঐতিহ্যও নেই। আর ক্লাব ছাড়া কোনও দেশের ফুটবলের উন্নতি সম্ভব নয়।
প্র: অনেকেই আপনাকে ফুটবলের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন। দু’জনেই ব্যক্তিত্ব, গ্ল্যামার এবং চেহারায় এখনও চিরসবুজ। সৌমিত্র আশি পেরিয়েছেন, আপনি আশি থেকে এক ধাপ দূরে। তুলনাটা কেমন লাগে?
চুনী: সৌমিত্রবাবু নিজের জগতে মাইলস্টোন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা উত্তমকুমারও নিজের জায়গায় সেরা। অধিনায়কত্ব করে আমি দেশকে এশিয়াডে সোনা এনে দিয়েছি। তিনবার রানার্স। ভারতীয় বা ক্লাব ফুটবলে যে সাফল্য আমি পেয়েছি তা কারও নেই। তুলনা কেউ টানলে তাই ভালই লাগে। তবে আমি বলব, চুনী গোস্বামীকে লোকে মনে রাখুক গ্ল্যামারের জন্য নয়, মনে রাখুক ড্রিবলিং-এর জন্য।
প্র: আপনি একজন কিংবদন্তি ফুটবলার। কোচিং-এ এলেন না কেন?
চুনী: কোচিংটা আমার জন্য নয় বলে আসিনি। আমি নিজেকে ওই জায়গায় ফিট, কখনও মনে করিনি। আর প্রদীপ-অমলরা যখন কোচিং করছে তখন তো আমি চুটিয়ে ক্রিকেট খেলছি। তবে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরির দায়িত্ব যখন নিয়েছিলাম তখনও আমি হাবিব-কে কোচ করে নিয়ে গিয়েছিলাম সে জন্যই। কোচিং করাইনি বলে তাই কোনও দুঃখ নেই। বরং পরম তৃপ্ত যা করেছি তা নিয়ে।
প্র: কয়েক মাস আগে আপনার নেতৃত্বে ১৯৬২-র এশিয়াডের সোনাজয়ী টিমের কিপার প্রদ্যোত বর্মণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আনন্দবাজারে লিখেছিলেন, ‘বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, আমারও তো বয়স বাড়ছে’। নট আউট ৭৯-তে দাঁড়িয়ে কেন আপনি জীবন সম্পর্কে এমন দার্শনিক?
চুনী: খারাপ তো লাগেই। তবে ভরসা পাই পিকে-বলরাম এখনও রয়েছে বলে। আমি আরও কিছু দিন বাঁচতে চাই। সুস্থ থেকে বাঁচতে চাই। মৃত্যু তো অমোঘ। একদিন আসবেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো সবাই বাঁচতে চায়। আরও কিছু বছর ভাল ফুটবল, ভাল ক্রিকেট, ভাল টেনিস দেখতে চাই। তিনটেই তো আমি খেলেছি। আমার কোনও ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, দুঃখ নেই। যা পেয়েছি সেটা ক’জন পায় এটা ভেবেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy