হিরো কাপের টিভি সম্প্রচার নিয়ে সিএবি-র লড়াই ব্লু প্রিন্ট হয়ে গেল ভারতীয় বোর্ডের কাছে। এর পরের বছরেই ১৯৯৪ সালে ঐতিহাসিক চুক্তি সই করল বোর্ড। ট্রান্স ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশানল (টিডব্লিউআই) এবং ইএসপিএন যৌথ ভাবে সেই স্বত্ব জিতে নিল। পাঁচ বছরের জন্য বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করল তারা। প্রথমে ওরা প্রস্তাব দিয়েছিল প্রত্যেক বছরে ২.৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৭.৬২ কোটি টাকা) দেবে। সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচের জন্য দেবে ২ লক্ষ মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১২.৮১ কোটি টাকা)। পরে সেটাকে দরাদরি করে আরও বাড়ানো হল। ১৯৯৪-এর জুলাই মাসে চুক্তি সাক্ষর হল যে, ইএসপিএন-টিডব্লিউআই বছরে ৩.৫ মিলিয়ন ডলার করে দেবে। ভারতীয় মুদ্রায় যেটা ছিল ২২.৪৩ কোটি টাকা।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সেই অর্থের মুখ দেখা শুরু হল। তার আগের বছরই বোর্ডের ব্যালান্স শিটে দেখানো হয়েছিল, বোর্ড ৮৪ লক্ষ টাকা ঘাটতিতে চলছে। ঐতিহাসিক টিভি চুক্তিতে দেনার দায়ে আতঙ্কিত বোর্ডের যেন শাপমুক্তি ঘটল। ক্রিকেটের বাণিজ্যিকরণ ঘটেছিল জগমোহন ডালমিয়ার নেতৃত্বেই। আমি ছিলাম ডালমিয়ার আইনি দলে। তাই কাছ থেকে সেই বিপ্লব দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আই এস বিন্দ্রা এবং মাধব রাও সিন্ধিয়া— এই দু’জনের কথাও বলতে হবে। ওরা দু’জনেই বোর্ডের এই বাণিজ্য অভিযানে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
তবে মূল নকশা বানিয়েছিল ডালমিয়াই। ও বুঝতে পেরেছিল যে, টিভি স্বত্বই হচ্ছে টাকা রোজগারের আসল মাধ্যম। যদি টিভি স্বত্ব বেচতে পারি, তা হলে মাঠের মধ্যে নানা বিজ্ঞাপনের জন্যও পয়সা আসবে কারণ পণ্যের বিজ্ঞাপন বহু লোকে টিভি-তে দেখতে পাবে। ভাল সম্প্রচার গুণ সহকারে টিভি-তে খেলা দেখানো মানে অন্যান্য স্পনসরও আগ্রহ দেখাবে। আর সত্যি হলও তাই। এর পর জার্সি ও অন্যান্য সরঞ্জামের স্পনসর আসা শুরু হয়ে গেল। ১৯৯৪-’৯৫ মরসুমেই ঘটল ক্রিকেটের আর্থিক জোয়ার। আর সেই জাগরণে পাল্টে গেল ক্রিকেটই।
আরও পড়ুন: লাইভ ম্যাচ সম্প্রচারে দূরদর্শনকেই টাকা দিয়েছিল বোর্ড!
এখন ক্রিকেট বোর্ড অটো পাইলট মোডে চলে গিয়েছে। এত ডামাডোলের মধ্যেও আইপিএলের মিডিয়া রাইট্স রেকর্ড অর্থে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই দিনটা রাতারাতি আসেনি। অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে এই জায়গাটা তৈরি করতে হয়েছিল। অনেক সময়ই ডালমিয়া ও তার টিমের সদস্যদের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মন্ত্রীদের সঙ্গেও লড়তে হয়েছে। তার ফল সব সময় ভাল হয়নি। ডালমিয়া কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা করত। দূরদর্শনের সঙ্গে তিক্ত লড়াইয়ের পরেই ওর অনেক গুলো চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। কেন্দ্রের প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ফল ছিল সেটা। তবু হার মানেনি। দূরদর্শনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিদেশি টিভি সংস্থার সঙ্গে মোড় ঘোরানো চুক্তি করেই ছেড়েছিল।
আইপিএলের নতুন চুক্তি সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। মিডিয়া স্বত্ব থেকে বছরে আসবে ৫১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৩২৬৯ কোটি টাকা মতো। সেটা আইপিএল নামক টি-টোয়েন্টি ধমাকার জন্য সম্ভব হয়েছে। একে তো দারুণ গতি কুড়ি ওভারের খেলায়। তার উপর শহর বনাম শহরের দ্বৈরথের অভিনব ভাবনা। বলিউড তারকাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক হিসেবে যোগ করাটাও বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে কাজ করেছে। এর জন্য ললিত মোদীর কৃতিত্ব প্রাপ্য। আইপিএল কিন্তু ওরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
ডালমিয়া খুব একটা টি-টোয়েন্টি সমর্থক ছিল না। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে টেস্ট এবং ওয়ান ডে ক্রিকেটে আর্থিক জোয়ার শুরু হয়েছিল ইডেন থেকেই। ক্রিকেটে টাকা আনার পথিকৃৎ ছিল ডালমিয়াই। আইসিসি প্রধান হওয়ার পরে বিশ্বকাপকেও দারুণ লাভজনক ইভেন্টে পরিণত করেছিল ও। আইসিসি-তে প্রথম যখন ডালমিয়া প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসল, ওদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ছিল ২৬,০০০ পাউন্ড। বিশ্বকাপে তখন ছিল টাইটেল স্পনসর। আইসিসি-কে একটা ন্যূনতম টাকা দিয়ে তারাই সব নিয়ে চলে যেত। এখন হয়তো বিশ্বাস করাই কঠিন হবে যে, সেই সময় প্রত্যেকটি সদস্য দেশকে বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম-এর (অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং) জন্য ১০,০০০ পাউন্ড করে দিতে হতো।
ডালমিয়া এসে টাইটেল স্পনসর তুলে দিয়ে বিশ্বকাপকে আইসিসি ইভেন্ট করে দিল। সেই কারণে ১৯৯৬-এর পর কখনও আর কোনও স্পনসরের নামে বিশ্বকাপ হয়নি। আগে যেমন ছিল প্রুডেনিশিয়াল বা রিলায়েন্স কাপ। সমস্ত কিছুকে আলাদা আলাদা করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কোনও কিছুই আর ফ্রি-তে পাবে না। আইসিসি-র কোষাগার ভরতে শুরু করল। এর পর মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ চালু করা হল, যা এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নামে হয়। সেটাও প্রথম আবির্ভাবেই দারুণ হিট হল।
ডালমিয়া যখন আইসিসি-তে এসেছিল, কোষাগারে ছিল ২৬,০০০ পাউন্ড। তিন বছর পরে যখন চলে যাচ্ছে, আইসিসি-র ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ৭ মিলিয়ন পাউন্ড। ক্রিকেট-বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী— প্রথম ধরতে পেরেছিল ডালমিয়া। টি-টোয়েন্টি এবং আইপিএলের আগমনে শিখরে পৌঁছেছে সেই রমরমা।
(লেখক সিএবি এবং বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবী। হিরো কাপের ঐতিহাসিক মামলায় লড়েছিলেন সিএবি-র হয়ে)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy