উচ্ছ্বাস: ডার্বিতে গোলের পরে ভাইচুং ভুটিয়ার উৎসবের এই ভঙ্গিও ছিল ফুটবলপ্রেমীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। ফাইল চিত্র
কলকাতায় পা দিয়েই শুনেছিলাম, ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বির আগে অনেক তারকা ফুটবলারই নাকি উৎকণ্ঠিত থাকতেন। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার এই অনুভূতি কখনওই হয়নি। আমি মুখিয়ে থাকতাম ডার্বিতে খেলার জন্য। কারণ, এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে কলকাতার পরিবেশটাই বদলে যেত। অদ্ভুত উত্তেজনা হত। ম্যাচের আগের দিন রাতে স্বপ্ন দেখতাম, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লক্ষাধিক দর্শকের সামনে গোল করছি।
আমি কলকাতার ছেলে নই বলেই হয়তো ডার্বির আগে উদ্বেগহীন থাকতে পারতাম। সিকিমে থাকার সময় ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বির কথা শুনেছি। কিন্তু একটা ম্যাচকে ঘিরে যে এ-রকম উন্মাদনা হতে পারে, তার কোনও ধারণা ছিল না। ইস্টবেঙ্গলে সই করার পরে দেখলাম ডার্বির উত্তেজনা। ফুটবল থেকে অবসর নিলেও এখনও ডার্বির প্রসঙ্গ উঠলে উত্তেজনা অনুভব করি। মনে পড়ে যায়, ম্যাচের আগে অনুশীলন শেষ করে ক্লাব তাঁবু ছাড়ার সময় আমাকে ঘিরে ধরে সমর্থকদের গোল করার আর্তি। টিকিটের আবেদন। ডার্বি জয়ের পরে আমাদের কাঁধে তুলে উৎসবে মেতে ওঠা।
আমার দীর্ঘ ফুটবল জীবনে এক বারই শুধু ডার্বির আগে অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৭ সাল। আমি তখন ইস্টবেঙ্গলে। ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ প্রয়াত অমল দত্তের মোহনবাগান। আমাদের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন প্রদীপকুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ম্যাচটাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল। অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমে মোহনবাগান তখন অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটছে। সকলেই ধরে নিয়েছিল, ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে জেতা অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দিলেন মোহনবাগান কোচ। হঠাৎই আমাকে, স্যামি ওমোলো, সোসোকে আক্রমণ করলেন অমল দত্ত। আমার নাম দিলেন ‘চুমচুম’। ওমোলোকে ডাকলেন ‘ওমলেট’ বলে। ‘শসা’ বললেন সোসোকে। জবাব দিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দুই কিংবদন্তি কোচের বাগ্যুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধের আবহ।
আমাকে তাতিয়ে দিয়েছিল অমল দত্তের তাচ্ছিল্যই। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মাঠে নেমেই নিজেকে প্রমাণ করব। এত দিন পরে ওই ম্যাচটার কথা ভাবতে বসলে মনে হয়, প্রতিপক্ষ কোচের তাচ্ছিল্য আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল। ম্যাচটা নিয়ে আরও বেশি ফোকাসড হয়েছিলাম। মনঃসংযোগ বেড়ে গিয়েছিল। আসলে কোনও ফুটবলারের যোগ্যতা নিয়ে যখন কেউ প্রশ্ন তোলে, সমালোচনা করে, তখন তার জেদ বেড়ে যায়। সে মরিয়া হয়ে ওঠে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার জন্য। আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছিল। ম্যাচের আগে যুবভারতীতে আমাদের ড্রেসিংরুমের আবহটাও বদলে গিয়েছিল।
যুবভারতীর গ্যালারিতে দর্শকেরা চিৎকার করছেন। কিন্তু আমাদের ড্রেসিংরুমে সেই সময় একটা পিন পড়লেও যেন শব্দ শোনা যেত। একেবারে থমথমে পরিবেশ। কেউ কথা বলছে না। একেবারে ঝ়ড়ের আগের আবহ। যে-প্রদীপদা (পিকে) তাঁর বিখ্যাত ভোকাল টনিকে ফুটবলারদের তাতিয়ে দিতেন বলে শুনেছিলাম, তিনিও সে-দিন খুব কম কথা বলেছিলেন মাঠে নামার আগে। তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। হিরের দর্পচূর্ণ করে ৪-১ জিতেছিলাম আমরা। হ্যাটট্রিক করেছিলাম আমি। আমার ফুটবল জীবনের সেরা ডার্বি।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, ডার্বির আগে বিভিন্ন মহল থেকে প্রত্যাশার যে-চাপ তৈরি করা হয়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা ফুটবলারদের ভাল খেলতে অনুপ্রাণিত করে। আমি তো অপেক্ষা করতাম কবে ডার্বি খেলব, তার জন্য।
ডার্বিতে যখন আমার অভিষেক হয়, তখন বয়স ছিল সতেরো বছরের একটু বেশি। এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপে গ্রুপ লিগের ম্যাচ ছিল। ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল দুই প্রধান। যদিও সেই ম্যাচে আমি প্রথম দলে ছিলাম না। দ্বিতীয়ার্ধে পরিবর্ত হিসেবে নেমেছিলাম। গোল পাইনি।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, ডার্বির জন্য কী ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতাম? কোনও বিশেষ ডায়েট কি থাকত? বিশ্বাস করুন, ডার্বির জন্য বিশেষ কোনও খাবার খেতাম না। তবে যেটা করতাম, সেটা হচ্ছে— ম্যাচের দু’দিন আগে থেকে সব সময় শুধু ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতাম। সজাগ থাকতাম, কোনও অবস্থাতেই মনের মধ্যে যেন নেতিবাচক ভাবনা ঢুকতে না-পারে। ডার্বি এমন একটা মঞ্চ, যেখানে অনেক অঙ্ক কষে খেলতে হয়। এই ম্যাচকে ঘিরে উন্মাদনা তুঙ্গে থাকে। সর্বত্র শুধু ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ম্যাচ নিয়েই আলোচনা হয়। কিন্তু মাঠে নামার পরে ফুটবলারদের তাতে গা ভাসালে চলবে না। ধৈর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি, ডার্বির সাফল্য নির্ভর করে ফুটবলারদের মানসিকতার উপরে। তুমি কী করতে চাও, সেটা ঠিক করেই মাঠে নামতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনও অবস্থাতেই যেন মনঃসংযোগ নষ্ট না-হয়। তৃতীয়ত প্রত্যাশার চাপ থাকবেই। তা যেন আত্মবিশ্বাসে থাবা বসাতে না-পারে। অর্থাৎ মনের ভারসাম্য যেন কোনও অবস্থাতেই নষ্ট না-হয়।
ডার্বিতে হ্যাটট্রিক
অমিয় দেব (মোহনবাগান) ৪ গোল, দ্বারভাঙা শিল্ড, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮।
অসিত গঙ্গোপাধ্যায় (মোহনবাগান) ৩ গোল, রাজা মেমোরিয়াল শিল্ড, ৬ অগস্ট ১৯৩৭।
ভাইচুং ভুটিয়া (ইস্টবেঙ্গল) ৩ গোল, ফেডারেশন কাপ, ১৩ জুলাই ১৯৯৭।
চিডি এডে (মোহনবাগান) ৪ গোল, আই লিগ, ২৫ অক্টোবর ২০০৯।
ডার্বি যেমন আমাকে উজাড় করে দিয়েছে, তেমন যন্ত্রণাও দিয়েছে। এখনও ভুলতে পারব না। সেটাও ১৯৯৭ সাল। কলকাতা লিগে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ম্যাচ। দীপেন্দু বিশ্বাসের বিতর্কিত গোলে জিতেছিল মোহনবাগান। আমি এখনও মনে করি, জোর করে আমাদের হারানো হয়েছিল। ওই ম্যাচের রেফারি উদয়ন হালদার দু’বার বাঁশি বাজিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করায় পরে নির্বাসিত হয়েছিলাম। এই ডার্বিকে আমি একেবারেই মনে রাখতে চাই না। আশা করব, রবিবার যুবভারতীতে এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy