বিদায়: চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোক ময়দানে। ফাইল চিত্র
কলকাতা লিগে ১৯৭৯ সালের সেই ডার্বিটা ছিল আমার প্রিয় বন্ধু চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম যন্ত্রণার দিন। ওর ব্যাকপাস থেকেই গোল করেছিল মোহনবাগানের মানস ভট্টাচার্য। লাল-হলুদ সমর্থকেরা কাঠগড়ায় তুলেছিলেন চিন্ময়কেই। তার পরে ও মাঠে নামলেই গ্যালারি থেকে ‘ব্যাকপাস’ বলে বিদ্রুপ করা হত। যত দিন খেলেছে, তত দিন চিন্ময়কে এই কটাক্ষের শিকার
হতে হয়েছে।
রবিবার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের দুপুরে আমার প্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকেই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। সে দিনের ওই ম্যাচটায় ভুল তো একা চিন্ময় করেনি, আমিও সমান ভাবে দায়ী। আমি যদি একটু সতর্ক থাকতাম, তা হলে হয়তো ওই বিপর্যয় এড়ানো যেত। পাশাপাশি, প্রশংসা করতে হবে মানসেরও। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় গোলটা করেছিল।
কলকাতা লিগের ওই ডার্বির পরে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল চিন্ময়। ওর মনটা ছিল খুবই নরম প্রকৃতির। মাঠে ও মাঠের বাইরে চিন্ময়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। বিনা লড়াইয়ে বিপক্ষের ফুটবলারদের এক ইঞ্চি জমিও ছাড়ত না। শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেত। কিন্তু মাঠের বাইরের চিন্ময় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। কথা খুব কম বলত। কখনও কারও সঙ্গে ওকে ঝগড়া করতে দেখিনি। আমরা তখন মহমেডানে। ডিসিএম ট্রফি খেলতে দিল্লি গিয়েছি। সে দিন সম্ভবত কালী পুজো ছিল। আমাদেরই এক সতীর্থ চিন্ময়ের পায়ের মধ্যে আতসবাজি ফাটিয়েছিল। ওর প্যান্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। অন্য কেউ হলে সে দিন হয়তো রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেত। চিন্ময় শুধু হেসে বলেছিল, “আমি যদি মরে যেতাম?”
আমার সঙ্গে চিন্ময়ের বন্ধুত্ব প্রায় ৪৭ বছরের। একমাত্র আমার সঙ্গেই ও মন খুলে কথা বলত। শুধু সেই ডার্বির পরে আমার সঙ্গেও কোনও কথা বলেনি। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলাম চিন্ময়কে। ওই ম্যাচে অন্য কেউ থাকলে আমাকে ছেড়ে কথা বলত না। কারণ, ভুল আমারও কিছু কম ছিল না। চিন্ময় ম্যাচ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। মাসখানেক লেগেছিল ওর এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে। একটি সাক্ষাৎকারে মজা করেই বলেছিলাম, আমি সবচেয়ে ভয় পাই চিন্ময়ের ব্যাকপাসকে! পরে নিজের উপরেই খুব রাগ হয়েছিল। এই কথা কেন বললাম? চিন্ময় যথারীতি কিছুই বলেনি। যদিও বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মন্তব্যে খুব কষ্ট পেয়েছে। চিন্ময় এ রকমই।
চাকরি নেই। প্রবল আর্থিক সমস্যা। কিন্তু চিন্ময় কখনও কারও কাছে সাহায্য চায়নি। নিজের মতো চেষ্টা করে গিয়েছে অর্থ উপার্জনের। এতটাই আত্মসম্মানবোধ ছিল ওর। আর ছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব অন্তপ্রাণ।
আশির দশকের একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন পুজোর সময় ফুটবলারদের অর্থ দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু ক্লাবের কাছে অত টাকা ছিল না। সমস্যা সমাধান করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চিন্ময়। ও পল্টুদাকে (দীপক দাস) বলল, কয়েক দিন আগেই ৫০ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে
জমা দিয়েছে। ও সেটা তুলে আনতে পারে। এবং তা করলও। সেই টাকাই দেওয়া হয়েছিল
ফুটবলারদের! আমরা টাকার জন্যই খেলতাম। কিন্তু ক্লাবকে আর্থিক সাহায্য করার কথা কখনও ভাবিনি।
চিন্ময় এ রকমই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy