Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পাঁচ গোলে হারাটা আমার জীবনের বড় শিক্ষা

পঁচাত্তরের সেই পাঁচ গোলের ডার্বির পরে শেষ হয়ে যেতে পারত তাঁর ফুটবল জীবন। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্ন ভুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়পাঁচ গোলের ম্যাচের আগে আমি কিন্তু একটা ছোট ডার্বি খেলেছিলাম। জিতেওছিলাম মহমেডানের বিরুদ্ধে। মহম্মদ হাবিব এবং আকবর আমাকে হারাতে পারেনি। সেটা দেখেই হয়তো  মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বাচ্ছা ছেলেকে খেলানোর ঝুঁকি নিয়েছিল ক্লাব।

প্রত্যাবর্তন: পরিশ্রম আর নিষ্ঠাই অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরিয়েছিল ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুটবল জীবনকে। ফাইল চিত্র

প্রত্যাবর্তন: পরিশ্রম আর নিষ্ঠাই অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরিয়েছিল ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুটবল জীবনকে। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:২২
Share: Save:

পঁচাত্তরের ২৯ সেপ্টেম্বর আই এফ এ শিল্ডে পাঁচ গোলের সেই কলঙ্কজনক হারের পর তিন মাস বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। লজ্জায়, ভয়ে, অপমানবোধ থেকে লুকিয়ে থাকতাম দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে। ভয়টাই ছিল বেশি। বড় ম্যাচে মোহনবাগানের ইতিহাসে সবথেকে বড় ব্যবধানে হার। লজ্জায় কোনও সমর্থক আত্মাহুতি দিতে চাইছেন। পাড়ায়, পাড়ায় ইস্টবেঙ্গল সমর্থথকদের কটূক্তি সহ্য না করতে পেরে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে রয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। এ সব দেখে শুনে মনে হচ্ছিল, বাড়ি থেকে বেরোলেই মারধর করবে লোকজন। কারণ ওই পাঁচটি গোলের চারটিই তো আমি খেয়েছিলাম। ছাড়বে কেন?
পাঁচ গোলের ম্যাচের আগে আমি কিন্তু একটা ছোট ডার্বি খেলেছিলাম। জিতেওছিলাম মহমেডানের বিরুদ্ধে। মহম্মদ হাবিব এবং আকবর আমাকে হারাতে পারেনি। সেটা দেখেই হয়তো মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বাচ্ছা ছেলেকে খেলানোর ঝুঁকি নিয়েছিল ক্লাব। জীবনে প্রথম ডার্বি। বিশ্ববিদ্যালয় দলে এবং বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে ভাল খেলার পর শৈলেন মান্না এবং অরুণ ঘোষ আমাকে নিয়ে এসেছিলেন মোহনবাগানে। তাও শিক্ষানবিশ গোলকিপার হিসাবে। সিনিয়রদের সঙ্গে আমার খেলার কথাও নয়। কিন্তু হঠাৎই চোট পেলেন প্রশান্ত দা। বি এন আর ম্যাচে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। আমি ওদের চোখে পড়ে গেলাম। তার পর আমাকে আর বসানো হয়নি। বড় দলে খেলা যে কোনও ফুটবলারের কাছেই তখন ছিল স্বপ্ন। আমারও তাই ছিল। গ্যালারিতে বসে ডার্বি দেখার সময়ই প্রচণ্ড উত্তেজিত থাকতাম। সেই ম্যাচ খেলতে নামব। একটা বাড়তি মোটিভেশন তো ছিলই। কিন্তু ঘটে গেল দুর্ঘটনা। তখন আমার বয়স সবে আঠারো পেরিয়েছে। চার গোল খাওয়ার পর কেঁদে ফেলেছিলাম। বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য) আমাকে হাত ধরে টেনে তুলছেন সেই ছবি পরের দিন সব কাগজে বেরিয়েছিল। সেই ছবিটা কলঙ্কের হতে পারে, কিন্তু সেটা আমাকে বড় শিক্ষাও দিয়েছিল। দিয়েছিল শৃঙ্খলা আর পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করার পাঠ। যে কোনও অবস্থায় গোলের নীচে গোলকিপারকে অকুতোভয় থাকতে হয় সেই পাঠও পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি বড় ম্যাচ বা ডার্বি খেলেছি। হেরেছি অথবা জিতেছি। কিন্তু ওই শিক্ষা কখনও ভুলিনি।
বাড়ি থেকে যে দিন বেরোতে শুরু করলাম, তার পরের দিন থেকেই ফিরে আসার জন্য লড়াই শুরু করেছিলাম। বেলঘরিয়ার মাঠে অবনী বসু বা আমার প্রথম কোচ সুধাব্রত ভট্টাচার্যর কাছে অনুশীলন করতাম। দিন-রাত এক হয়ে যেত। ওঁদের উৎসাহেই সমস্ত হতাশা আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত। প্রয়াত পল্টু দাশ আর জীবন চক্রবর্তী পরের বছর আমাকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে এসেছিলেন। ঢাকা, বিক্রমপুরে বাড়ি আমার পূর্বপুরুষের। ওই রকম একটা সময়ে ইস্টবেঙ্গলে খেলার সুযোগ পেয়ে জেদ চেপে গিয়েছিল। সেটাই আমি পরবর্তী কালে কাজে লাগিয়েছিলাম। লাল-হলুদে গিয়েও বিশ্বজিৎ দাশ অসুস্থ থাকায় সুযোগ এসে গিয়েছিল আমার। ১৯৭৬-এ কয়েকটা ম্যাচ খেলেছিলাম । কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৭-এই আমার জীবনের মোড় ঘুরল। রাশিয়ার পাখতাকোরের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচে ভাল খেলেছিলাম। আমার নামে হেডিং বেরিয়েছিল বিভিন্ন কাগজে। প্রশংসা করে। তবে ১৯৭৭-এর ইডেনের কলকাতা লিগের ডার্বি আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। মোহনবাগানের সেই দুর্ধর্ষ দলকে হারিয়েছিলাম আমরা। সমরেশ চৌধুরী আর মিহির বসুর গোলে। তার পর আর ফিরে তাকাইনি পিছনে। ইস্টবেঙ্গলে ১৩ বছর, মোহনবাগানে দু’বছর, মহমেডানে দু’বছর—ষোলো-সতেরো বছরে অসংখ্য ম্যাচ খেলেছি ক্লাব জার্সিতে।
ইস্টবেঙ্গলে আমি অধিনায়কত্ব করেছি। প্রচুর ট্রফি জিতেছি ঠিক। কিন্তু অন্য দুই প্রধানে খেলার সময়ও সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন তো খেলোয়াড়দের ডার্বির সেই আবেগটাই নেই। দুই প্রধানেই অন্য রাজ্যের ফুটবলার বেশি। বঙ্গসন্তানও কম। তাঁরা ডার্বির উত্তেজনা অনুভব করেন না। ওকোরি চিমা, হোসে ব্যারেটো, স্যামি ওমোলো, সুলে মুসা বা সনি নর্দের মতো টানা ক্লাবের জার্সিতে খেলা বিদেশিরা ডার্বির গুরুত্ব বুঝেছেন অনেক দিন খেলার সুবাদে। নিজেদের চেনার তাগিদে। বহু বিদেশিকে দেখেছি ডার্বিতে হেরে হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠছেন। আসলে তাঁদের হৃদয়ে তো বাঙাল-ঘটির আবেগ কাজ করে না। করার কথাও নয়। আমাদের সময়ে ভিন রাজ্যের চেয়ে প্রতিটি দলে বঙ্গসন্তান থাকত বেশি। ফলে আমাদের আবেগের সঙ্গে ওরা একাত্ম্য হয়ে যেতেন। এখন তো ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। সে যাই হোক। এখনকার ডার্বির সঙ্গে আমাদের সময়কার বড় ম্যাচের পার্থক্য সব দিক থেকেই ছিল আলাদা। আবেগ থেকে ফুটবলারদের মনোভাব, প্রেক্ষাপট আলাদা হয়ে গিয়েছে। আমি বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছি ১০-১১ বছর। কিন্তু অধিনায়কত্ব করা হয়নি। সরাসরি নেহরু কাপে ভারতের অধিনায়ক হয়েছি। অনেক কঠিন ম্যাচ খেলেছি ভারতের জার্সিতে। বাংলার জার্সিতে। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে খেলার যে আবেগ বা উত্তেজনা, তা মনে হয় একটু হলেও বেশি। অন্তত আমাদের এই বাংলায়। ডার্বি নায়ক তৈরি করে, খলনায়কও। আমিও তো খলনায়কই হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকেই উঠে দাঁড়াতে পারে না। হারিয়ে যায়। আমি যাইনি। অনেক চেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছি। কলঙ্কও কখনও কখনও বড় শিক্ষাও দিয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE