পার্থের পিচে কেউ মারাও যেতে পারত, তোপ লিলির
এমসিজিতে ঢোকার মুখেই তাঁর সেই বিখ্যাত মূর্তি। মেলবোর্নে ক্রিকেটভক্তদের সব চেয়ে বেশি করে ছবি তোলার জায়গা এটাই। তাঁর সেই ছবির মতো সুন্দর অ্যাকশন নিয়ে বল করার জন্য তৈরি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার।
কত দিন পরে নিজের এই মূর্তি আবার নিজের চোখে দেখলেন তিনি? ডেনিস কিথ লিলি এখন আর এই প্রশ্নের সামনে উত্তেজিত বোধ করেন না, বরং কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। এই বয়সেও দারুণ ফিট। ছিটেফোঁটা মেদ নেই। যেন এখনও ভারতের তরুণ ফাস্ট বোলারদের দিব্যি কোচিং করাতে পারেন। কিন্তু ফিট থাকলেও নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের স্তুতি আর খুব একটা শুনতে চান না। সংবাদমাধ্যমের থেকে দূরে থাকেন। কার্যত ইন্টারভিউ দেনই না। পার্থে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকার বহুকালের মধ্যে কোনও ভারতীয় সংবাদপত্রকে দেওয়া প্রথম। এমনকি, অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমকেও এড়িয়ে চলেন তিনি। বৃহস্পতিবারেই যেমন ঘুরে গেলেন মেলবোর্ন মাঠে। প্রায় কাউকে জানতেই দিলেন না।
চলতি সিরিজের অন্যতম সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেল অস্ট্রেলিয়ার ‘চ্যানেল সেভেন’-কে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিতে উড়ে এসেছিলেন পার্থ থেকে মেলবোর্নে। শর্ত দিয়েছিলেন, শুধু চ্যানেলের প্রতিনিধিদের মধ্যেই তাঁর আগমনের খবর গোপন রেখে দিতে হবে। বেশি ঢাকঢোল পেটানো যাবে না। ডি কে লিলি বলছেন, না শুনে উপায় কী! তিন তলায় প্রধান মিডিয়া সেন্টারের লাগোয়া স্টুডিয়ো রুমে ইন্টারভিউ চলল চরম গোপনীয়তার মধ্যে!
স্মৃতি: অতীতের সেই দৃশ্য। গাওস্করের প্যাডে বল লাগার ইঙ্গিত লিলির।
তবে এখনও যে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে বোঝা গেল ইন্টারভিউ শেষ করে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলে প্রথম তলে আসার সময়ে। ক্রিকেট ভক্তরা চিনে ফেলল তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে অটোগ্রাফ আর সেলফির আবদারের উষ্ণ স্রোত ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকল।
আরও পড়ুন: ও’কিফের মুখের উপর যোগ্য জবাব শাস্ত্রীর
মিয়াঁদাদের সঙ্গে ঝামেলা থেকে শুরু করে সুনীল গাওস্করের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং তার পরে সানির ক্ষিপ্ত হয়ে চেতন চৌহানকে নিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া—সে সব নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন সাক্ষাৎকার দিতে বসে। গাওস্করের ঘটনা এই মেলবোর্নেই। সেই সিরিজে রান পাচ্ছিলেন না সানি। মেলবোর্নে ভাল ছন্দে ছিলেন। লিলির বলে আম্পায়ার এলবিডব্লিউ দেওয়ার পরে গাওস্কর জানাতে থাকেন, বল তাঁর ব্যাটে লেগেছে। এগিয়ে এসে লিলি দেখাতে থাকেন, বল তাঁর প্যাডেই লেগেছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘চ্যানেল সেভেন’-কে দেওয়া এই ইন্টারভিউতে লিলি সেই ঘটনা নিয়ে বললেন, ‘‘গাওস্কর দাবি করছিল, বল ওর ব্যাটে লেগেছে। তার পর চেতন চৌহানকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ভারতীয় দলের ম্যানেজার বাউন্ডারি লাইনের ধার থেকে ব্যাপারটা সামলান। উনিই কঠোর থেকে গাওস্করকে ড্রেসিংরুমে যেতে বলেন আর চৌহানকে মাঠে ফেরত পাঠান নতুন ব্যাটসম্যানকে দিয়ে। একদম ঠিক করেছিলেন।’’
আর ১৯৮১-তে মিয়াঁদাদের সঙ্গে ঝামেলা? যে ছবি এখনও কুখ্যাত হয়ে আছে ক্রিকেট আর্কাইভে। মিয়াঁদাদ তাঁকে ব্যাট উঁচিয়ে মারতে আসছেন আর তিনি ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছেন। লিলি বলছেন, ‘‘এটা এমন একটা ঘটনা, যা নিয়ে আমি গর্বিত নই। দু’জন আগ্রাসী চরিত্র যে যার নিজের উপস্থিতিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিল। যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। ওই ঘটনা এখন অতীত।’’
বিরাট কোহালিকে দেখে তাঁর কী মনে হয়? পার্থে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলা সেই কথাগুলোই ফের বললেন লিলি। ‘‘আমি যত বড় ব্যাটসম্যান দেখেছি, কোহালি তাদের মতোই ভাল। দুর্দান্ত ব্যালান্স, শট খেলার জন্য প্রচুর সময়। গ্রেটদের সব গুণ রয়েছে।’’
মেলবোর্নে তাঁর চেয়ে সফল বোলার কেউ নেই। ১৪ টেস্টে ৮২ উইকেট রয়েছে তাঁর। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শেন ওয়ার্ন অনেক পিছনে। ১১ টেস্টে ৫৬ উইকেট। চলতি টেস্টে বোলারদের জন্য কঠিন সময় উপহার দিচ্ছে মেলবোর্নের পিচ। লিলির বক্তব্য অনুযায়ী, কখনওই মেলবোর্নের পিচে ফাস্ট বোলারদের জন্য বিশেষ কিছু ছিল না। ‘‘ফাস্ট বোলারদের জন্য দারুণ উইকেট কখনওই ছিল না মেলবোর্নে। শুরুতে ঘণ্টাখানেক হয়তো কিছুটা প্রাণ থাকত। তার পরে দিন দু’য়েক ধরে ব্যাটিংকেই বেশি সাহায্য করত। আমার মনে হয়, এখানে দর্শকদের যে সমর্থন পেতাম, সেটাই আমাকে ভাল পারফরম্যান্স করতে সাহায্য করত।’’
আর এমসিজি মাঠে ঢোকার মুখে বিখ্যাত সেই মূর্তি? ‘‘এখন ওটা দেখে একটু অস্বস্তিই হয়। তবে একটা কথা বলব। যিনি এই মুর্তিটা বানিয়েছেন, অ্যাকশনটা ঠিকঠাক করেছেন।’’ বরাবরের মতো এখনও নিখুঁত থাকার চেষ্টা করেন। সব চেয়ে বেশি খুঁতখুঁতে ভাব ছিল অ্যাকশন নিয়ে। আদর্শ সাইড-অন অ্যাকশন তৈরি করবেন বলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে গিয়েছেন। মূর্তি বানানোয় শখের সেই অ্যাকশন যে অটুট রয়েছে, তা দেখেই তৃপ্ত তিনি।
ওয়াকায় একটা সময় আগুন ঝরাতেন তিনি এবং জেফ থমসন। গ্যারি সোবার্সের বিশ্ব একাদশের বিরুদ্ধে ওয়াকায় তাঁর সেই ২৯ রানে আট উইকেটের অবিশ্বাস্য স্পেল। বিশ্ব একাদশ অলআউট হয়ে যায় ৫৯ রানে। তার পরে সেই সিরিজেই পাল্টা প্রত্যাঘাত করেন সোবার্স। মেলবোর্নেই সেই অমর ২৫৪। যে ইনিংসকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাঁর দেখা সেরা ইনিংস আখ্যা দিয়েছিলেন স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যান। লিলিও বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমার দেখা সর্বসেরা ক্রিকেটার গ্যারি সোবার্স। ওই ইনিংসে স্কোয়ারে তিন জন ফিল্ডার দাঁড় করানো সত্ত্বেও তাদের মধ্যে দিয়ে কাট মেরে যাচ্ছিল।’’ ভিভ রিচার্ডসকে সব চেয়ে বেশি বার আউট করেছেন তিনি (৯ বার)। তবু মনে করেন, সোবার্স যদি সর্বসেরা ক্রিকেটার হন তা হলে ভিভ তাঁদের সময়কার সেরা ব্যাটসম্যান।
প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলেন পার্থের নতুন মাঠ নিয়ে তাঁর বক্তব্য কী? লিলি বললেন, ‘‘মাঠটা দারুণ। নিশ্চয়ই লোকে পছন্দ করবে। ফুটবলের জন্য খুব ভাল হয়েছে নতুন এই স্টেডিয়াম। ক্রিকেটের জন্য কতটা ভাল হবে, সেটা জানি না।’’ তার পরেই যোগ করলেন, ‘‘তবে পিচটা নিয়ে দ্রুত ভাবতে হবে ওদের। টেস্টের সময় যে পিচটা ছিল, সেখানে কেউ একটা মারাও যেতে পারত। বেশ অসমান বাউন্স ছিল। কয়েক জনের মাথায় লাগল। কোনও বল লাফাচ্ছে, কোনওটা নিচু হচ্ছে। আমি নিশ্চিত ভাবেই এ রকম পিচে খেলতে চাইতাম না।’’
লিলির এ দিনের বক্তব্য নতুন করে পার্থের পিচ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিচ্ছে। আইসিসি পার্থের নতুন স্টেডিয়ামের বাইশ গজকে ‘অ্যাভারেজ’ আখ্যা দেওয়ায় অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন, এমন উত্তেজক টেস্ট ম্যাচ উপহার দেওয়ার পরেও আইসিসি খারাপ রেটিং দিল কী ভাবে? লিলি কিন্তু বলে দিচ্ছেন, অসমান বাউন্সের পিচ মোটেও ক্রিকেটের পক্ষে ভাল ছিল না।
ক্যামেরন ব্যানক্রফ্ট ফাঁস করে দিয়েছেন যে, ডেভিড ওয়ার্নারই তাঁকে বল-বিকৃতি ঘটাতে বলেছিলেন। যা নিয়ে ফের বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ওয়ার্নারের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। লিলি মনে করছেন, সংহতিপূর্ণ ড্রেসিংরুম সবার আগে দরকার। যদি কেউ দলীয় সংহতির পক্ষে ভাল না হন, তা হলে তাঁকে বাইরে রাখার কথাই ভাবতে হবে। ‘‘ড্রেসিংরুম ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে। এ নিয়ে কোনও আপস করা যায় না,’’ স্বভাবসিদ্ধ সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে বলে দিচ্ছেন ফাস্ট বোলিংয়ের ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy