Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ফিটনেস বিপ্লবেই গতির ঝড় বুমরাদের

স্পিনের দেশ বলে পরিচিত ভারতে পেসারদের এই অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা ও আগুনে বোলিংয়ের আসল রহস্য দুর্দান্ত ফিটনেস।

শারীরচর্চা: ইশান্ত-বুমরাদের সাফল্যের পিছনে রয়েছে এ রকম জিম সেশন। ছবি: টুইটার

শারীরচর্চা: ইশান্ত-বুমরাদের সাফল্যের পিছনে রয়েছে এ রকম জিম সেশন। ছবি: টুইটার

চিন্ময় রায়
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৯
Share: Save:

যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মাদের মধ্যে যেন সত্তরের দশকের ভয়ঙ্কর ডেনিস লিলি ও জেফ থমসনের ছায়া!

স্পিনের দেশ বলে পরিচিত ভারতে পেসারদের এই অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা ও আগুনে বোলিংয়ের আসল রহস্য দুর্দান্ত ফিটনেস। যা গত এক দশকে নাটকীয় ভাবে বদলে গিয়েছে। কী ভাবে সম্ভব হল বিবর্তন?

গতির ঝড়ে বাজিমাত

জোরে বোলারেরা একটা বল করার পরে আর একটা ডেলিভারির আগে ২৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড সময় পান। বল করার আগে ৪০ মিটার দৌড়ন তাঁরা। অর্থাৎ, একটা ওভারে ছ’টি বল মানে ছ’বার দ্রুত গতিতে (স্প্রিন্ট) দৌড়ে আসা। এই সময় ‘টাইপ টু ফাস্ট টুইচ’ পেশি ব্যবহৃত হয়। এর জন্য ‘স্পেসিফিক কার্ডিয়ো ট্রেনিং’ করতে হয়।

লম্বা দৌড়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘টাইপ ওয়ান স্লো টুইচ’ পেশি। জাভাগাল শ্রীনাথ ও বেঙ্কটেশ প্রসাদেরা এই ধরনের ট্রেনিং করতেন। কিন্তু পেসারদের ক্ষেত্রে লম্বা দৌড় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওঁদের ট্রেনিং যতটা স্প্রিন্ট নির্ভর হবে, ততই টাইপ টু ফাস্ট টুইচ পেশিকে ব্যবহার করা হবে। বুমরা, ইশান্ত, শামিরা দু’মাসে এক বার তিন কিলোমিটার দৌড়ন। যাকে আমরা বলি টাইম ট্রায়াল। কারণ, ৩০ মিনিটের জগিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় দুই বা তিন মিনিটের শাটল রান বা ২০০ মিটারের স্পিড এন্ডিয়োরেন্স ট্রেনিং।

ইয়ো ইয়ো বনাম বিপ টেস্ট

জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে কাজ করার সময় খুব কাছ থেকে দেখেছি অজিত আগরকর, জাহির খান, আশিস নেহরা, শ্রীসন্থ, মুনাফ পটেলদের। অধিকাংশই পরিশ্রম করতে চাইতেন না। শ্রীসন্থ, মুনাফ তবুও ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট টানতেন। কিন্তু জাহির ও আগরকরেরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী অনুশীলন করতেন। সব চেয়ে বড় কথা, সেই সময় কঠিন ইয়ো ইয়ো টেস্ট চালু হয়নি। যার মাধ্যমে সহজেই যাচাই করা যেত বোলারদের শারীরিক ক্ষমতা। তখন ছিল বিপ টেস্ট। ইয়ো ইয়ো টেস্টের চেয়ে যা অনেক সহজ। যদিও জাহির, নেহরা-রা তাতেও অনেক পিছিয়ে ছিলেন। সব চেয়ে আশ্চর্যের, ওঁরা বিপ টেস্টকে গুরুত্বও দিতেন না!

ভারতীয় দলে এখন ইয়ো ইয়ো টেস্টের লেভেল টু ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে বুমরা, ইশান্ত, ভুবনেশ্বরদের যা ফিটনেস, তাতে ওঁরা ইয়ো ইয়ো টেস্টের ১৭তম লেভেলেও সহজে পৌঁছে যাবেন। এর নেপথ্যে ট্রেনার শঙ্কর ভাসু। জাতীয় অ্যাকাডেমিতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ওঁর জন্যই গতির বিপ্লব এসেছে ভারতীয় দলে।

ওজন তুলেই সাফল্য

জোরে বোলিংয়ের প্রধান শর্তই হল শক্তিশালী শরীর। পেসারদের পায়ের শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম নিয়মিত করতে হয়। অথচ জাতীয় অ্যাকাডেমিতে দেখতাম, জাহিরেরা কোনও ঝুঁকিই নিতে চাইতেন না। ওঁরা পায়ের ব্যায়াম বলতে শুধু বুঝতেন স্কোয়াট লাঞ্জ। এ ছাড়াও শরীরের উপরের অংশের শক্তি বাড়ানোর জন্য করতেন বেঞ্চ প্রেস, রোয়িং ও শোল্ডার প্রেস। এই প্রথাগত অনুশীলনের বাইরে ওঁরা বেরোতেই চাইতেন না। জোরে বোলারদের প্রধান অস্ত্র শক্তি। যা আসে টাইপ টু ফাস্ট টুইচ পেশির মাধ্যমে। জাহিরেরা যে ভাবে হাল্কা অনুশীলন করতেন, তাতে এই পেশিকে উদ্দীপ্ত করা যায় না। তাই ঝুঁকি নিতেই হবে।

ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহালি নিজেই অলিম্পিক্স লিফ্টিংয়ে জোর দেন। অর্থাৎ, ২০ কেজির লোহার রড (বারবেল)-এ আরও ১০-২০ কেজির লোহার প্লেট লাগিয়ে নানা ধরনের ব্যায়াম করা। দ্রুত গতিতে এই ওজন মাথার উপরে তুলতে হয় যাতে টাইপ টু ফাস্ট টুইচ পেশির সঠিক ব্যবহার হয়। তবে ওজন তোলার সময় শরীরের অবস্থান ঠিক না থাকলে চোট লাগার আশঙ্কা প্রবল। নেহরা-রা এই কারণেই ঝুঁকি নিতে চাইতেন না।

ভাসু নিঃশব্দে আরও পরিবর্তন এনেছেন ভারতীয় দলে। অতীতে প্রাক-মরসুম শিবির শেষ হওয়ার পরে আর কেউ ওজন নিয়ে ব্যায়াম করতেন না। ভাসু এখন বিভিন্ন ওজনের প্লেট সঙ্গে নিয়েই দলের সঙ্গে ঘোরেন। বিশ্রাম পেলেই বোলারেরা ওয়েট ট্রেনিং করেন।

তরতাজা থাকার নয়া ফর্মুলা

খেলার ধকল কাটিয়ে পরের ম্যাচের আগে ফিট হয়ে ওঠার পদ্ধতির নামই ‘রিকভারি ট্রেনিং’। এখানেও চোখে পড়বে পূর্বসূরিদের সঙ্গে বুমরাদের পার্থক্য। শ্রীনাথ-প্রসাদ। তার পরে জাহির, শ্রীসন্থ, নেহরা-রা ক্লান্তি দূর করার জন্য ওঁরা মাসাজ নিতেন। অল্প যোগব্যায়াম করতেন। অর্থাৎ, ৯৫ শতাংশই ছিল অন্যের সাহায্যে ধকল কাটানো। আমরা একে বলি ‘প্যাসিভ রিকভারি’। এতে কিন্তু সম্পূর্ণ ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হত না।

ভারতীয় দলে এই প্রজন্মের বোলারেরা প্রত্যেকেই নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যেমন ভুবনেশ্বর কুমারের কোমরে সমস্যা রয়েছে। শামির অস্বস্তি হাঁটু ও হ্যামস্ট্রিং নিয়ে। ওঁরা শুধু খেলার পরে নয়, আগেও যত্ন নেন। রাবার ব্যান্ডের মাধ্যমে স্ট্রেচিং করেন। লুপ ব্যান্ডের দিয়ে শক্তি বাড়ানোর অনুশীলন করেন। ফোম রোলার দিয়ে নিজেরাই ধকল কাটিয়ে ওঠার অনুশীলন করেন। এ ছাড়া সাঁতার তো রয়েইছে। ক্রীড়াবিজ্ঞানে এই পদ্ধতির নাম ‘অ্যাক্টিভ রিকভারি’। অর্থাৎ, কারওর সাহায্য ছাড়াই তরতাজা হওয়ার পদ্ধতি। সঙ্গে মাসাজও নেন ওঁরা।

খাদ্য নিয়ন্ত্রণ

জাতীয় অ্যাকাডেমিতে থাকার সময় দেখেছি, নেহরা-মুনাফদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। চিকেন ভর্তা থেকে পনির বাটার মশালা— মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে নিতেন। সেই সময় ভারতীয় দলের ফিজিয়ো অ্যান্ড্রু লিপাস অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘এই খাবার ক্রিকেটারেরা খাচ্ছে কী করে?’’ শ্রীনাথ-প্রসাদ অবশ্য নিরামিশাষী ছিলেন। প্রাণীজ প্রোটিন ছাড়া পেশির পুষ্টি অবশ্য হয় না। সেই সময়ও বিকল্প ব্যবস্থা (প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট) ছিল। কিন্তু ট্রেনার গ্রেগ কিং পরে প্যাডি আপটন এই বিষয়ে খুব একটা জোর দিতেন না।

বাংলা দলে থাকার সময় শামিকেও দেখেছিলাম, খাওয়ার ব্যাপারে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যা পেতেন তাই খেতেন। সেই শামি এখন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছেন। মশলা ও চর্বিযুক্ত খাবার এখন ছুঁয়েও দেখেন না। শামিদের ডায়েট চার্টে শুধুই গ্রিলড চিকেন বা ফিস, সেদ্ধ সব্জি, সেদ্ধ ডিম, স্প্রাউট, বিনস, ক্রীম ছাড়া দুধ, তাজা ফল। এ ছাড়াও ভাসুর নির্দেশ অনুযায়ী প্রোটিন পাউডার ব্যবহার করা।

পরিবর্তন বিশ্বের সামনে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Border-Gavaskar Trophy 2018 Cricket Cricketer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE