Advertisement
E-Paper

চর পাঠিয়েও চাপে ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা খোশমেজাজে

নাম দু’টো শুনে শুধু পাঁড় ফুটবল-মাতালরাই চিনবেন। রকে জুনিয়র আর আলেসান্দ্রো গালো! উইকিপিডিয়ায় প্রথম জনের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে ব্রাজিলের শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের ডিফেন্ডার হিসেবে। দ্বিতীয় জনের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। কিন্তু এ বার সময় হয়েছে নতুন করে জুনিয়র আর গালোর অবসরোত্তর হিসেব কষতে বসার! দেখার যে, ব্রাজিলকে তাঁরা সেমিফাইনাল ‘জেতাতে’ পারলেন কি না।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪৭
নেইমারের পাশে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। রবিবার। ছবি: রয়টার্স।

নেইমারের পাশে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। রবিবার। ছবি: রয়টার্স।

নাম দু’টো শুনে শুধু পাঁড় ফুটবল-মাতালরাই চিনবেন। রকে জুনিয়র আর আলেসান্দ্রো গালো!

উইকিপিডিয়ায় প্রথম জনের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে ব্রাজিলের শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের ডিফেন্ডার হিসেবে। দ্বিতীয় জনের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। কিন্তু এ বার সময় হয়েছে নতুন করে জুনিয়র আর গালোর অবসরোত্তর হিসেব কষতে বসার! দেখার যে, ব্রাজিলকে তাঁরা সেমিফাইনাল ‘জেতাতে’ পারলেন কি না।

গালো আর জুনিয়র আসলে ব্রাজিলীয় কোচের সেরা দুই গুপ্তচর। জার্মানি-ফ্রান্স ম্যাচ দেখতে এঁরা বেসক্যাম্প থেকে গোপনে অত্যাধুনিক ট্যাবলেট-সহ গিয়েছিলেন সাও পাওলো মাঠে। সেখানে জার্মানদের এক একটা স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে এনেছেন। এমনিতে খেলা তো স্কোলারি-সহ পুরো ব্রাজিল টিমই টিভিতে দেখছে। কিন্তু টিভির সীমাবদ্ধতা হল শুধুই বল দেখায়, পুরো মাঠ নয়। এঁদের ট্যাবলেটে ধরা পড়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যখন আক্রান্ত হয়েছে জার্মান ডিফেন্স তখন কে কী ভাবে দাঁড়াচ্ছে। কী ভাবে গুটিয়ে আনছে। কী ভাবে সাত নম্বর সোয়াইনস্টাইগার ঠিক দুই স্টপারের ওপর থেকে খেলাটা শুরু করেন। এক কথায় জার্মান ডিফেন্সের বাঁধুনিটা ঠিক কী কী পজিশনিং থেকে তৈরি হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই গোপন তথ্যগুলোই তাঁরা কাল স্কোলারির ল্যাপটপে চালান করে দিয়েছেন। এ বার ব্রাজিল টিমের মাথারা সেই অনুযায়ী ফরোয়ার্ডের পজিশনিংগুলো বদলাবেন।

এই দুই প্রাক্তনকে পাঠানো হয়েছিল যথেষ্ট গোপনে। কিন্তু মাঠে ছবি তোলার সময় এক টিভি ক্রু তাঁদের দেখে ফেলেন। তা থেকে গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশের খবর চাউর হয়ে গিয়েছে। ব্রাজিলের বোধ হয় সময়টা খারাপই যাচ্ছে। এই গোপন খবরটা ফাঁস হয়ে গেল। নেইমার মাঠের বাইরে চলে গেলেন। মার্সেলোর ঠাকুরদা মারা গেলেন। আবার ব্রাজিলের মুখপাত্র কাম মিডিয়া ম্যানেজার রডরিগো পাইভাকে বাকি বিশ্বকাপের জন্য সাসপেন্ড ও জরিমানা করল ফিফা। ফুটেজ দেখে ফিফা সিদ্ধান্তে এসেছে, সে দিন টানেল দিয়ে ফেরার সময় তর্কাতর্কির পর সত্যিই চিলি ফুটবলারকে মেরেছিলেন রডরিগো।

রোববারের এলিয়ে থাকা দুপুরে বেলো হরাইজন্তেয় নেমে মনে হল, শহরটা যেন কিঞ্চিৎ ঝিম মেরে গিয়েছে। সেই টগবগে বিশ্বকাপ উত্তেজনাটা যেন নেই। মাত্র ক’দিন আগে এখানেই তো চিলির টাইব্রেকারের পর রাতভর মস্তি হচ্ছিল। বেলো কি হাল ছেড়ে দিল? না রোববারের ছুটিতে সাময়িক জিরিয়ে নিচ্ছে মঙ্গলবার তেজি হলুদ আবির্ভাবের জন্য?

ব্রাজিল টিমটা যে কিছুটা হ্যাং করে গিয়েছে এবং মানসিক ভাবে নিজেদের বেলো হরাইজন্তেকে ঘিরে থাকা চার ধারের পাহাড়ের মতো অবরুদ্ধ দেখছে, সেটা কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে। নইলে টিমের বেসক্যাম্প থেকে বার্নার্ড দেশবাসীকে এমন আকুল আবেদন জানাবেন কেন যে, ‘নেইমারের না থাকাটা বিশাল আঘাত। তা বলে আপনারা আমাদের সঙ্গ ছাড়বেন না। দেখছি আমরা কী করা যায়।’ ইন্সটাগ্রামে পোডলস্কি আবার এ দিনই তাঁর দুই আরাধ্যের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছেন। রোনাল্ডো আর রোনাল্ডিনহো। সঙ্গে লিখেছেন, ‘অদৃষ্টকে ধন্যবাদ। এঁদের সামনে মঙ্গলবার পড়তে হবে না।’

এটা হতেই পারে জার্মানদের বিখ্যাত মাইন্ডগেম। হালকা একটা চাপ রেখে দেওয়া বিপক্ষের ওপর যে, ব্রাজিল, তোমরা এখন পুরনো জমিদারবাড়ি। অতীতের জৌলুসগুলো আর মঙ্গলবার তোমাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। নইলে এত দিন এ দেশে রয়েছেন পোডলস্কি, তিনি আর ছবি পোস্ট করার সময় পেলেন না? ঠিক রোববারে এসে! এ তো গেল ব্রাজিলের বিদেশি দুর্ভোগ। এ বার স্বদেশিতে আসি। কাকা তিনিও এত দিন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরলেন ঠিক রোববার। প্রায় কুড়ি হাজার সমর্থক তাঁকে ঘিরে ধরে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বরণ করল। এর পর সাংবাদিক সম্মেলন এবং অনিবার্য বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ।

কাকা বললেন, “নেইমারের না থাকাটা খুব শোকাবহ। তবে চাইব, ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হোক। আমিও তো কাজে আসতে পারতাম। কিন্তু স্কোলারি দেখালেন তাঁর অন্য বিকল্প আছে।”

খুব সহজ বক্তব্য দেশকে নেইমারের বদলে আমি দেখতে পারতাম। কিন্তু কোচ তো আমাকে দেখলেনই না। সোজা কথা, জার্মানদের হয়ে স্কোলারির গোলে প্রথম শট তো কাকাই করে গেলেন।

বিমর্ষ ব্রাজিল ফুটবল মহল অগত্যা তার সোনার ইতিহাসের আশ্রয়ে নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। পেশ করে আনছে অসাধারণ একটা তথ্য নিজের দেশে গত ঊনচল্লিশ বছর যে কোনও ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচে ব্রাজিল অপরাজিত। ভাবাই যায় না যে, ইন্দিরা গাঁধী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মধ্যগগনে। যখন জরুরি অবস্থা জারি হয়নি। ইউরোপের কমিউনিজমের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়নি। যখন বার্লিনের প্রাচীর পড়েনি। পৃথিবী ভিডিও কাকে বলে জানে না। সেই সময় থেকে দেশের মাঠে হলুদ জার্সি দুর্লঙ্ঘ! বিশ্বকাপে জার্মানির সঙ্গে দেখা হলে যে অমন দাপুটে জার্মানরাই নড়বড়ে থাকে, সেই রেকর্ডও সমর্থকেরা অনবরত বার করছেন।

তাঁরা নিজেরাও জানেন এর পিঠোপিঠি উল্টো রেকর্ডও রয়েছে। যারা কনফেড কাপ জেতে, তারা পরের বার আর কিছুতেই বিশ্বকাপ জেতে না। ফ্রান্স জেতেনি। এর আগে ব্রাজিল জেতেনি। পারস্পরিক শক্তি বিচারেও তো ব্রাজিলকে রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। মোরিনহো এ দিন বলেছেন, “একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে নেইমার দারুণ। যে কোনও ডিফেন্স টলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মঙ্গলবার ব্রাজিল নেইমারের চেয়ে বেশি মিস করবে থিয়াগো সিলভাকে। এই ব্রাজিলের খেলাটা রক্ষণাত্মক কাঠামোর ওপর তৈরি। সেখানে থিয়াগো অপরিহার্য।” ব্রাজিল সমর্থকদের একেবারে মুষড়ে না দিয়ে চেলসির ফুটবল-প্রভু অবশ্য এটাও বলেছেন, “ওই জায়গাটায় খেলার সবচেয়ে উপযুক্ত হল দাঁতে। ও জার্মানিতে খেলে বলে জার্মানদের খেলার খোঁচখাঁচ সব চেয়ে ভাল জানে।”

মোরিনহো এবং আম-সমর্থকের মতো জুয়াড়িরাও ব্রাজিল নিয়ে খানিক দমে রয়েছে। নইলে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাদের অবিসংবাদী ফেভারিটের মতো দর দিয়েছিল, তাদের বেলো সেমিফাইনালে এক ঝটকায় এত কমিয়ে দেবে কেন! জুয়াড়িদের মতে ফেভারিট জার্মানি ৭-৪। ব্রাজিলের দর মঙ্গলবার বেশ কম ৯-৫।

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে স্বপ্নের ফাইনাল চাওয়া হয়েছিল ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার। আবেগ এখনও সে দিকে সবুজ আলো জ্বেলে রেখেছে। কিন্তু জুয়াড়িদের কাছে সেই ট্র্যাফিক সিগনালের রং লাল। পরিষ্কার লাল। মেসি নামক কেউ এই গ্রহে বর্তমান থেকেও সাও পাওলোর সেমিফাইনালে ফেভারিট কমলা জার্সি।

দি’মারিয়ার রথের চাকাও নেইমারের মতোই মেদিনীগ্রাস করেছে কাল রাত্তিরে। খবরটা ছড়িয়ে পড়াতেই হয়তো আর্জেন্তিনীয়দের ওপর আস্থা নিম্নগামী। নইলে ফুটবল হিসেবে তো উল্টো হওয়া উচিত। এক দল টাইব্রেকারে কোস্টারিকাকে হারিয়েছে। আর একটা টিম মেসি নিয়ে সব ক’টা ম্যাচ জিততে জিততে এগোচ্ছে, দর তো তাদের বেশি হওয়া উচিত।

জুয়াড়িদের বিচারে চুয়াত্তরের ফাইনালের রিম্যাচ হবে এ বার। জার্মানি বনাম নেদারল্যান্ডস।

ব্রাজিলীয়রা যদি বা একটু ম্রিয়মাণ থেকে এ সব হিসেবের সঙ্গে তর্ক-যুদ্ধে যাচ্ছে না, আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা অনমনীয়। দি’মারিয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তারা কাপ ছাড়া কিছু দেখছে না। কাল ব্রাসিলিয়া মাঠ থেকে ব্রাজিলীয় পুলিশ আর্জেন্তিনার সব চেয়ে বড় গুন্ডাবাহিনী ‘বারা ব্রাভাস’-এর সর্বাধিনায়ককে গ্রেফতার করেছে। বারা ব্রাভাস ফুটবল মাঠে গুন্ডামির জন্য কুখ্যাত। মাঠে বহু বার খুনখারাপিও করেছে। এদের নেতা লুকিয়ে ফ্ল্যামেঙ্গো টি শার্টের ছদ্মবেশে খেলা দেখছিলেন। পুলিশ দ্রুত তাঁকে আটক করে। বলে দেওয়া হয়েছে, হয় আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ো, নইলে ব্রাজিলের কারাগারে চুপ করে বোসো। বেছে নাও যেটা তোমার ইচ্ছে।

আর্জেন্তিনা সমর্থকদের কাল মাঠে আরও আগুনে ঠেকছিল। ওই গানটা ক্রমাগত গাইছিলেন, ব্রাজিল তোর নিজের পাড়ায় তোর বাবাকে চিনতে পেরে কেমন লাগছে। সেমিফাইনালে রবেন, কাউট বা স্নাইডার যে ম্যান ইউয়ের গবেট মিডিফিল্ডারের মতো খেলবে না, তারা যে বেলজিয়াম নয়, কে বোঝাবে আর্জেন্তিনীয়দের।

তারা গত এক দিনে আরও মেজাজে। দি’মারিয়া নেই তো কী। নেইমারও তো নেই। ওরে ব্রাজিল, হারালি তো নেইমারকে। কী মজা, কী মজা...এটা তাদের সাম্প্রতিকতম গান। যা বোঝা যাচ্ছে, এরা অন্তত মারাকানায় ইউরোপীয় ফাইনাল কিছুতেই দেখতে পাচ্ছে না!

লিওনেল মেসি! এই মুহূর্তে আর্জেন্তিনা প্রেসিডেন্টের চেয়েও যিনি চার কোটি দেশবাসীর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তিনি কী ভাবছেন? কাল ব্রাসিলিয়া মাঠে দেখে মনে হল, যথেষ্টই টেনশনে আক্রান্ত। গোটা তিনেক বার বেলজিয়ান ডিফেন্ডার তাঁর ওপর চড়াও হতেই মেসি ছুটে গেলেন রেফারির কাছে। হাত-মুখ খিঁচিয়ে দেখালেন, এটা কী হচ্ছে। এর পর নিজেও দু’বার ফাউল করলেন। এক বার তো রেফারি এসে তাঁর সঙ্গে কথাও বলে গেলেন। জানি না সতর্কই করলেন কি না? বা হয়তো জানতে চাইলেন, এটা আজ তুমি কী করছো?

লা লিগা বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এই লিওনেল মেসিকে জীবনে দেখিনি। অফিসযাত্রীর যেমন ভিড় অবশ্যসঙ্গী, তেমনই মেসিরও তো বরাবরের সঙ্গী মারকুটে ডিফেন্ডার। তা হলে কোয়ার্টার ফাইনালে এত মেজাজ হারাচ্ছিলেন কেন? নেদারল্যান্ডসও কি তাঁকে জামাই-আদর করবে নাকি? অবশ্যই প্রথম থেকে চালাবে। কালকের মেসিকে দেখে মনে হল নেইমারের ঘটনা কোথাও একটা হয়তো তাঁকেও নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। শিরদাঁড়াটা যে কোনও মূল্যে তাঁকে ঠিক রাখতেই হবে।

এখন যে দি’মারিয়া নেই, অত কথা যে ফ্যানরা শুনতে রাজি নয়, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। ওই একটা শিরদাঁড়া ভাঙলে আর রক্ষা নেই। গোটা আর্জেন্তিনা বুধবার পর্যন্ত যে ওটাতেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে!

fifaworldcup fifa sepp blatar neymer gautam bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy