Advertisement
E-Paper

ডালমিয়ার শেষকৃত্যের মধ্যেই শুরু দুই প্রেসিডেন্টের খোঁজ

প্রবীর মুখোপাধ্যায় রবিবার রাত থেকে দু’কাপ চা ছাড়া কিছু আর খাননি। ইডেনের প্রবীণ কিউরেটরকে টেনে আনার কারণ হল, এঁর সঙ্গে সদ্যপ্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার সম্পর্কটা ঠিক সিএবি প্রশাসনে উচ্চস্তন-অধঃস্তনের ছিল না। এঁরা দুই অনেক বেশি বন্ধু ছিলেন। সহমত থাকত যতটা, ততটা মতবিরোধও। এ দিন মাঝ দুপুরের ইডেনে যে প্রবীরবাবুকে পাওয়া গেল, তাঁর শরীর ও আত্মা দু’টোই যেন চুরচুর হয়ে গিয়েছে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় ও রাজীব ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৭
বিদায়। শোকস্তব্ধ ডালমিয়া কন্যা বৈশালী।

বিদায়। শোকস্তব্ধ ডালমিয়া কন্যা বৈশালী।

প্রবীর মুখোপাধ্যায় রবিবার রাত থেকে দু’কাপ চা ছাড়া কিছু আর খাননি। ইডেনের প্রবীণ কিউরেটরকে টেনে আনার কারণ হল, এঁর সঙ্গে সদ্যপ্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার সম্পর্কটা ঠিক সিএবি প্রশাসনে উচ্চস্তন-অধঃস্তনের ছিল না। এঁরা দুই অনেক বেশি বন্ধু ছিলেন। সহমত থাকত যতটা, ততটা মতবিরোধও। এ দিন মাঝ দুপুরের ইডেনে যে প্রবীরবাবুকে পাওয়া গেল, তাঁর শরীর ও আত্মা দু’টোই যেন চুরচুর হয়ে গিয়েছে। তিন দিনের ব্যবধানে যে সময় স্ত্রী ও কন্যাকে হারিয়েছিলেন ইডেন কিউরেটর, সিএবি প্রেসিডেন্ট তাঁর বাড়ি গিয়ে প্রথমেই তাঁকে বলেছিলেন শোনো প্রবীর, কাল থেকে তুমি মাঠে আসবে। আর কিউরেটরের অজান্তে তাঁর পরিবারবর্গকে বলে এসেছিলেন, দেখবেন যেন মাঠে যায়। লোকটাকে বাঁচাতে হবে তো! ‘‘আর আজ ওর চলে যাওয়াটাই কি না আমাকে দেখতে হল।’’
প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে কথাগুলো যখন বলছিলেন প্রবীর, পাঁচ মিটার দূরত্বে কাচের কফিনটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে। অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বোর্ড তথা সিএবি প্রেসিডেন্টের শেষকৃত্য শেষ, নিথর দেহ এ বার যাবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে। প্রায় আড়াইশো লোকের জটলাটাও ঠেলেঠুলে বেরনোর চেষ্টা করছে ইডেন ড্রেসিংরুম সংলগ্ন চত্বর ছেড়ে। শুধু ওই ছ’জন তখনও নিশ্চল। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মগ্ন। ওঁদের একজন বিদর্ভের, ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের প্রভাবশালী মুখদের এক। লোকে জানে, শশাঙ্ক মনোহর নামে। আর এক এনসিপি প্রধান, শরদ পওয়ার। বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুরকেও দেখা যাচ্ছে। আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল আছেন। আর আছেন দুই প্রাক্তন —সচিব ও কোষাধ্যক্ষ। নিরঞ্জন শাহ এবং অজয় শিরকে। কেউ নড়েননি।
যে দৃশ্যকে খুব কাছ থেকে দেখলে বড় প্রতীকী মনে হবে। কাচের কফিনে যিনি ইডেন ছেড়ে বেরোচ্ছেন, তিনি ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের একটা যুগ। আবার যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা আসন্ন এক যুগ। সোমবারের ইডেনে যেন এক যুগের অবসান ঘটল। আবার সেই যুগাবসানের বেদিতেই যেন নীরব আবাহন ক্রিকেট প্রশাসনের আর এক যুগের। যুগপৎ ভাবে।
সোজাসুজি বললে, সোমবার ইডেনে জগমোহন ডালমিয়ার বিদায়মঞ্চ থেকেই ডালমিয়া-উত্তর ক্রিকেট প্রশাসনের ভাবনা শুরু হয়ে গেল। ভারতীয় বোর্ডে। সিএবিতে। ডালমিয়ার অন্ত্যেষ্টি উপলক্ষে শহরে এ দিন কম ক্রিকেটীয় চরিত্র আসেননি। ভারতীয় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রীকে বেঙ্গালুরুর জাতীয় শিবিরে যোগ দিতে হত। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা দশ নম্বর আলিপুর রোড ঘুরে বেঙ্গালুরুর বিমান ধরেন। পওয়াররা শুধু নন, নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনও এসেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন পৌঁছন ডালমিয়ার মরদেহ ইডেন থেকে বার করা হচ্ছে। পওয়ারদের মতো ইডেনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্ভব হয়নি শ্রীনির। মালা দিতে হয় ইডেনের বাইরে। এখন প্রশ্ন উঠছে, শ্রীনিকে কি বাইরে রেখে আসন্ন বিশেষ সাধারণ সভা করা সম্ভব হবে? যা পরিস্থিতি, শ্রীনি ঢুকতে চাইলে এসজিএমের ভবিষ্যতও আদালতের হাতে চলে যেতে পারে।

বোর্ড সচিব অনুরাগ ঠাকুর অবশ্য নিশ্চিত, মিটিং হবে। বলে গেলেন, বোর্ডের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আগামী পনেরো দিনের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়া হবে। অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। অনুরাগ আরও বললেন যে, ওই বিশেষ সভাতে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যাঁকে নির্বাচিত করা হবে, তিনিই পরবর্তী বার্ষিক সভা পর্যন্ত বোর্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। এখন প্রশ্ন হল— সেই সিংহাসনে এ বার কে? শোনা গেল, এ দিন রাত পর্যন্ত দৌড়ে এগিয়ে রাজীব শুক্ল। বলা হচ্ছে, বোর্ডের দু’টো গোষ্ঠীরই বিশ্বস্ত তিনি। রাজীবকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি ভাসা ভাসা উত্তর দিয়ে গেলেন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, পদটা পেতে তিনি ভাল রকম উদ্যোগী। বোর্ডে কী হতে যাচ্ছে, সেটা আগামী দিন পনেরোর মধ্যে পরিষ্কার হবে। সিএবিরটা নয়।

সিএবি-র গঠনতন্ত্র একটু আলাদা, প্রাপ্ত সময়ও বেশি। বোর্ডের হাতে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সময় যখন পনেরো দিন, সিএবি-র সেখানে দু’মাস। যে দু’মাসের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। এবং এ দিন রাত পর্যন্ত সিএবি প্রশাসনে দু’টো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এক, রাজ্যের শাসক দলের সিএবি প্রশাসনে ঢুকে পড়া। গত কয়েক বছর ধরেই সিএবি-র বিভিন্ন কমিটিতে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা আসছিলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্টিয়ারিং কমিটিতেও পনেরো জনের মধ্যে শাসক দলের প্রতিনিধি এগারো জন। এ দিন ময়দানের একাংশ বলাবলি করল, এর পর কি সিএবির সর্বোচ্চ পদেও শাসক দলের কোনও প্রতিনিধি আসতে চলেছেন? দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, সিএবি-র শীর্ষকর্তারা একজোট হয়ে নিজেরাই একজনকে নতুন প্রেসিডেন্ট বাছলেন। সেটা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ বা সংস্থার সিনিয়র কোনও ব্যক্তিত্ব— যে কেউ হতে পারে। তার পরেও নির্বাচন হলে দেখা যাবে। ময়দানের কেউ কেউ সোমবার রাতে বলতে শুরু করলেন যে বঙ্গ ক্রিকেটের প্রশাসন সিএবি-র কারও হাতে থাকলেই ভাল। যেমন ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার। বললেন, ‘‘ডালমিয়া দু’টো প্রজন্মের পাঁচ জনকে তো রেখে গেলেন। আমার বিশ্বাস এদের মধ্যে থেকেই কেউ ডালমিয়ার অসম্পূর্ণ কাজ পূর্ণ করবে।’’

ইডেনেই যেন পওয়ার-অনুরাগ-মনোহরদের বৈঠক শুরু।

শেষ পর্যন্ত সেটা কতটা কী হবে, সময় বলবে। আজকের মতো শুধু বলা যায় যে, আবেগের হাত ধরে হাঁটল প্রশাসনিক কূটনীতি। এবং দেশ ও রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসনের ভাবী সমীকরণ ঘিরে জল্পনা, নানাবিধ অঙ্ক যদি বাস্তব হয়, তা হলে আবেগের সরণিতেও অনেকে হাঁটলেন।

ক্লাবহাউসের সোফায় বসে চুনী গোস্বামীর মনে পড়ে গেল সিএবি থেকে জীবনকৃতি প্রাপ্তির দিন। বঙ্গ ক্রিকেটের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং ভারতীয় ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি চুনী এ দিন বলছিলেন, ‘‘সিএবি যে দিন আমাকে জীবনকৃতির সম্মান দেয়, সে দিন ডালমিয়া বলেছিল, এই প্রথম কাউকে দেখলাম যে দেশের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হয়েও সিএবি-র সম্মান পাচ্ছে। কথাটা ভুলব না।’’ লক্ষ্মীরতন শুক্ল যেমন ভুলবেন না পুরনো এক বকুনির কথা। আঠারোর লক্ষ্মী তখন জাতীয় দলে ঢুকেছেন সবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। ডালমিয়া একদিন ডেকে পাঠিয়ে কড়া বকুনি দেন। বলে দেন, তোমার কাজ অনুষ্ঠানে যাওয়া নয়। খেলা। বোর্ডের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্রের কাছে ডালমিয়া আবার থাকবেন ক্রিকেটের প্রতি একনিষ্ঠ যোদ্ধার চরিত্রে। যিনি নিজের ছ’বছরের ছেলের অসুস্থতার খবরেও সিএবি ছেড়ে যাবেন না। ওষুধ পাঠিয়ে বেরোবেন রাত এগারোটায়। সামনে আন্তর্জাতিক ম্যাচ যখন, যাওয়া সম্ভব কী ভাবে?

মহাশ্মশানের কাঠের চুল্লিরও সাধ্য নেই যে আবেগ, যে স্মৃতিকে পোড়ানোর। বিকেলে কেওড়াতলা পৌঁছে দেখা গেল, তাঁর শায়িত শরীরের উপর নানা আচারবিধি চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঠের চুল্লির জঠরে যা অন্তর্হিত হয়ে গেল। জগমোহন ডালমিয়া চলে গেলেন চিরতরে।

কিন্তু শুধু বোধহয় নশ্বর মনুষ্য শরীরটাই গেল। বঙ্গ ক্রীড়ামহলে ‘জগুদা’-র প্রভাব, ক্রিকেট-ধর্ম তো থেকে গেল। অবিনশ্বর হয়ে।

ছবি: উৎপল সরকার

rajarshi gangopadhyay rajib ghosh dalmiya heir heir cricket administration cab bcci sahard pawar dalmiya cremation sharad pawar anurag thakur shashank manohar MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy