ভারতসেরাদের ঘরে ফেরা।
মোহনবাগান তাঁবু ছুঁয়েই সনি নর্ডি ছুটলেন ব্যারেটোর বাড়ি আড্ডা মারতে। আই লিগ নিয়ে ক্লাব লনে মহোৎসবের মধ্যেই তাঁবুর পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘‘এ রকম উচ্ছ্বাস বিশ্বেই খুব কম জায়গায় দেখেছি।’’
পিয়ের বোয়া ওরফে বাগানের পিভট পিবো-ও বলছেন, ‘‘ভারতে এ রকম ফুটবল পাগল জনতা রয়েছে জানতাম না। কলকাতার আইএসএল জয়ের পর যা হয়েছিল সেটা মেকি। আজ যা হল সেটাই আসল আবেগ।’’
কেমন সেই আবেগ?
সোমবার দুপুর দু’টো। মাথার উপর গনগনে রোদ। আই লিগ ট্রফি নিয়ে শহরে ফেরা বাগানের টিম বাস তখন বাগুইআটিতে। বাসের আগে-পিছে সবুজ-মেরুন সমর্থকের ঢল নেমেছে নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করেই। টুপি, জামা, মুখের রং সবুজ-মেরুন। টিম বাসেও তখন হুড়ুমতাল নাচ চলছে প্রীতম কোটালদের। বিমানবন্দরেই এক সমর্থকের কাছ থেকে ছোট ঢোলটা চেয়ে নিয়ে বাসে উঠে পড়েছিলেন বিক্রমজিৎরা। সেই বাজনার তালে তালে নাচছিলেন লালকমল, মণীশরা। আর পিছনের আসনে বসে চুপচাপ দেখছিলেন সনি আর বোয়া। হঠাৎই বাস দাঁড়িয়ে পড়ায় জানলা থেকে মুখ বাড়ালেন সৌভিক। দেখলেন বাসের সামনে সবুজ-মেরুন পতাকার ভিড়ে ডিগবাজি খাচ্ছেন এক সমর্থক। ততক্ষণে টিম বাস ধাবমান সমর্থকদের ম্যাটাডোর এসে পড়েছে। যাতে লাগানো সাউন্ড সিস্টেমে পরিত্রাহি বাজছে ‘‘চিরকাল রেলায় আছে, থাকবে মোহনবাগান...।’’
একটু এগিয়েই রাজারহাটের বাগান সদস্য-সমর্থকদের উদ্যোগে সংবর্ধনার আয়োজন। আই লিগ ট্রফি হাতে সেই মঞ্চে উঠলেন বাগান অধিনায়ক শিল্টন পাল, কাতসুমি আর কোচ সঞ্জয় সেন। শিল্টন সেখানে বলে দিলেন, ‘‘২০০২-এ সেলিব্রেশনের সময় টিএফএ-তে শিক্ষার্থী ছিলাম। আজ সেই আবেগটা হাতেনাতে মালুম হল।’’ সঞ্জয় বললেন, ‘‘এত মানুষ! এ ভাবেই পাশে থাকবেন সারা বছর। বাংলার ফুটবল এগোবেই এগোবে।’’
সঞ্জয়দের বাস যত এগোচ্ছিল, ততই ভিড় বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই বাগানের টিম বাস বিমানবন্দর থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত এ দিন সব সবুজ-মেরুন সমর্থককে টেনে বার করে এনেছিল রাস্তায়। বাড়ি, অফিস, দোকান, থেকে বেরিয়ে যাঁরা সেলফি তুললেন আনন্দ-মুহূর্তের। নিলেন প্রিয় তারকাদের সাক্ষর। সমর্থকদের সঙ্গে খুনসুটি করে হাতের বোতলের জলে তাঁদের স্নান করালেন সনি-বলবন্তরা।
ফুটবলারদের হাতের কাছে না পেয়ে ষোড়শী-অষ্টাদশী সমর্থকদের কেউ কেউ চুম্বন আঁকলেন টিম বাসের গায়েই। যা দেখে মুচকি হাসি একদম সামনের সিটে বসা বাগান কোচের।
চিংড়ির মালায় বরণ শিল্টনদের।
আসলে শহরটারই রং যেন এ দিন দুপুরের পর ঘণ্টা পাঁচেক হয়ে গিয়েছিল সবুজ-মেরুন। ক্লাব তাঁবুতে কারও হাতে পতাকা। কেউ বা হাজির আসল চিংড়ির মালা নিয়ে। যা পরিয়ে দেওয়া হল অধিনায়ক শিল্টন পালের গলায়। রানিকুঠি থেকে রণিতা মণ্ডল এসেছিলেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক সনিকে এক বার ছুঁয়ে দেখতে। তবে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি শেষবেলায় সনি, বোয়ারা পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায়।
তারকাদের সংবর্ধনার জন্য ময়দানের বিখ্যাত বটতলার সামনে এক ডজন ঘোড়ার গাড়ি সাজিয়ে রেখেছিলেন বাগান কর্তারা। কিন্তু টিম বাস ময়দান চত্বরে ঢুকতেই বহুক্ষণ অপেক্ষমান সমর্থকদের কেউ কেউ উঠে পড়লেন বাসের উপরেই। কেউ বা ঝুললেন জানলা ধরে। বেগতিক দেখে আর ঘোড়ার গাড়িতে ফুটবলারদের না তুলে সটান নিয়ে যাওয়া হয় ক্লাব তাঁবুতে।
সেখানে তখন মঞ্চ ঘিরে হাজির অন্তত পনেরো হাজার সমর্থক। বাগানের অনেক ম্যাচে যত দর্শক হয় না। বাগান কর্তাদের অদূরদর্শিতায় পদপিষ্ঠ হওয়ারও আশঙ্কা ছিল। নিরাপত্তার সে রকম বন্দোবস্ত না থাকায় বানের জলের মতোই তাঁবুতে ঢুকে পড়েছিলেন সদস্য-সমর্থকরা। ভেঙে পড়ে তাঁবুর রেলিং। লনের অনেক বেঞ্চ। যা দেখে কিংশুক দেবনাথদের মতো কারও কারও রসিকতা, ‘‘আই লিগ পরপর কয়েক বার পেলে তো বাগান তাঁবুটাই ভেঙে পড়বে।’’ তার মধ্যেই ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্র পতাকা উত্তোলন করেন অধিনায়ক শিল্টনকে নিয়ে। ততক্ষণে চিরশত্রু ইস্টবেঙ্গলেরও মিষ্টির হাঁড়ি চলে এসেছে বাগান তাঁবুতে। অঞ্জন বললেন, ‘‘কাল ম্যাচের পর প্রথম ফোনটাই পেয়েছিলাম ইস্টবেঙ্গল সচিব কল্যাণ মজুমদারের। বলেন আমরা না পারলেও আপনারা বাংলায় আই লিগ নিয়ে আসায় ধন্যবাদ।’’
(সহ প্রতিবেদন: তানিয়া রায় ও সোহম দে)
ছবি: উৎপল সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy