চ্যাম্পিয়ন: ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ড্রেসিংরুমে চেলসির ফুটবলারদের উৎসব। ছবি: টুইটার
শুক্রবার রাতে তখন খেতাব জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে দিয়েগো কোস্তাদের। এইমাত্র তাঁরা ১-০ হারিয়ে উঠলেন ওয়েস্ট ব্রমউইচ-কে। কিন্তু তিনি— চেলসির এই অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের কারিগর কোথায় গেলেন? বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত একটি দল যাঁর মিডাস-ছোঁয়ায় ফের জীবন্ত হয়ে উঠে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হল!
তিনি মানে আন্তোনিও কন্তে। একের পর এক টেলিভিশন ইন্টারভিউ দিতে তখন ব্যস্ত চেলসির নতুন ‘ডন’। ড্রেসিংরুমে দীর্ঘ অপেক্ষায় তাঁর ফুটবলাররা। কখন তাঁদের প্রিয় ম্যানেজার এসে পৌঁছবেন? যখন ছুটতে ছুটতে এলেন কন্তে, তাঁর টিম তৈরিই ছিল। শ্যাম্পেন, বিয়ার, জল— যে যেরকম পানীয় হাতের সামনে পেলেন, তা দিয়ে স্নান করিয়ে দিলেন ম্যানেজারকে। কন্তের বিখ্যাত কালো স্যুট নষ্ট হয়ে গেল। ইপিএল জয়ী ম্যানেজার ফিরলেন ট্র্যাকস্যুট পরে।
তাঁকে নিয়ে এই বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস হওয়ারই কথা। এক বছর আগে তিনি যখন দায়িত্ব নিতে এলেন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে, টালমাটাল অবস্থা চলছে। জোসে মোরিনহোকে নিয়ে উত্তাল ক্লাব। ‘স্পেশ্যাল ওয়ান’-কে বরখাস্ত করা হয়েছে। ফুটবলার-ম্যানেজারের মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। কন্তে এসে প্রথমেই খাদ্য তালিকায় পাল্টে দিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে এসে ফুটবলাররা দেখলেন তাঁদের প্রিয় পিৎজা, পাস্তা, স্যান্ডউইচ, চিকেন, স্ক্র্যাম্বেল্ড এগ— কিছুই খাবারের টেবলে নেই। তার জায়গায় আছে বাদাম আর ড্রায়েড ফ্রুট। কয়েক জন ফুটবলার তো সেটা দেখে মনে করেছিলেন, ভুল ঘরে পৌঁছেছেন। ফিরেই গেলেন তাঁরা। আবার আসতে হল সেই রুমেই। ফুটবলাররা প্রথম দিনেই বুঝে গেলেন, নতুন জমানা শুরু হয়ে গেল।
এর পর ট্রেনিং। কন্তের গভীর বিশ্লেষণ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে থাকলেন ফুটবলাররা। মোরিনহো নন, চেলসিতে কোণ ব্যবহার করে একদম পরিমিত দূরত্ব দৌড়নোর অনুশীলন এনেছেন কন্তেই। ফুটবলাররা যতক্ষণ মাঠে নেমে দৌড়াদৌড়ি করেন, ততটাই সময় তাঁদের ব্যয় করতে হয় থিওরি-রুমে। কারণ, কন্তের কাছে ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের কাজ বুঝে নিতে দ্বিধা করেন না, আবার পূর্বসূরিদের প্রতিও সম্মান দেখাতে জানেন। এটাই আন্তোনিও কন্তে। চেলসির দায়িত্ব নিচ্ছেন ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে তিনি এক বার স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে এসেছিলেন কয়েকটা ব্যাপারে কথা বলতে। চেলসির তখন ট্রেনিং চলছে। মোরিনহো বরখাস্ত হয়ে গিয়েছেন। প্র্যাকটিস করাচ্ছেন অন্তর্বর্তী ম্যানেজার খুস হিডিঙ্ক। তাঁর অনুশীলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন। হিডিঙ্ক শেষ করার পরেই তিনি গিয়ে হাত মেলালেন ফুটবলারদের সঙ্গে।
চেলসির ফুটবলে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী তিন জন। তালিকায় প্রথম নাম অবশ্যই মালিক রোমান আব্রামোভিচ। কিন্তু তাঁর প্রধান দুই ব্যক্তি— টেকনিক্যাল ডিরেক্টর মাইকেল এমেনালো এবং ডিরেক্টর মারিনা গ্রানোভস্কাইয়া। এঁদের দু’জনের আস্থা জিতে নেওয়াটা কন্তের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। মোরিনহোর আমলে এমানালোই সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, ‘‘ম্যানেজার ও ফুটবলারদের মধ্যে সম্পর্কের তার ছিড়ে গিয়েছে।’’
কন্তে দায়িত্ব নিয়েই তার জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। প্রাক-মরসুম ট্রেনিংয়ে নামার আগে নতুন ম্যানেজার বারবিকিউ আয়োজন করলেন চেলসির ফুটবলারদের জন্য। সেখানে প্রত্যেকের পরিবারকে আসার অনুরোধ জানালেন। ফাইভ-আ-সাইড ফুটবল খেলার আয়োজন করলেন ফুটবলারদের বাচ্চাদের জন্য। সবচেয়ে ‘বদমেজাজী’ এবং ‘অবাধ্য’ বলে পরিচিত দিয়েগো কোস্তা সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেললেন চল্লিশ মিনিট ধরে। সে দিনই টিম বন্ডিংয়ের ভিত্তি প্রস্তর করে ফেললেন কোস্তা।
এর পর অস্ট্রিয়া ও লস অ্যাঞ্জেলসে যখন টিম গেল প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে, সাপোর্ট স্টাফরাও চমকে গেলেন কন্তের উষ্ণতা দেখে। মোরিনহোর আমলে এঁরাই বিভ্রান্তিতে ভুগতেন। নতুন ম্যানেজার প্রত্যেক দিন আগে এসে তাঁদের জড়িয়ে ধরছেন, হ্যান্ডশেক করছেন। সহকারী কোচেরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা পরামর্শ দিতে থাকলেন। তাতে চেলসির দলের অন্দরে একতা আরও বেড়ে গেল।
বড়দিনের পার্টিতে চেলসির প্রথা হচ্ছে, ম্যানেজারকে একটি রেকর্ডেড মেসেজ দিতে হয়। সেই বার্তা ক্রিসমাস ইভেন্টে প্রচার করা হয়। কন্তেকে যখন ক্লাবের কর্তারা সেটা জানাতে এলেন, তিনি পাল্টা প্রস্তাব দিলেন— ‘‘আমি কি সশরীরে অনুষ্ঠানটায় থাকতে পারি?’’ শুধু মুখের কথা নয়, বড়দিনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে অতিথিদের সঙ্গে খুশি মনে সময় কাটালেন। ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ারে শুভেচ্ছা কার্ড-সহ তাঁর পাঠানো বিশেষ ড্রিঙ্ক পৌঁছে যায় নেপথ্যে কর্তব্যরত বিশেষজ্ঞদের কাছে। এঁরা কেউ গোলকিপারদের কোচ। কেউ অ্যাকাডেমিতে নতুন ফুটবলার তৈরি করছেন। সকলে মুগ্ধ কন্তের এই ব্যক্তিগত উষ্ণতা দেখে।
মোরিনহো অতীত। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নতুন স্পেশ্যাল ওয়ানের দিকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy