Advertisement
E-Paper

অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াকে কাগজ বিক্রির জন্য যা খুশি তো লিখতেই হবে

বিশ্বকাপ বোধনের চব্বিশ ঘণ্টা আগে কোন কালে কোন অধিনায়ক তাঁর দেশের মিডিয়াকে এমন তীব্র আক্রমণ করেছে! সেই বিরানব্বইয়ে ইমরান খানের পর মনে হয় না কেউ কখনও করেছে বলে! অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য বুধবার সকাল-সকাল অ্যাডিলেড থেকে পঞ্চাশ মিনিট বিমানদূরত্বের মেলবোর্ন পর্যন্ত দৌড়ে তাঁকে যে মেজাজে পাওয়া গেল, তার জন্য প্লেন কেন, হেঁটেও আসা যেত। আঁচড়ে-আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত এক সেনাপতি দেখাল মাইকেল ক্লার্ক-কে। ইন্টারভিউয়ের ভেন্যু অস্ট্রেলীয় টিম হোটেল ল্যাংহ্যামের বিজনেস সেন্টার। মাঠের জন্য একেবারে তৈরি হয়ে এসেছেন অধিনায়ক। এমসিজিতে একটু পর প্র্যাকটিস ম্যাচে পুনরভ্যুদয় হচ্ছে তাঁর। এত বড় চোট সারিয়ে ফেরা লোক এই সময় আরও রক্ষণাত্মক হবে। বিতর্ক বাঁচিয়ে চলতে চাইবে এটাই স্বাভাবিকতা। আর তাই বুধবার সকাল বাঁধনহারা ব্যতিক্রমের দিন ছিল...

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৫৯
ক্লার্কের মোবাইলের স্ক্রিনসেভার। যেখানে আজও বেঁচে ফিল হিউজ।

ক্লার্কের মোবাইলের স্ক্রিনসেভার। যেখানে আজও বেঁচে ফিল হিউজ।

বিশ্বকাপ বোধনের চব্বিশ ঘণ্টা আগে কোন কালে কোন অধিনায়ক তাঁর দেশের মিডিয়াকে এমন তীব্র আক্রমণ করেছে! সেই বিরানব্বইয়ে ইমরান খানের পর মনে হয় না কেউ কখনও করেছে বলে! অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য বুধবার সকাল-সকাল অ্যাডিলেড থেকে পঞ্চাশ মিনিট বিমানদূরত্বের মেলবোর্ন পর্যন্ত দৌড়ে তাঁকে যে মেজাজে পাওয়া গেল, তার জন্য প্লেন কেন, হেঁটেও আসা যেত। আঁচড়ে-আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত এক সেনাপতি দেখাল মাইকেল ক্লার্ক-কে। ইন্টারভিউয়ের ভেন্যু অস্ট্রেলীয় টিম হোটেল ল্যাংহ্যামের বিজনেস সেন্টার। মাঠের জন্য একেবারে তৈরি হয়ে এসেছেন অধিনায়ক। এমসিজিতে একটু পর প্র্যাকটিস ম্যাচে পুনরভ্যুদয় হচ্ছে তাঁর। এত বড় চোট সারিয়ে ফেরা লোক এই সময় আরও রক্ষণাত্মক হবে। বিতর্ক বাঁচিয়ে চলতে চাইবে এটাই স্বাভাবিকতা। আর তাই বুধবার সকাল বাঁধনহারা ব্যতিক্রমের দিন ছিল...

প্রশ্ন: আপনারা তো দুর্ধর্ষ খেলছেন এই মুহূর্তে! লোকে বলতে শুরু করে দিয়েছে কাপ জিতবে হয় অস্ট্রেলিয়া, না হয় দক্ষিণ আফ্রিকা!

ক্লার্ক: এখন দুর্দান্ত খেলে বিশেষ লাভ নেই। বিশ্বকাপ আসলে তিন ম্যাচের খেলা। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল। এখন সামান্য গড়িয়ে গড়িয়ে চললেও কিছু আসে-যায় না। খেলাটা পিকে তুলতে হবে মার্চের ১৫ থেকে ২৯ ওই দুটো সপ্তাহ। যে টিম সেটা সবচেয়ে ভাল পারবে তারাই বিশ্বকাপ জিতবে।

প্র: আপনি ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ খেলছেন কি না তা নিয়ে নানান কাহিনি। সত্যিটা কী?

ক্লার্ক: সত্যিটা এই যে, উত্তরটা আমার হাতে নয়। আমাদের মেডিক্যাল টিম আমাকে জাজ করবে। আজ আমার এমসিজি পারফরম্যান্স, আমার নড়াচড়া খতিয়ে দেখবেন কোচ আর সিলেক্টর। তার পর সিদ্ধান্ত।

প্র: অ্যাডিলেডে আপনার সেই সাংবাদিক সম্মেলনে ছিলাম বলেই আজ টিম জার্সিতে আপনাকে দেখে এত অবাক লাগছে। সে দিন আপনি প্রায় চোখে জল এনে বলেছিলেন আর হয়তো আমার ক্রিকেট খেলা হবে না। হ্যামস্ট্রিং এমনিতেও সারতে প্রচুর সময় নেয়। দু’মাসে কী করে ফিট হয়ে গেলেন?

ক্লার্ক: সত্যি সে দিন মনে হয়েছিল আর বুঝি বাকি জীবনে ক্রিকেট খেলা হল না। আমার পিঠ আর ডান পায়ের হ্যামস্ট্রিং আগেই গেছিল। এর পর যখন বাঁ পায়ের হ্যামস্ট্রিংটাও গেল, ধরেই নিয়েছিলাম সব শেষ। কিন্তু আমার অপারেশন খুব সাকসেসফুল। গত এক মাস ধরে আমি দিনে আট ঘণ্টা করে রিহ্যাব করছি। সুস্থ হওয়ার জন্য মরণপণ লড়েছি। তার পর আজ আমি এখানে! শুভেচ্ছা জানান যেন প্র্যাকটিস ম্যাচটায় সফল হই।

প্র: নিশ্চয়ই, আমাদের সবার শুভেচ্ছা আপনার সঙ্গে। কিন্তু একটা কথা বলুন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া আপনার কামব্যাক করার চেষ্টা নিয়ে নেগেটিভ লিখছে কেন? ওরা বলছে ক্যাপ্টেনের আনফিট হয়ে দলে ঢোকার এই সংস্কৃতি আর যাই হোক, অস্ট্রেলীয় নয়!

ক্লার্ক: পাগলামি করছে! ওরা কি ভুলে গেছে ২০০৭ বিশ্বকাপে সাইমন্ডসকে আমরা নিয়ে গেছিলাম হাত স্লিংয়ে ঝোলানো অবস্থায়। একটাই কারণে যে, সবাইয়ের ভরসা ছিল, ও যদি একটু সুস্থও হয়ে যায়। শেষ দিকের ম্যাচে দারুণ কাজে দেবে। মিডিয়া সব জানে, তবু লিখছে। ওদের তো কাগজ বিক্রি করতে হবে না!

প্র: বিক্রি?

ক্লার্ক: হ্যাঁ। ভাল খবর তো বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় যত রাজ্যের নেগেটিভ খবর। টিভি খুললে দেখবেন কী কী খবর দেখায়! প্লেন ক্র্যাশ। রেপ। গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। কেউ ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ল। কোথায় কার ওপর লুঠতরাজ হল। এগুলোই তো বিক্রি হয়? ক’দিন দেখেন যে, একটা বাচ্চা ছেলের কথা এরা বলছে যে ক্যানসারের সঙ্গে অসামান্য যুদ্ধ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসছে?

প্র: মিডিয়া আভাস দিচ্ছে আপনার আর স্টিভ স্মিথের মধ্যে ছায়াযুদ্ধের।

ক্লার্ক: ওরা কী জানে? ওরা কি ভেতরের খবর রাখে? ওরা কি জানে যে টিমের ক’জনের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ গত দু’মাস ধরেও ছিল? ওরা কি জানে টিমে ক’জন আমাকে অনবরত এসএমএস করে? ওরা কি জানে স্টিভ স্মিথের দল ওরা যেটা বলছে সেটা করছেন আসলে নির্বাচকেরা? ওরা না জেনেই যা ইচ্ছে ছাইপাশ লিখে চলছে। যা বাবা লেখ। লিখে ভাল থাক।

প্র: মাইকেল আপনি এত বছর খেলছেন। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ায় আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কারা? তাদের কেন বলছেন না?

ক্লার্ক: মিডিয়ায় আমার কোনও বন্ধু নেই।

প্র: এক জনও না?

ক্লার্ক: এক জনও না।

প্র: সে কী! শেন ওয়ার্ন শুনেছিলাম আপনার খুব কাছের মানুষ।

ক্লার্ক: হ্যাঁ, ওয়ার্ন তো আমার বিশেষ বন্ধু। এই বিপর্যয়ের সময় আগাগোড়া পাশে থেকেছে। কিন্তু ও তো এক্স ক্রিকেটার। সেই অর্থে মিডিয়া নয়।

প্র: মাত্র ক’মাস আগে ফিল হিউজ শোকবক্তৃতা দেওয়ার সময় অজি মিডিয়া আপনাকে রাষ্ট্রনায়কতুল্য মর্যাদা দিচ্ছিল। হঠাৎ কী হল?

ক্লার্ক: হঠাৎ আবার কী হবে! ওরা তো বরাবর আমার বিরোধী। জীবনের প্রথম দু’একটা সিরিজ বাদ দিলে তো নাগাড়ে আমার সমালোচনাই করে গিয়েছে।

প্র: এই যে উপমহাদেশে আমাদের সবার ধারণা অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া হল অস্ট্রেলিয়ান টিমের ব্যাপারে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। সেটা কি বলতে চান ফ্যালাসি? সত্যি নয়?

ক্লার্ক: (তীব্র বিরক্তির সঙ্গে) হাসাচ্ছেন তো দেখছি! অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া করবে সাপোর্ট অস্ট্রেলিয়ান টিমকে— তা হলেই হয়েছে। আমাদের সোনার টিমের সময়ই করেনি। আমরা তখন টানা জিতছি। সেই দুর্ধর্ষ টিম। অথচ ওরা আপসেট হয়ে যেত। বলত, ক্রিকেট বোরিং হয়ে যাচ্ছে। একটা টিমের এমন একাধিপত্য। এর পর আমাদের টিমটা অনেক বদলাল। আমরা মাঝেমধ্যে হারতে শুরু করলাম। তাতেও তীব্র সমালোচনা— কোথায় গেল সেই টিম! আমি তো আজও বুঝতে পারি না তোরা কী করলে খুশি হবি বল তো? আমরা জিতলে, না হারলে?

প্র: মাইকেল, আপনার মিডিয়া যা ইচ্ছে বলুক, ভারতের মানুষ কিন্তু ফিল হিউজের শোকসভায় আপনার বক্তৃতা টিভিতে দেখে আপনারই সঙ্গে কেঁদেছে।

ক্লার্ক: ভারতের মানুষদের আমার ধন্যবাদ। ভারতীয় টিমকে আমার ধন্যবাদ যে, ওরা কাঠখড় পুড়িয়ে শেষকৃত্যে যোগ দিতে এসেছিল। ফিল এমনই একটা মানুষ ছিল যে আজও ওকে কেউ ভুলতে পারে না। গোটা ক্রিকেটবিশ্ব যেন ওর শোকে এক হয়ে গিয়েছিল। আজও আমার ভাবতে খারাপ লাগে যে বক্তৃতার মধ্যে এত কেঁদেছিলাম। টানা পড়তে পারিনি। আজ বলি, বহু চেষ্টা করেও পারিনি। দু’মাস হয়ে গিয়েছে। অথচ আজও উইকেটের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রতি বার মনে হয়, সঙ্গে ফিল যাচ্ছে।

প্র: অসুবিধে হয় না ব্যাট করার সময়? দুটো করে বল দেখেন না?

ক্লার্ক: না, বরং আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকি। এখন প্রতি বার আমাকে ফিলের জন্যও ব্যাট করতে হয়।

প্র: আপনার চোখের জল শুকিয়ে এখন তা হলে কাঠিন্য?

ক্লার্ক: না, জলগুলো বিদায় নেয়নি। মাঝেমধ্যে কিলবিল করে ফেরত আসে। আমার জীবনের সর্বত্র জুড়ে এখনও ফিল। এই তো দেখুন না স্ক্রিনসেভারে ওর ছবি।

প্র: এটা কবে তোলা?

ক্লার্ক: দুবাইয়ে তোলা। এটাই আমাদের একসঙ্গে শেষ ডিনার।

প্র: নর্ম্যাল রঙিন ছবি নয় কেন? মনে হচ্ছে সেপিয়া টোনে।

ক্লার্ক: ফটোশপে করে নিয়েছি।

প্র: কেন?

(ক্লার্ক কোনও জবাব দিলেন না। উদাসীন চাউনি বাইরের দিকে)

প্র: অ্যাডিলেডের সেঞ্চুরিটা হিউজ মারা যাওয়ার ঠিক পরেই করা। ওটা চোখের জল মুছে করেছিলেন কী করে?

ক্লার্ক: ওই যে শপথ নিয়েছিলাম ওর জন্য খেলব। ওর জন্য রান করব। ফিলকে একটা হান্ড্রেড করে দেব!

প্র: বিরানব্বইয়ে এখানে হওয়া শেষ বিশ্বকাপে ইমরানের এ রকমই একটা মোটিভেশন ছিল। মায়ের নামে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির জন্য কাপ জেতো! এ বারের বিশ্বকাপে কি আপনাদের স্লোগানটাও হতে পারে হিউজের স্মৃতিতে কাপ জেতো?

ক্লার্ক: হওয়া উচিত। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ফিলের জন্য কাপ জিততে চাইব। তবে টিমের সঙ্গে কথা হয়নি। জানি না ওদের মানসিকতা কী? তবে আশা করব ওরা এ ভাবেই ভাববে।

প্র: চোট পাওয়ার পর মেলবোর্ন টেস্টে আপনি তো চ্যানেল নাইনে বিশেষজ্ঞের কাজও করলেন।

ক্লার্ক: হ্যাঁ তখন তো খেলার কোনও প্রশ্নই ছিল না।

প্র: মনে করুন আপনার চোট সারেনি। আবার আপনি চ্যানেল নাইন বক্সে। আর চ্যানেল বলেছে এই বিশ্বকাপের সম্ভাব্য সেরা তিন বেছে দাও— কাকে কাকে বাছবেন?

ক্লার্ক: ওরে বাবা মাত্র তিন! কাকে রাখব, কাকে বাদ দেব? ওটা বাড়ানো যায় না?

প্র: ঠিক আছে, সেরা পাঁচ।

ক্লার্ক: আমি তিনেই রাখার চেষ্টা করছি। হুঁ হুঁ হুঁ... প্রথম নাম মিচেল জনসন। তার পর বিরাট কোহলি। তিন-তিন-তিন এবি ডে’ভিলিয়ার্স।

প্র: এই ফর্মহীন কোহলি আপনার লিস্টে দু’নম্বরে?

ক্লার্ক: অবশ্যই। আগের দিন আমাদের সঙ্গে কেমন শুরু করেছিল দেখেছিলেন? রানটা নেহাত পায়নি। বিরাটের অ্যাডিলেড ইনিংস আজও ভুলতে পারি না আমি। আমার দেখা বেস্ট ফোর্থ ইনিংস নক।

প্র: কিন্তু ওটা তো টেস্টে?

ক্লার্ক: কিছু আসে-যায় না। মনে রাখবেন ভারত ইদানীং যা-ই খেলুক, প্রস্তুতির দিক দিয়ে সব ক’টা বিদেশি টিমের মধ্যে এক নম্বরে আছে। চার মাস ধরে এখানে রয়েছে। বিরাটের মতো প্লেয়ার কখনও সেই সুযোগ ছাড়ে!

ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।

icc world cup australia gautam bhattacharya michael clarke world cup 2015
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy