Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কোর্টে মুক্তি, কিন্তু মাঠে ফেরায় প্রশ্ন

গুরুনাথ মইয়াপ্পন— আজীবন নির্বাসিত। শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত— প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস। রাজ কুন্দ্রা— আজীবন নির্বাসিত। অঙ্কিত চহ্বাণ— মুক্ত। কারণ একই। প্রমাণের অভাব। চেন্নাই সুপার কিংগস ও রাজস্থান রয়্যালস— দু’বছরের নির্বাসন। অজিত চাণ্ডিলা— বেকসুর খালাস। আশ্চর্য লাগতে পারে। দেশ এক। অভিযোগ প্রায় একই রকম গুরুতর। অথচ এক পক্ষ চরম সাজা পেল। আর এক পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগটাই প্রমাণ করা গেল না! সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢা-র কমিশন দিন কয়েক আগে কঠিনতম নির্বাসন দিয়েছে গুরুনাথ মইয়াপ্পনদের।

প্রমাণের অভাবে আইপিএল স্পট ফিক্সিং কাণ্ডে বেকসুর খালাস পেলেন শ্রীসন্তরা। যদিও নির্বাসন তুলল না বোর্ড। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা

প্রমাণের অভাবে আইপিএল স্পট ফিক্সিং কাণ্ডে বেকসুর খালাস পেলেন শ্রীসন্তরা। যদিও নির্বাসন তুলল না বোর্ড। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৩
Share: Save:

গুরুনাথ মইয়াপ্পন— আজীবন নির্বাসিত।
শান্তাকুমারন শ্রীসন্ত— প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস।
রাজ কুন্দ্রা— আজীবন নির্বাসিত।
অঙ্কিত চহ্বাণ— মুক্ত। কারণ একই। প্রমাণের অভাব।
চেন্নাই সুপার কিংগস ও রাজস্থান রয়্যালস— দু’বছরের নির্বাসন।
অজিত চাণ্ডিলা— বেকসুর খালাস।
আশ্চর্য লাগতে পারে। দেশ এক। অভিযোগ প্রায় একই রকম গুরুতর। অথচ এক পক্ষ চরম সাজা পেল। আর এক পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগটাই প্রমাণ করা গেল না!
সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢা-র কমিশন দিন কয়েক আগে কঠিনতম নির্বাসন দিয়েছে গুরুনাথ মইয়াপ্পনদের। আইপিএলের রোশনাইয়ের তোয়াক্কা না করে দু’বছরের জন্য নির্বাসিত করার নির্দেশ দিয়েছে দুই হেভিওয়েট ফ্র্যাঞ্চাইজিকে। ঠিক তখনই নয়াদিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্ট প্রমাণের অভাবে শ্রীসন্ত-সহ একচল্লিশ অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিল স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি থেকে। শনিবার আদালতের তরফে সাফ বলে দেওয়া হল, শ্রীসন্তরা যে স্পট ফিক্সিংয়ে যুক্ত, তার কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেনি দিল্লি পুলিশ। অতএব— তাঁরা মুক্ত।
এই রায় যেমন এক দিকে দেশজুড়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করছে, ঠিক তেমনই দিল্লি পুলিশের ভূমিকাকেও জাতীয় আলোচনার ময়দানে আছড়ে ফেলছে। বিস্ময় এই কারণে যে, দু’বছর আগে আইপিএল ঘিরে দেশজোড়া তোলপাড়টা তো শ্রীসন্তদের গ্রেফতারের খবর দিয়েই শুরু হয়েছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত মইয়াপ্পনদের অনেক আগেই ‘দোষী’ বলেছিল। লোঢা কমিশনকে শুধু তাঁদের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল। অথচ শ্রীসন্তরা মুক্ত হয়ে গেলেন! যা দেখে বোর্ডের ফিনান্স কমিটির সদস্য বিশ্বরূপ দে-র মতো কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে দিলেন, ‘‘কর্মকর্তারা তো গড়াপেটা করেছে প্লেয়ারদের মাধ্যমে। এ বার প্লেয়াররাই যদি দোষী না হয়, তা হলে কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হল কেন?’’ শনিবার পাটিয়ালা হাউস কোর্টের রায়ের পর আরও একটা কথা বলাবলি চলছে। বলা হচ্ছে দিল্লি পুলিশের

হাতে যদি প্রমাণই না থাকে, তা হলে তারা মামলা করতে গেল কেন? আর কেনই বা দেশবাসীর কাছে হাস্যস্পদ হতে গেল?

মুশকিল হল, আদালতের চৌহদ্দিতে বিশাল জয় তুলে নিয়েও শ্রীসন্তদের ক্রিকেট-মাঠে ফেরার যুদ্ধে জয়ের এখনও কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই আদালতে যুদ্ধজয়ের আনন্দটা স্থায়ী হল মেরেকেটে ঘণ্টাখানেক। ‘ঈশ্বর চেয়েছিলেন বলেই ক্রিকেটে ফিরলাম’, ‘আমি কালই স্টেডিয়ামে

নেমে পড়তে চাই’ জাতীয় বিবৃতির মধ্যে থেকে প্রাক্তন ফাস্ট বোলারের নিঃসৃত আনন্দ নিভে গেল ভারতীয় বোর্ডের তরফ থেকে পাঠানো আর এক বিবৃতিতে। যেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া হল, বোর্ড শ্রীসন্তদের নিজস্ব আইন মেনে শাস্তি দিয়েছে। কোনও ফৌজদারি মামলার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। বোর্ড যে শাস্তি দিয়েছিল, সেটা বহাল থাকছে। অর্থাৎ নির্যাসে বলে দেওয়া, পাটিয়ালা হাউস কোর্ট শ্রীসন্তদের বেকসুর খালাস দিতে পারে। কিন্তু বোর্ড নিজেদের রায় থেকে সরবে না।

সোজা কথায়, বোর্ড অনমনীয়। কেউ কেউ বুঝতে পারছেন না, দিল্লি পুলিসের কাছে হাওলায় টাকা লেনদেনের হিসেব ছিল। তার পরেও শ্রীসন্তরা কী ভাবে মুক্তি পেয়ে গেলেন? তবে একটা ব্যাপারে বোর্ড কর্তারা একমত। কোনও ভাবেই তাঁরা শ্রীসন্তদের খেলতে দিতে চান না। এমনকী আজকের রায়ের পর উচ্চ আদালতে যেতেও আপত্তি নেই একাংশের।

কেন? বলা হচ্ছে, যে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি শ্রীসন্তদের শাস্তি দিয়েছিল তার প্রধান ছিলেন দেশের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। যাঁর প্রভাব বোর্ডে এখনও প্রবল। জেটলির নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। তবে কারও কারও এ-ও আশঙ্কা, বোর্ড এমন অনমনীয় থাকলে শ্রীসন্তরাই হয়তো ‘রেস্ট্রেইন্ট অব ট্রেড’ অর্থাৎ বোর্ডের পেশাগত নিষেধাজ্ঞা জারি করার বিরুদ্ধে আগেভাগে আদালতে চলে যেতে পারেন। বলতে পারেন, যেখানে আদালত আমাকে ছাড়পত্র দিয়েছে, বেকসুর খালাস করেছে, সেখানে কীসের ভিত্তিতে বোর্ড সেটা অগ্রাহ্য করতে পারে? অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আজহার-ক্রোনিয়েকে শাস্তি দেওয়া গিয়েছিল কারণ তাঁরা জেরার চাপে ভেঙে পড়েছিলেন। দোষ স্বীকার করেছিলেন। অভিযুক্তদের দিয়ে দোষ স্বীকার করানো না গেলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী গড়াপেটার অভিযোগ প্রমাণ করা খুব কঠিন।

বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া এ দিন সিএবি-র অনুষ্ঠানে মিডিয়া-আক্রমণে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, এ সব নিয়ে কথা বলার অবস্থাতেই থাকলেন না। পরে বিবৃতি পাঠিয়ে দিলেন। সিএবি-র অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে জিজ্ঞেস করা হলে দেখা গেল, তিনি মোটামুটি পালাতে পারলে বাঁচেন। ‘‘আমি অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু এটা নিয়ে নয়’’, বলতে বলতে গাড়ির দিকে দৌড় দিলেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল সদস্য তথা সিএবি যুগ্ম-সচিব সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় শুধু বললেন, ‘‘বোর্ডই ঠিক করবে এখন ওদের ভাগ্যে কী হবে। তবে ক্রিকেটার হিসেবে শ্রীসন্তের কাছে রায়টা স্বস্তির।’’ কিন্তু ক্রিকেট মহলের কারও কারও সত্যিই মনে হচ্ছে, স্বস্তিটা শুধু আদালত চত্বরেই আটকে থাকবে। বাইশ গজে নামবে না। কারণ, লোঢা কমিশনের রায়ের পর শ্রীসন্তদের মুক্তি দিলে প্রকারান্তরে নিজেদের ব্যর্থতাও তো মেনে নিতে হয়। দিল্লির যে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার নীরজ কুমার শ্রীসন্তদের বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের তদন্ত শুরু করেছিলেন, ঘটনাচক্রে তিনিই এখন বোর্ডের দুর্নীতি দমন শাখার প্রধান!

শেষ পর্যন্ত কী হতে চলেছে, আরও কয়েকটা দিন না গেলে বলা সম্ভব নয়। শান্তাকুমারন শ্রীসন্তের গোটা দিনের বিভিন্ন মুহূর্তকে বিচার করে শুধু শনিবারের ছবিটার আন্দাজ আপাতত পাওয়া যেতে পারে। পাটিয়ালা হাউস কোর্টের রায়ে যে শ্রীসন্তকে দুপুরে আবেগে কেঁদে ফেলতে দেখা গিয়েছিল, যিনি ঈশ্বরকে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে ক্রিকেট মাঠে নেমে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, রাতে সেই একই শ্রীসন্তকে দেখা গেল এক টিভি চ্যানেলে। বোর্ডের বিবৃতিতে হাসি উধাও। উৎসব নয়, টেনশনের মুখ। যিনি অনুনয় করছেন, তাঁকে অন্তত ক্লাব ক্রিকেটে ফিরতে দেওয়া হোক। বোর্ডকে তিনি নাকি সেটা বলবেন।

যেন নিজেও বুঝতে পারছেন, বিকেলে আদালতে দাঁড়িয়ে যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন, সেটা অলীক ছিল। বুঝতে পারছেন, মুক্তির ক্ষণিক হাওয়া বন্ধ হয়ে আবার তাঁর জন্য অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ অপেক্ষা করছে। তা সে তিনি যতই বলুন, ‘‘খুব গরম ছিল বলে সে দিন কোমরে তোয়ালে নিয়ে নেমেছিলাম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters Chandila Sreesanth Chavan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE