Advertisement
E-Paper

গম্ভীরের চাওয়া পিচই হারাল ভারতকে? না কি পাঁচ দিন খেলার মানসিকতাই নেই রাহুল-যশস্বীদের? ইডেন টেস্টের পর উঠছে প্রশ্ন

ভারতের কোচ হওয়ার পর গত দু’বছরে সাদা বলের ক্রিকেটে এক পা-ও ভুল ফেলেননি গম্ভীর। অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও এশিয়া কাপ জিতেছে ভারত। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেটে? ছবিটা পুরো উল্টো।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫
cricket

ইডেনে অনুশীলনের মাঝে গৌতম গম্ভীর (বাঁ দিকে) ও শুভমন গিল। ছবি: পিটিআই।

‘ছাঁটাই গৌতম গম্ভীর’ স্লোগান আবার ফিরে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেটে। ইংল্যান্ড সফরের পর সেই স্লোগান কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ইডেনে ভরাডুবির পর তা আবার বেড়েছে। সত্যিই তো, দেশের মাটিতে এক বছরে শেষ ছ’টা টেস্টের মধ্যে চারটিতে হারার পর ক’জন কোচের চাকরি বাঁচে? গম্ভীর অবশ্য নিজের জায়গায় অনড়। সমালোচনার জবাব দিতে ভয় পান না। ইডেনে পিচ-বিতর্ক উঠতেই যেমন হারের দায় পুরোপুরি চাপিয়ে দিয়েছেন দলের ব্যাটারদের উপর। সত্যিই কি গম্ভীরের ‘ঘূর্ণি’ উইকেটের আবদার ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে? না গম্ভীরের কথাই ঠিক? পিচে অত জুজু ছিল না। ব্যাটারেরা খেলতে পারেননি। ইডেন টেস্টের পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ভারতের টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েই।

ভারতের কোচ হওয়ার পর গত দু’বছরে সাদা বলের ক্রিকেটে এক পা-ও ভুল ফেলেননি গম্ভীর। যাতে হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও এশিয়া কাপ জিতেছে ভারত। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেটে? ছবিটা পুরো উল্টো। গম্ভীর জমানায় দেশের মাটিতে চারটে সিরিজ় খেলেছে ভারত। দেশের মাটিতে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে প্রথম বার সিরিজ়ে চুনকাম হতে হয়েছে। ১৫ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে টেস্টে হারতে হয়েছে। মাঝে অবশ্য দু’টি সিরিজ় জিতেছে ভারত। দুর্বল বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে।

ভারতে টেস্টে বরাবর স্পিনারদের কথা মাথায় রেখে পিচ তৈরি হয়। সে প্রসন্ন, বেদী, চন্দ্রশেখরদের জমানা হোক, বা কুম্বলে, হরভজন, অশ্বিন, জাডেজা থেকে হালের কুলদীপদের জমানা। কিন্তু গম্ভীর যে ভাবে ঘূর্ণির উপর জোর দেন, তা আগে দেখা যায়নি। ইডেনে চার জন স্পিনার খেলিয়েছিল ভারত। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার ভারতকে কুপোকাত করেছে। রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহলি জমানায় সাত বছরে দেশের মাটিতে ৩১ টেস্টের মধ্যে ২৪টা জিতেছিল ভারত। হেরেছিল মাত্র দু’টি। গত দু’বছরেই সেই নজির ছাপিয়ে গিয়েছে ভারত।

গম্ভীর অবশ্য ঘূর্ণি পিচকে দোষ দেননি। ইডেনে আড়াই দিনে হারের পর বলেছেন, “ইডেনের পিচ বিপজ্জনক ছিল না। খেলার উপযোগী ছিল। টেম্বা বাভুমা তো রান করল। খেলা যাবে না, এমন উইকেট তো ছিল না। জানি না কেন বার বার স্পিন সহায়ক পিচ বলা হচ্ছে! জোরে বোলারেরাই বেশি উইকেট পেয়েছে এই টেস্টে। ব্যাটারদের টেকনিক, মানসিক শক্তি এবং ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয় এ রকম পিচে। আমরা পারিনি। ভাল খেলতে না পারলে তো এমনই হবে। ১২৪ রান তাড়া করতে না পারার কোনও কারণ ছিল না।’’

গম্ভীরের এই মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে, চেতেশ্বর পুজারা, হরভজন সিংহ, মহম্মদ কাইফেরা। তাঁদের মতে, যে পিচে আড়াই দিনে খেলা শেষ হয়ে যায়, তাকে আর যা-ই হোক, ভাল পিচ বলা যায় না। ভারতকে আরও ভাল পিচে খেলার পরামর্শ দিয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড সফরের উদাহরণ টেনেছেন তিনি। সেখানে তো ঘূর্ণি উইকেট পায়নি ভারত। তার পরেও সিরিজ় ড্র করেছে। লর্ডসে একটু ভাল খেললেই সিরিজ় জিততেন গম্ভীরেরা। তা হলে ভারতে কেন সেই ধরনের পিচে খেলতে চাইছেন না গম্ভীরেরা?

পিচের জুজু দেখছেন না সুনীল গাওস্কর। গম্ভীরের সঙ্গে এই বিষয়ে একমত তিনি। গাওস্কর বলেছেন, “গম্ভীরের সঙ্গে আমি একমত। এই পিচে ১২৪ রান করা যায়। পিচে এমন কোনও ভয় ছিল না। সাইমন হারমার, কেশব মহারাজ, অক্ষর পটেল, রবীন্দ্র জাডেজাদের ক’টা বল ঘুরেছে?” গম্ভীরের আর একটি কথার সঙ্গেও একমত গাওস্কর। ভারতীয় ক্রিকেটারেরা ভাল খেলতে পারেননি। তবে তার জন্য পরোক্ষে গম্ভীরকেই দায়ী করেছেন তিনি।

গাওস্করের মতে, ইডেনের মতো উইকেটে খেলার মানসিকতা অন্য রকম রাখা উচিত। পাঁচ দিনের টেস্ট ভেবে খেলা উচিত। ৫০ ওভার বা ২০ ওভার ভেবে নয়। গাওস্কর বলেন, “প্রতি তিন বল পর ভারতীয় ব্যাটারেরা বড় শট খেলার চেষ্টা করছে। আসলে, খেলোয়াড়দের মানসিকতাই বদলে গিয়েছে। এখন বোলারদের কেউ সম্মান দিতে চায় না। আরে নিজের অহঙ্কার সাজঘরে রেখে খেলতে নামো। টেস্টে বোলারদের সম্মান করো। তা হলে রানও করতে পারবে।”

গম্ভীর জমানায় সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হয়েছে ভারতের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে। আগে ভারতের মিডল অর্ডারে খেলতেন পুজারা, কোহলি, রাহানে। পুজারা নতুন বল পুরনো করতেন, কোহলি সেই বল মেরে রান করতেন, আর রাহানে দ্বিতীয় নতুন বল সামলাতেন। সেই মানসিকতা এখন কোথায়? ইডেনে তিন নম্বরে নেমেছেন ওয়াশিংটন সুন্দর। যিনি ঘরোয়া ক্রিকেটেও কোনও দিন অত উপরে নামেননি। চার অলরাউন্ডার খেলিয়েছে ভারত। টেস্টে এত বেশি অলরাউন্ডার খেলানো নিয়ে বিরক্ত গাওস্কর। তিনি বলেন, “টেস্টে দরকার বিশেষজ্ঞ ক্রিকেটার। অলরাউন্ডার সাদা বলের ক্রিকেটে কাজে লাগে। টেস্টে নয়। গম্ভীরকে সেটা বুঝতে হবে। বিশেষজ্ঞ না খেলালে এই রকমই হবে। ১২৪ রান করকে লেজেগোবরে হয়ে যাবে দল।”

ভারতীয় দলে এখন ক’জন রয়েছেন যাঁরা শুধু টেস্ট খেলেন? প্রতিনিয়ত ফরম্যাট বদল করতে হয় ক্রিকেটারদের। অস্ট্রেলিয়ায় টি২০ খেলে এসে চার দিন পরেই নেমে পড়তে হয় টেস্টে। এতে ব্যাটারদের মানসিকতায় সমস্যা হয়। গোটা বছর জুড়ে এত ম্যাচ খেলতে হচ্ছে যে, সময় নিয়ে প্রস্তুতিই করতে পারছেন না ক্রিকেটারেরা। সেই জন্যই তো আইপিএলের মাঝে লাল বলে ইংল্যান্ড সফরের প্রস্তুতি সারতে হয় শুভমনকে। গম্ভীরের উচিত, অবিলম্বে কিছু ক্রিকেটার বেছে নেওয়া যাঁরা শুধু লম্বা ফরম্যাটে খেলবেন।

আগে এই সমস্যা ততটা ছিল না। পুজারা, রাহানেরা টেস্টই খেলতেন। কিন্তু এখন তা হচ্ছে। যদি সাই সুদর্শনকে তিন নম্বর ব্যাটার হিসাবে তৈরি করা হয়, তা হলে কেন ইডেনে তাঁকে খেলানো হল না। কোহলির সাত বছরের অধিনায়কত্বে ভারতের টেস্ট দলে মোট ৪১ জন খেলেছিলেন। গম্ভীরের দু’বছরের জমানায় সংখ্যাটা ২৪। কাইফ বলছেন, “দেখে মনে হচ্ছে ক্রিকেটারেরা ভয়ে ভয়ে খেলছে। ওরা দেশের জন্য নয়, নিজেদের জায়গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে।”

তবে কি ভারতে শুধু টেস্ট খেলার ব্যাটার নেই? বিস্তর রয়েছে। করুণ নায়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পাহাড় করার পর ইংল্যান্ড সিরিজ়ে জায়গা পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর জানিয়ে দেন, করুণের কাছে যতটা আশা করেছিলেন, তিনি তার মান রাখতে পারেননি। তাই বাদ পড়েন তিনি। সরফরাজ় খান এখন লাল বলের ক্রিকেটে ভারতের মাটিতে সেরাদের মধ্যে এক জন। ওজন ঝরিয়ে ফিটও হয়েছেন। তবু কোনও অজানা কারণে তাঁকে নেওয়া হয় না। গাওস্কর থেকে কাইফেরা বার বার ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা বলছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল ফর্মে থাকা ব্যাটারদের নিতে বলছেন। চলতি রঞ্জিতে ১৬৬ ও ১৭৬ রান করা রিঙ্কু সিংহের দিকেও কি নজর পড়ছে না আগরকর, গম্ভীরের? রিঙ্কু এখনও ভারতের টি২০ দলে বাড়তি ব্যাটারের জায়গা ভরাতে রয়েছেন। ফলে প্রশ্ন উঠছে, গোড়াতেই গন্ডগোল নেই তো? নীল নকশাতেই যদি ভুল থাকে তা হলে সাফল্য কী ভাবে আসবে?

কয়েক বছর আগে গম্ভীরের মতোই স্পষ্টবক্তা এক কোচ ভারতীয় ক্রিকেটে এসেছিলেন। গ্রেগ চ্যাপেল। একের পর এক পরিকল্পনা করেছেন। গালভরা কথা বলেছেন। কিন্তু কাজে করে দেখাতে পারেননি। ফলে বিদায় নিয়েছেন। গম্ভীর জমানাও সেই পথেই এগোচ্ছে। অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে। ভারতে আসতে যে বিদেশি দলেরা ভয় পেত, তারাও এখন বিশ্বাস করছে, ভারতে জেতা সম্ভব। ঘূর্ণি উইকেটে ভারতের থেকে বিদেশি স্পিনারেরা ভাল বল করছেন। ভারতের থেকে বিদেশি ব্যাটারেরা ভাল বল করছেন। বেশি দিন এই ছবি দেখা গেলে কিন্তু সাদা বলের সাফল্যও বাঁচাতে পারবে না গম্ভীরকে।

India Cricket Gautam Gambhir India vs South Africa 2025
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy