Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
pele

Brazil Cricket: পেলে, রোনাল্ডোর দেশে ব্যাটের ঠুকঠাক! ব্রাজিল মেতেছে কোহলীদের খেলায়

যে দেশে ক্রিকেটের কোনও ইতিহাসই ছিল না, তারাই এখন এই খেলায় তুমুল আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তবে গোটা দেশে এখনও জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়নি। লক্ষ্য সেটাই।

ব্রাজিলের মহিলা ক্রিকেট দল।

ব্রাজিলের মহিলা ক্রিকেট দল। ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২২ ১৫:০০
Share: Save:

পোকোস দে কালদাস। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের পাহাড়-ঘেরা ছবির মতো শহরটি বিখ্যাত কফির উৎপাদনের জন্য। সেই শহরেরই এক কারখানায় একমনে কাজ করে যাচ্ছিলেন লুইস রবার্তো ফ্রান্সিসকো। নিবিষ্ট মনে একটি পাইন কাঠের টুকরো ঘষে ঘষে যে জিনিসটি বানানোর চেষ্টা করছিলেন, তা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়ের কাছেই অপরিচিত— একটি ক্রিকেট ব্যাট।

পেলে, রোনাল্ডিনহো, নেমারদের দেশে ক্রিকেট! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। ফুটবল-পাগল দেশের একাংশ মজেছে ক্রিকেটে। তা-ও পুরুষ দলকে নিয়ে নয়, মহিলা দলকে নিয়ে আগ্রহ বেশি। এতটাই যে, মহিলা দলকে সে দেশের বোর্ড পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছে। পুরুষ দলের আগে পেশাদার চুক্তি সই করেছেন মেয়েরা। বিশ্বের কোনও ক্রিকেট খেলিয়ে দেশে এই দৃশ্য দেখা যায়নি।

বলা হয়, ব্রাজিলে সদ্যোজাতরা চোখ খুলেই আগে ফুটবলে লাথি মারে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল তাদের জীবনের অঙ্গাঙ্গি অংশ হয়ে ওঠে। এবড়ো-খেবড়ো মাঠই হোক বা অসমান রাস্তা, চামড়ার গোলা নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের ফুটবল খেলা খুব পরিচিত দৃশ্য। অনেকে এ ভাবেই ‘স্ট্রিট ফুটবল’ খেলে উঠে এসেছেন। মেয়েরাও পিছিয়ে থাকে না। ব্রাজিলে মহিলা ফুটবল দলের জনপ্রিয়তাও প্রচণ্ড।

ব্যাট তৈরি করছেন ফ্রান্সিসকো।

ব্যাট তৈরি করছেন ফ্রান্সিসকো। ছবি টুইটার

এ হেন ফুটবল-পাগল দেশ ব্রাজিলে হঠাৎ ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি শুরু হল কেন?

জানতে গেলে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হবে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রাজিলে রেলপথ তৈরি করতে এসেছিলেন ব্রিটিশরা। সে দেশের কিছু শ্রমিক প্রথম ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। ব্রিটিশ শ্রমিকদের দেখাদেখি ব্রাজিলের নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে ক্রিকেটের প্রতি প্রথম আগ্রহ লক্ষ করা যায়। সরঞ্জাম ছিল না। তাই কাঠের টুকরোকে ব্যাট এবং কয়েকটি বোতলকে উইকেট বানিয়ে খেলা শুরু করেন তারা। কখনও চামড়ার ছোট বল, কখনও কাগজ বা পাতা মুড়িয়ে বল বানিয়ে খেলা চলত। তবে ক্রিকেট দীর্ঘ দিন সীমাবদ্ধ ছিল মূলত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেই। ব্রাজিলের দরিদ্র মানুষদের কাছে ফুটবলের বিকল্প ছিল না। মানুষের মানসিকতাও দায়ী। বেশির ভাগই মনে করতেন, ক্রিকেট ধনীদের খেলা। অনেক সাজসরঞ্জাম দরকার। তাই জনপ্রিয়তা ছিল না বললেই চলে।

পরিস্থিতি বদলানোর পিছনে অবদান একজনের। তিনি ম্যাট ফেদারস্টোন। ইংল্যান্ডে ঘরোয়া স্তরে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। ব্রাজিলীয় স্ত্রী-কে নিয়ে সে দেশে চলে যান ২০০০ সালে। ক্রিকেট সম্পর্কে বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়ের কোনও ধারণা ছিল না। তিনি প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন বেসরকারি স্কুলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। শুরুতেই ধাক্কা খান। বুঝতে পারেন, ক্রিকেটকে লড়তে হবে রাগবি, হকি, ভলিবল, সেলিং এবং আরও অনেক খেলার সঙ্গে। হাল ছাড়েননি ফেদারস্টোন। আশপাশের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের ক্রিকেটের নিয়ম বোঝাতে শুরু করেন।

চলছে ব্যাটে শান দেওয়া।

চলছে ব্যাটে শান দেওয়া। ছবি টুইটার

ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, নতুন এই খেলা নিয়ে ওই ছেলেমেয়েদের পরিবারের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। ফেদারস্টোনের ব্যক্তিত্ব স্থানীয় মানুষদের মন জয় করে নেয়। স্থানীয় এলাকায় ‘ব্যাটস’ বা ‘ট্যাকো’ নামে একটি খেলা প্রচলিত ছিল, যা অনেকটা ক্রিকেটের মতোই। দেখা গেল, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে বেশি আগ্রহী। নতুন উদ্যম নিয়ে নেমে পড়লেন ফেদারস্টোন। ব্রাজিলে ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায় না। ফলে ইংল্যান্ড থেকেই ব্যাট, প্যাড আমদানি করতে লাগলেন তিনি।

তৈরি হয়ে গেল দেশের ক্রিকেট বোর্ড ‘ক্রিকেট ব্রাজিল’। সে দেশের সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া গেল এবং দিকে দিকে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল। এই মুহূর্তে ব্রাজিলে ক্রিকেট নিয়ে ৬৩টি কমিউনিটি প্রোগ্রাম চলে। প্রায় ৫০০০ ক্রিকেটার সে দেশের বোর্ডের সঙ্গে নথিভুক্ত। লক্ষ্য, এই সংখ্যাটা ৩০ হাজারে নিয়ে যাওয়া। ফেদারস্টোন ক্রিকেট ব্রাজিলের প্রধান। বলেছেন, “শুরু করার সময় বার বার ব্যর্থ হয়েছিলাম। স্ত্রী আমাকে পাগল বলত। আমি থামিনি। ক্রিকেটকে আরও বেশি এলাকায় ছড়িয়ে দিতে চাই।” ব্রাজিলে এখন মহিলা দলের অধিনায়ক রবার্তা মোরেত্তি আভেরি বলেছেন, “ক্রিকেট সম্পর্কে প্রথমে ধারণা একেবারেই স্পষ্ট ছিল না। দেখতাম সাদা জার্সি পরে একদল পুরুষ খেলছে। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।” শুধু খেলাই নয়, ক্রিকেটে তাঁদের জীবনে এনে দিয়েছে একরাশ মজা। এখন মহিলা ক্রিকেটাররা খেলার আগে সাম্বা নাচেন। ম্যাচের পর উচ্চস্বরে চা এবং শসার স্যান্ডউইচ দিয়ে পার্টি করেন।

আন্তর্জাতিক স্তরেও খ্যাতি মিলছে। গত অক্টোবরে ১৬ বছরের অলরাউন্ডার লরা কার্দোসোর পারফরম্যান্স নজর কেড়ে নেয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কানাডার বিরুদ্ধে এক রানে জেতে ব্রাজিল। শেষ ওভারে কার্দোসো হ্যাটট্রিক-সহ পাঁচ উইকেট নেন। শারীরিক ভাবে শক্তিশালী এই ক্রিকেটার ভবিষ্যতের তারকা হতে পারেন। পাশাপাশি, লাতিন আমেরিকা ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ পাঁচ বারে চার বার জয়ী ব্রাজিল। অর্থও আসছে। দশ বছর আগে বোর্ডের কাছে যেখানে তিন লক্ষ ৮৯ হাজার টাকা ছিল, এখন তাদের কাছে রয়েছে দুই কোটি ৭২ লক্ষ টাকা।

তবে করোনার সময় বিপদে পড়েছিলেন ক্রিকেটাররা। বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইংল্যান্ড থেকে ব্যাট আমদানি হচ্ছিল না। আবার ত্রাতা হয়ে দাঁড়ান ফেদারস্টোন। স্থানীয় বিদ্যুৎকর্মী ফ্রান্সিসকো অবসর নেওয়ার পর হাতের কাজ করতেন। তাঁকেই গিয়ে ফেদারস্টোন জানান, ব্যাট তৈরি করে দিতে হবে। জীবনে কোনও দিন ব্যাট তৈরি করেননি ফ্রান্সিসকো। তবু তিনি চ্যালেঞ্জ নেন। ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে নির্দিষ্ট আকারের ব্যাট তৈরি করতে সক্ষম হন। কোনও যন্ত্র নয়, স্রেফ হাতের সাহায্যে। স্থানীয় কোন কাঠে ভাল ব্যাট তৈরি হবে সেটা জানতেন না। তাই যেখানেই ভাল গাছ দেখতেন, তার কাঠ কেটে আনতেন। এখন তিনি এতটাই দক্ষ যে পাঁচ ঘণ্টায় ব্যাট বানাতে পারেন। দাম ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র দেড় হাজার টাকা। ইংল্যান্ড থেকে যে ব্যাট আসত, তার থেকে ৭০ গুণ কম। এখন তিনি মজে উইকেট তৈরি করতে।

কিছু দিন আগে পোকোস দে কালদাসের মেয়র সের্জিয়ো আজেভেদো গর্ব করে বলেছিলেন, তাঁদের এলাকাই ব্রাজিলে একমাত্র জায়গা যেখানে ফুটবলের থেকে বেশি জনপ্রিয় ক্রিকেট। তবে ফেদারস্টোনের স্বপ্ন অন্য। তিনি চান গোটা দেশে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ুক। বিশ্বমঞ্চে নামডাক হোক। শুধু নেমারদের নয়, রবার্তাদেরও বিশ্বকাপের মঞ্চে দেখতে চান তিনি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

pele Neymar Ronaldinho Brazil Brazil Cricket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE