গৌতম গম্ভীর ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিসিআই) চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার জন্য চাপ দিচ্ছে। জাতীয় দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের কথা বলছেন অজিত আগরকরও। অথচ টেলিভিশন সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ঘরোয়া ক্রিকেটকেই ‘ব্রাত্য’ করে রেখেছে বিসিসিআই!
রঞ্জিতে কোহলি-রোহিত
নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ়ে ব্যর্থতার পর কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন গম্ভীর এবং বিসিসিআই কর্তারা। ক্রিকেটারদের বার্তা দেওয়া হয়, ঘরোয়া ক্রিকেট না খেলে বাড়িতে বসে থাকলে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া যাবে না। সেই চাপের মুখে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলতে হয়েছিল বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাকেও। ১২ বছর পর দিল্লির হয়ে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন কোহলি। রোহিত মুম্বইয়ের হয়ে ঘরোয়া লাল বলের ম্যাচ খেলেছিলেন প্রায় ১০ বছর পর। গম্ভীর এবং বিসিসিআই কর্তারা ঘরোয়া ক্রিকেটকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা বোঝার জন্য গত জানুয়ারিতে কোহলি-রোহিতের রঞ্জি খেলার তথ্যই যথেষ্ট। তবু বোর্ডের কাছে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ‘ব্রাত্য’ ঘরোয়া ক্রিকেট! বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই বাস্তব।
ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে ধনী বোর্ড বিসিসিআই। ভারতীয় বোর্ডের মোট সম্পদের পরিমাণ ২.২ বিলিয়ন ডলার বা ১৮ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। অন্য দিকে, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মোট সম্পদের পরিমাণ ৭৯ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৫ কোটি টাকা। এই তথ্যে চমকের কিছু নেই। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিসিসিআইয়ের ঘরে লক্ষ্মীর বাস। অস্ট্রেলীয় বোর্ডের থেকে ১৮ হাজার ৭৫ কোটি টাকার সম্পদ বেশি রয়েছে বিসিসিআইয়ের কাছে। তবু ঘরোয়া ক্রিকেট সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ভারতের ক্রিকেট কর্তাদের আন্তরিকতার অভাব চাপা থাকছে না।
উদ্যোগী ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
শেফিল্ড শিল্ডের খেলা নিয়মিত সম্প্রচার হয় অস্ট্রেলিয়ায়। সম্প্রচার হয় ওয়ান ডে কাপের সব ম্যাচও। এমনকি ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সিরিজ়ের সব ম্যাচও সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। ঘরোয়া ক্রিকেট সম্প্রচারের জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে কায়ো স্পোর্টসের। সব খেলা দেখায় তারা। অথচ ভারতীয় বোর্ড দলীপ ট্রফির প্রথম দিকের ম্যাচগুলি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেনি। ভারত ‘এ’ এবং অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের ম্যাচগুলিও সম্প্রচারিত হয়নি। দলীপ ট্রফিতে দেশের প্রথম সারির বহু ক্রিকেটার খেলেছেন। ভারত ‘এ’ দলের হয়ে খেলেছেন শ্রেয়স আয়ার, অভিষেক শর্মা, তিলক বর্মা, রিয়ান পরাগ, আয়ুষ বাদোনি, অর্শদীপ সিংহ, হর্ষিত রানার মতো জনপ্রিয় ক্রিকেটারেরা। তবু শ্রেয়সদের খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ক্রিকেট ভারতে জনপ্রিয়তম খেলা হলেও অস্ট্রেলিয়ায় নয়। সে দেশে জনপ্রিয়তার নিরিখে এগিয়ে রয়েছে রাগবি, অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল। সাঁতার, ফুটবল, নেটবল, স্লাইকিংয়ের মতো খেলাগুলিও ক্রিকেটের থেকে কম জনপ্রিয় নয়। তাও উঠতি ক্রিকেটারদের খেলা ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তারা আন্তরিক। বিসিসিআই কর্তাদের এই আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
সমালোচিত ভারতীয় বোর্ড
ভারতীয় বোর্ডের ঘরে লক্ষ্মীর ভান্ডার। নিজেদের খরচে অনায়াসে ঘরোয়া ক্রিকেট সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে পারেন বোর্ডকর্তারা। তবু করেন না। দলীপ ট্রফির প্রথম দিকের ম্যাচগুলি টেলিভিশনে সম্প্রচার না হওয়ায় সমালোচিত হয়েছিল বোর্ড। এক ক্রিকেটপ্রমী সমাজমাধ্যমে বিসিসিআইয়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘‘দলীপ ট্রফির খেলাগুলি অবশ্যই সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। আমার এলাকায় একটা স্থানীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সেটাও এইচডি মানে বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকেরা। অথচ ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার স্কোরবোর্ড দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের! এটা শুধু সমর্থকদের প্রতি অবিচার নয়, ক্রিকেটারদের প্রতিও অবিচার।’’ আর এক ক্ষুব্ধ ক্রিকেটপ্রেমী সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘‘এখনকার দিনে পাড়ার রবার বল প্রতিযোগিতাও সরাসরি সম্প্রচার করা যায়। অথচ ঘরোয়া মরসুমের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা দলীপ ট্রফির ম্যাচগুলো সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেনি বিসিসিআই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। হতাশাজনক।’’
বিসিসিআইয়ের জবাব
দেশ জুড়ে সমালোচনার পর দলীপ ট্রফির ফাইনাল সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে বিসিসিআই। প্রথম দিকের ম্যাচগুলি সম্প্রচার না করার কারণ হিসাবে বোর্ডের যুক্তি ছিল, টেলিভিশন স্বত্বের চুক্তি। বোর্ড সচিব দেবজিৎ শইকিয়া বলেছিলেন, ‘‘দলীপ ট্রফি ফাইনালের সরাসরি সম্প্রচার হবে। সম্প্রচারকারীদের সঙ্গে বোর্ডের চুক্তি অনুযায়ী ঘরোয়া ক্রিকেট সরাসরি দেখানো হয় বছরে ১০০ দিন। আমরা সব ঘরোয়া প্রতিযোগিতার খেলা সরাসরি সম্প্রচার করতে চাই। বিসিসিআই ঘরোয়া ক্রিকেটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। দেশের সেরা ক্রিকেটারেরাই এই প্রতিযোগিতাগুলোয় খেলে।’’ তা হলে কেন দলীপ ট্রফির প্রথম দিকের ম্যাচগুলি সরাসরি সম্প্রচারিত হল না? বিসিসিআইয়ের অন্য এক কর্তাও চুক্তির কথা বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে বোর্ডের ১০০ দিনের চুক্তি রয়েছে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১০০ দিন ধরা রয়েছে। তাই প্রতিটি ম্যাচ সম্প্রচার করা যায় না। সব ঘরোয়া প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলি সম্প্রচারিত হলেই বছরে ১০০ দিন হয়ে যায়।
শুধুই লাভের অঙ্ক?
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট সম্প্রচারের চুক্তিতে এমন দিনের শর্ত নেই। টেলিভিশন স্বত্ব থেকে আয়ই অস্ট্রেলীয় কর্তাদের একমাত্র লক্ষ্যও নয়। তাঁদের উদ্দেশ্য দেশের উদীয়মান ক্রিকেটারদের খেলা ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বিসিসিআই কর্তারা সম্ভবত এ ভাবে ভাবেন না। তাঁরা বোধহয় সব কিছুই মাপেন টাকার অঙ্কে। চ্যানেলগুলি দাবিমতো টাকা না দিলে বোর্ড কি খেলা সম্প্রচারের অধিকার দিতে চায় না? ঘরোয়া ক্রিকেট সম্প্রচার করে চ্যানেলগুলি বিজ্ঞাপন থেকে যথেষ্ট আয় করতে পারে না। এই তথ্য বিসিসিআই কর্তাদের অজানা নয়। সে জন্যই বোধহয় ১০০ দিনের শর্ত। গুরুত্বপূর্ণ যে ম্যাচগুলি থেকে আয় সম্ভব, শুধু সেগুলি সম্প্রচার করেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা। সব ম্যাচ সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পাছে বোর্ডের তহবিলে হাত দিতে হয়! সম্পদ অটুট রাখতেই হয়তো তাঁরা বেশি আন্তরিক।
কেন অনীহা?
অনুশীলন-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ করতে কসুর করেন না বিসিসিআই কর্তারা। বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বেঙ্গালুরুর সেন্টার অফ এক্সেলেন্সের মতো অত্যাধুনিক ব্যবস্থা বিশ্বের খুব বেশি দেশে নেই। ক্রিকেটারদের যত্নে রাখার ক্ষেত্রেও তাঁদের উদ্যোগ যথেষ্ট। ঘরোয়া ক্রিকেটারদের আয় বৃদ্ধি নিয়েও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। ক্রিকেটের মান ধরে রাখার জন্য এ সব প্রয়োজনীয়। বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মান কমলে সাধারণ মানুষ আগ্রহ হারাবেন। টান পড়বে আয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। তাই কি ঘরে লক্ষ্মীর ভান্ডার থাকতেও ১০০ দিনের প্রকল্পে (পড়ুন চুক্তি) আটকে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট!