Advertisement
E-Paper

বাগুইআটির অজিতের সারিয়ে দেওয়া ব্যাটেই কি রানে ফিরলেন রাসেল! বিপদে পড়লে নারাইনদের ভরসা কলকাতার ‘ব্যাটের চিকিৎসক’

নিজেকে তিনি ‘ব্যাটের চিকিৎসক’ বলতেই ভালবাসেন। ব্যাট নিয়ে সমস্যায় পড়লে আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইনেরা তাঁর কাছেই ছুটে আসেন। সেই অজিত কুমার শর্মা জানালেন, ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আসারও ইচ্ছা হয়েছে তাঁর।

অভীক রায়

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৫ ০৯:৪১
cricket

আন্দ্রে রাসেল (বাঁ দিকে), সুনীল নারাইনেরা (মাঝে) যে ব্যাটে খেলেন, তা সারানোর দায়িত্ব থাকে অজিতের কাঁধে। ছবি: সংগৃহীত।

বাগুইআটির হাতিয়াড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁ দিকে মিনিট সাতেক হেঁটে গেলে একটি ছোট গলি। তার শেষ প্রান্তে নিতান্তই সাধারণ একটি দোকান। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে ছোট একটা সাইনবোর্ড। বেশ কিছু ছবির মাঝে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ডক্টর অফ ব্যাট্‌স’, অর্থাৎ ব্যাটের চিকিৎসক। ব্যাটের আবার চিকিৎসকও হয় নাকি!

নিশ্চয়ই হয়। নিজেকে এই নামেই ডাকতে ভালবাসেন দোকানের মালিক অজিত কুমার শর্মা। চেহারা, কথাবার্তা আরও সাধারণ। বললেন, “শরীর বা মনের যদি চিকিৎসক হয়, তা হলে ব্যাটের চিকিৎসক হবে না কেন? ক্রিকেট খেলতে গেলে ব্যাট নিয়ে নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়। সেগুলো সারানোর জন্য কাউকে তো দরকার।” কেকেআর কলকাতায় যে হোটেলে থাকে, সেখানে ব্যাট সারাতেই গিয়েছিলেন। তাই যে সময়ে আসার কথা ছিল, তার থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরিতে হন্তদন্ত হয়ে এলেন। ডেকেছিলেন রমনদীপ সিংহ।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ব্যাটারদের খেলা, এই অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দিনই। ব্যাটারেরা খেয়ালখুশি মতো ব্যাট নিয়ে মাঠে নামতেন। ধুমধাড়াক্কা পিটিয়ে সাজঘরে ফিরে যেতেন। তবে এ বার ভারতীয় বোর্ড ব্যাটের মাপ নিয়ে কড়া হয়েছে। যেমন খুশি ব্যাট নিয়ে মাঠে নামা যাচ্ছে না। সে কারণেই চাহিদা বেড়ে গিয়েছে অজিতের।

রহমানুল্লাহ গুরবাজ়ের সঙ্গে অজিত।

রহমানুল্লাহ গুরবাজ়ের সঙ্গে অজিত। ছবি: সমাজমাধ্যম।

কেকেআরের প্রায় প্রত্যেক ক্রিকেটারের কাছেই আক্ষরিক অর্থে তিনি ‘গো-টু ম্যান’। আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, বেঙ্কটেশ আয়ার, রিঙ্কু সিংহ, রমনদীপ সিংহ— যিনিই সমস্যায় পড়ুন, আগে ফোন আসবে অজিতের কাছে। শুধু কেকেআর নয়, হায়দরাবাদের অভিষেক শর্মা, ঈশান কিশন, বেঙ্গালুরুর ফিল সল্ট— সবার কাছেই জনপ্রিয়। এ বারও খেলতে এসে অভিষেক, সল্টরা ব্যাট সারাই করিয়ে গিয়েছেন। সেই কাজ করতে গিয়ে অজিতের মনে হয়েছে, নারাইন, রাসেল সবচেয়ে দামী ব্যাট ব্যবহার করেন। তাঁর অনুমান, ওই ব্যাটের দাম দেড় লক্ষ টাকা। রমনদীপের ব্যাটের দাম সেখানে ৭৫ হাজার টাকা।

কিন্তু কেকেআর ক্রিকেটারদের কাছে কী ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন? অজিত জানালেন, পুরোটাই ভাগ্য। ২০২৩ সালে কেকেআরের তৎকালীন ক্রিকেটার মনদীপ সিংহ নিজের কয়েকটি ব্যাট সারাই করার জন্য লোক খুঁজছিলেন। সে সময় কেকেআরের এক নেট বোলার অজিতের সন্ধান দেন। সমাজমাধ্যমের সূত্রে মনদীপের সঙ্গে কথা হয় অজিতের। মনদীপ তাঁর কাজ দেখে খুশি হন। ধীরে ধীরে কেকেআরের বাকি ক্রিকেটারদের থেকেও ব্যাট সারাই করার প্রস্তাব পেতে শুরু করেন অজিত। জানালেন, কেকেআরের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্রিকেটারই কোনও না কোনও সময় তাঁর থেকে ব্যাট সারাই করিয়েছেন।

আন্দ্রে রাসেলের সঙ্গে অজিত।

আন্দ্রে রাসেলের সঙ্গে অজিত। ছবি: সমাজমাধ্যম।

ব্যাটের সমস্যা যা-ই হোক না কেন, অজিত ঠিক করে দেবেন। দৈর্ঘ্য কমানো, ওজন কমানো, ফাটল মেরামত— তালিকা শেষ হওয়ার নয়। নিজে হাতেকলমে দেখালেনও সেটা। নাগেরবাজারে নিজের দ্বিতীয় দোকানে বসে একটি করে ব্যাট তুলে তুলে দেখিয়ে বোঝালেন, কী ভাবে কোন জায়গায় ওজন বাড়াতে বা কমাতে হয়, কোথায় বেশি ওজন চান ক্রিকেটারেরা, কোন জায়গা একটু ঘষে দিলে বুলেটের বেগে বল যাবে বাউন্ডারিতে।

ব্যাট সারাই করার জন্য কোনও প্রথাগত শিক্ষা কোনও দিন নেননি অজিত। এমনকি, ব্যাটের চিকিৎসক হবেন সেটাও কোনও দিন ভাবেননি। ক্রিকেটের প্রতি প্রেম ছিল ছোটবেলা থেকেই। গোয়াবাগানে ক্রিকেট শিখতেন। স্বপ্ন ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ারও। তবে লকডাউনের আগে সল্টলেকে এক বার অনুশীলনে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ব্যাট নেটে আটকে যায়। কাঁধে বড় চোট পান। ব্যাট বা বল কিছুই করতে পারছিলেন না। বেশ কয়েক দিন ও ভাবে বসে থাকার পর সচিন নামে এক বন্ধু পরামর্শ দেন ব্যাট সারাই করার। প্রথমে অজিত রাজি হননি। বললেন, “তখন ভেবেছিলাম, আমার মতো ছেলের কাছে কে আর ব্যাট সারাই করতে দেবে। আর কেনই বা দেবে। তবু আমার সেই বন্ধু পিছু ছাড়েনি। ওর কথায় রাজি হয়েছিলাম। এর পর একটা-দুটো করে ব্যাট সারানোর প্রস্তাব পেতে শুরু করি। তখন কাজ করতাম স্রেফ হাতখরচ জোগাড় করার জন্য। এক-দেড় বছর পর বুঝতে পারলাম, এই কাজের একটা ভবিষ্যৎ রয়েছে। আস্তে আস্তে সেটাকেই ব্যবসা করে ফেলি।” মাঝে হোমগার্ডের চুক্তিভিত্তিক চাকরিও পেয়েছিলেন অজিত। কিন্তু ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে ভেবে সেই চাকরি ছেড়ে দেন। সেটাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

বাড়ির থেকে বেশ সাহায্য পেয়েছেন। বাবা-কাকারা ৩০-৪০ বছর ধরে কাঠের কাজ করছেন। আসবাবপত্র তৈরি করেন। তাঁদের কাছ থেকে দেখার ফলে প্রাথমিক একটা ধারণা ছিলই। পাশাপাশি স্থানীয় আরও কিছু কাঠমিস্ত্রিকে দেখে কাজ শেখেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু জিনিস শিখে এবং ব্যাট নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে এক সময় কাজ শিখে যান। আশেপাশের কিছু ক্রিকেটারের ব্যাট সারাই করে দেন। অজিতের খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বললেন, “ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখে কাঠের প্রতি একটা ন্যূনতম জ্ঞান তো ছিলই। তা ছাড়া ব্যাট সারাই করতে যে সব যন্ত্রপাতি লাগে তার বেশ কিছু ছিল আমাদের বাড়িতেই। সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই এক সময় শিখে যাই।”

কারখানায় ব্যাট সারাইয়ের কাজে ব্যস্ত।

কারখানায় ব্যাট সারাইয়ের কাজে ব্যস্ত। ছবি: সংগৃহীত।

সেখান থেকে ‘ব্যাটের চিকিৎসক’ নামটির উৎপত্তি। অজিত বললেন, “আগে আমার দোকানের নাম ছিল কলকাতা ব্যাট রিপেয়ারিং সেন্টার। হাতিয়াড়ার দোকানে ওখানকার এক চিকিৎসক রোজই দেখতেন আমি একটা ব্যাট নিয়ে কারিকুরি করছি। তিনি এক দিন জিজ্ঞাসা করেন, কী করছি আমি। তাঁকে জানাই, আমি ব্যাট সারাই করছি। উনি আমাকে উৎসাহ দেন আরও কাজ করার। তার পরেই হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি মানুষের ডাক্তার, তুই ব্যাটের ডাক্তার’। কথাটা আমার মনে ধরে যায়। তখনই দোকানের নাম পাল্টে ‘ডক্টর অফ ব্যাট্‌স’ দিই। এখন ওই নামেই সবার কাছে পরিচিত।”

শুধু ব্যাট সারাই নয়, আগামী দিনে ব্যাট তৈরি করারও ইচ্ছা রয়েছে অজিতের। তবে কাজটা এতটা সহজ নয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনই ভাল মানের কাঠ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। অজিতের কথায়, “ভাল ব্যাট উইলো কাঠ থেকে তৈরি হয়। আর আমাদের এখানে কেউ উইলো কাঠ সাপ্লাই করতে রাজি নয়। আমি অনেক সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। ওদের হয়তো কিছু সমস্যা রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি সেই সমস্যা মেটাতে। কারণ এখানে ব্যাট তৈরি করলে তার দামও কম হবে। ভাল মানের ব্যাট কিনতে গেলে অনেক দাম পড়ে যায়। সেই সামর্থ্য সবার থাকে না। তবে এখনই এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই।”

কাজের সূত্রে প্রচুর মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে অজিতের নাম। শুধু কলকাতা নয়, ব্যাট সারাই করার প্রস্তাব আসে বিহার, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকেও। তিনি জানালেন, ‘পিক অ্যান্ড ড্রপ’ পরিষেবাও রয়েছে তাঁর দোকানে। অর্থাৎ বাড়ি থেকে ব্যাট নিয়ে এসে সারাই করে আবার বাড়িতেই ফেরত দিয়ে আসা হবে। সেই মক্কেল যত দূরেই থাকুন না কেন। শুধু এটাই নয়, তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির নেপথ্যে আরও একটি কারণ রয়েছে। অজিতের কথায়, “এখন একটা সাধারণ ব্যাটের দাম মোটামুটি ১০-১৫ হাজার টাকা। তার মেয়াদ দেড়-দু’বছরের বেশি নয়। তার পরেই ফেলে দিতে হয়। কিন্তু দু’-তিন হাজার টাকা খরচ করে ব্যাট সারাই করে নিলে আরও এক বছর চালানো যায়। লোকে সেটাই পছন্দ করছেন।” কথা বলতে বলতেই একটি ভিডিয়ো দেখালেন অজিত। সেটি কেকেআরের ক্রিকেটার লাভনিত সিসোদিয়ার ব্যাট। নীচ থেকে আড়াআড়ি ভাবে ফেটে গিয়েছে। ব্যাটের বিভিন্ন জায়গাও ভেঙে গিয়েছে। সারাই করার পর সেই ব্যাট একদম নতুনের মতো দেখাচ্ছে।

কেকেআরের প্রায় সব ক্রিকেটারের সঙ্গে অজিতের ভাল বন্ধুত্ব। কিন্তু অজিত চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করেন। নিজের কাজটুকু নিয়েই থাকতে চান। কোনও দিন মুখ ফুটে ইডেনে খেলা দেখার টিকিটও চাইতে পারেননি। কেউ ভালবেসে নিজে থেকে দিলে খেলা দেখেছেন। তা ছাড়া, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রতি বিশেষ আগ্রহও নেই অজিতের। তিনি টেস্ট খেলার ভক্ত। বললেন, “লাল বলের ক্রিকেটের আলাদা একটা মাধুর্য রয়েছে। ওটা কোনও ভাবেই ভোলা যাবে না।”

ব্যবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরেও সারা জীবন এই কাজই করে যাবেন, এই নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না অজিত। হাসতে হাসতে বললেন, “আসলে জানেন তো, আমার রাজনীতির প্রতি একটু টান রয়েছে। বিশ্বাস করি, আমার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। হয়তো ৪০-৪৫ বছর বয়স যখন হবে, তখন পুরোপুরি রাজনীতিতে চলে যেতে পারি। নেতা হওয়ার একটা ইচ্ছা আমার মধ্যে রয়েছে। আপাতত এই ব্যবসাটা থাকবেই। ভবিষ্যতে অন্য কোনও ব্যবসাও করতে পারি। আজ থেকে ১০ বছর পরে অন্য কোনও ব্যবসায় সফল হতে পারি। এখন থেকেই আগাম কিছু ভাবিনি।”

Sunil Narine Andre Russell KKR
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy