Advertisement
E-Paper

‘গরিবের ধোনি’র কাছে উড়ে গেল কেকেআর, হায়দরাবাদে পুনর্জন্ম পাওয়া ক্লাসেনের ইনিংসে দুঃস্বপ্নে আইপিএল শেষ কলকাতার

ক্রিকেটবিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত ‘গরিবের ধোনি’ নামে। নামটি দিয়েছিলেন অধুনা দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলের কোচ শুকরি কনরাড। সেই হাইনরিখ ক্লাসেনের ইনিংসেই লজ্জার হার কলকাতার।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ ২৩:১৬
cricket

শতরানের পর হাইনরিখ ক্লাসেন। ছবি: পিটিআই।

বছর দশেক আগে কথাটা বলেছিলেন অধুনা দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলের কোচ শুকরি কনরাড। তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচ। দক্ষিণ আফ্রিকার এমার্জিং স্কোয়াডের এক ক্রিকেটারকে দেখে বলেছিলেন, ‘ও হল গরিব মানুষের ধোনি’। সেই মন্তব্য নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। কিন্তু নামটা বিখ্যাত হয়ে যায় ক্রিকেটবিশ্বে। সেই ‘গরিবের ধোনি’ তথা হাইনরিখ ক্লাসেনের দাপটেই লজ্জা নিয়ে আইপিএল শেষ করল কেকেআর। প্রতিযোগিতার শুরুর মতো শেষটাও হল দুঃস্বপ্নে।

ক্লাসেনের ৩৯ বলে অপরাজিত ১০৫ রানের দাপটে আগে ব্যাট করে ২৭৮/৩ তোলে হায়দরাবাদ। জবাবে কেকেআরের ইনিংস শেষ ১৬৮ রানে। গত বারের চ্যাম্পিয়ন দলকে এ বার শেষ করতে হল আট নম্বরে।

আগের ম্যাচে অপরাজিত ৯৪ রান করে হায়দরাবাদকে জিতিয়েছিলেন ঈশান কিশন। এ দিন ওপেনিং জুটিতে হায়দরাবাদ ৯২ তুলে দেওয়ার পর যখন অভিষেক শর্মা আউট হলেন, তখনও ঈশানের কাছে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার মঞ্চ তৈরিই ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নামতে দেখা যায় ক্লাসেনকে। হায়দরাবাদের ক্রিকেটার এমনিতেই আইপিএলে খুব একটা ফর্মে ছিলেন না। রবিবারের আগে ১২ ইনিংসে ৩৮২ রান ছিল নামের পাশে। এই একটা ইনিংস রাতারাতি আবার নজরে এনে দিল তাঁকে। ক্লাসেন বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ফুরিয়ে যাননি। যে দল তাঁকে পুনর্জন্ম দিয়েছে আইপিএলে, তাদের আস্থার দাম দিলেন।

বছর সাতেক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলতেন। তবে আইপিএলের কোনও দলের থেকে ডাক আসছিল না। সেই ডাক আচমকাই আসে। ‘স্যান্ডপেপার-গেট’ কাণ্ডে অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ এক বছর নির্বাসিত হয়ে যাওয়ায় খেলতে পারেননি আইপিএলে। তাঁর জায়গায় রাজস্থান নেয় ক্লাসেনকে। চারটি ম্যাচে ভাল খেললেও ধরে রাখা হয়নি। পরের বছর বেঙ্গালুরু তাঁকে ৫০ লক্ষ টাকায় কেনে। কিন্তু সেই মরসুমে জল বয়েই বেড়াতে হয়েছিল তাঁকে।

দেশের হয়ে খেলতে নেমে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা মজবুত করছিলেন ক্লাসেন। ২০২৩ সাল ক্লাসেনের জীবন বদলে দেয়। সে বছরের শুরুতে এসএ টি২০-তে ডারবানের হয়ে শতরান করেন। তা নজর এড়ায়নি হায়দরাবাদের। মিনি নিলামে তারা কিনে নেয় ক্লাসেনকে। সে বার আইপিএলে হায়দরাবাদের হয়ে বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে শতরান করেন ক্লাসেন। বছরের শেষে মেজর লিগ ক্রিকেটে আরও একটি শতরান করেন।

হায়দরাবাদ ক্লাসেনকে পুনর্জন্ম দিয়েছে। আইপিএলে আগের কোনও দলের হয়ে ক্লাসেন সেই সম্মান পাননি যা তিনি হায়দরাবাদ থেকে পেয়েছেন। গত বছর মহা নিলামের আগে অনেক ক্রিকেটারকেই ছেড়ে দিয়েছিল হায়দরাবাদ। তবে ক্লাসেনকে ধরে রেখেছিল সবচেয়ে বেশি দামে, ২৩ কোটি টাকা দিয়ে। যিনি হায়দরাবাদকে গত বার ফাইনালে তুলেছিলেন, সেই প্যাট কামিন্সের থেকেও বেশি টাকা পান ক্লাসেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এমনিতেই আগ্রাসী টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়। গত বারের হায়দরাবাদে ক্লাসেনের সতীর্থ থাকা এডেন মার্করাম এ বছর লখনউয়ে গিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। চেন্নাইয়ের হয়ে মরসুমের মাঝপথে এসে ভাল খেলেছেন ডেওয়াল্ড ব্রেভিস। ডেভিড মিলারকেও দু’-একটি ম্যাচে ছন্দে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ক্লাসেন এত দিন দলের হয়ে সাধ্যমতো অবদান রাখলেও ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে পারছিলেন না। কে জানত সেই ইনিংস দেখা যাবে মরসুমের শেষে!

৩৩ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে ক্লাসেনের। কিন্তু ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতায় তিনি হেরে যেতে পারেন এক জন তরুণ ক্রিকেটারের কাছে। দেশের হয়ে মাত্র চারটি টেস্ট, ৬০টি এক দিনের ম্যাচ এবং ৫৮টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। আইপিএলেও খেলেছেন মোটে ৪৯টি ম্যাচ।

আসলে যে বয়সে লোকে ক্রিকেট শুরু করে তার থেকে অনেক পরে খেলা শুরু করেন ক্লাসেন। কলেজে পড়াকালীন আচমকাই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। কলেজের দলে সুযোগ পান। পরে বুঝতে পারেন, তাঁর আসল প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে এই খেলাতেই। দ্রুত উত্থান হতে থাকে। ২০১২-১৩ মরসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুযোগ। প্রথম তিন মরসুমেই রানের পাহাড় গড়ে ফেলেন। ২০১৭ সালে নিউ জ়িল্যান্ড সফরে জাতীয় দলে ডাক পেলেও প্রথম একাদশে সুযোগ মেলেনি।

কয়েক বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় অ্যাকাডেমির কোচ থাকার সময় কনরাড বলেছিলেন, “হাইনরিখ কঠিন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড শান্ত থাকতে পারে। মুহূর্তটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করে সব সময়। ওর মধ্যে আমি ‘গরিব মানুষের এমএস ধোনি’ হয়ে ওঠার সব গুণ দেখেছি। কোনও ধরনের চাকচিক্যের মধ্যে দিয়ে যায় না। খেলাটাকে নিজের কাছে আসার অপেক্ষা করে না। নিজে এগিয়ে গিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেয়। এটাই ওর সবচেয়ে ভাল গুণ। যতটা কঠোর ওকে মনে করি, তার থেকেও বেশি কঠোর।”

কনরাড এ কথা বলার পরে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, এই কথাগুলো বলে ক্লাসেনকে আদতে অপমান করা হয়েছে। যদিও ক্লাসেন এ বিষয়ে কোনও দিন মন্তব্য করেননি। পরের বছরই ধোনির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ক্লাসেনের। ২০১৮-র শুরুর দিকে কুইন্টন ডি’ককের বদলি হিসাবে ভারতের বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজ়ের দলে ঢোকেন ক্লাসেন।

দল হতশ্রী পারফরম্যান্স করলেও ক্লাসেন সব নজর নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন। যে দু’টি ম্যাচ প্রোটিয়ারা জিতেছিল, দু’টিতেই সেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন ক্লাসেন। সেই মুহূর্তে এক দিনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা দল ছিল ভারত। তাদের বিরুদ্ধে ক্লাসেনের ঠান্ডা মাথার পারফরম্যান্স মন জুড়িয়ে দিয়েছিল ক্রিকেট অনুরাগীদের।

এর পর ছিল টি-টোয়েন্টি সিরিজ়। সেখানেও ক্লাসেন জাত চিনিয়েছিলেন। একটি ম্যাচে ৩০ বলে ৬৯ করে ম্যাচের সেরার পুরস্কার পান। টেস্টে অভিষেকও হয় ভারতের বিরুদ্ধেই।

ক্লাসেন ছাড়া রবিবারের ম্যাচ নিয়ে বলার মতো কিছু নেই। আগে ব্যাট নেওয়া হায়দরাবাদের মন্ত্র ছিল একটাই— শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আক্রমণ। বিপক্ষের বোলারকে এক মুহূর্তে তিষ্ঠোতে না দেওয়া। গত বছর হায়দরাবাদ এই ঘরানার ক্রিকেট খেলেই সাফল্য পেয়েছিল। এই মরসুমের শুরুতে সাফল্য পেলেও পরের দিকে বেশ কয়েকটি ম্যাচে হারাতে থাকায় অতি আগ্রাসী ঘরানা ক্রিকেট বর্জন করেছিল। মরসুমের শেষ ম্যাচে আবার হায়দরাবাদের ব্যাটারেরা স্বমূর্তি ধারণ করলেন। উল্টো দিকে তা অসহায় হয়ে দেখতে হল অজিঙ্ক রাহানেকে।

এমনিতেই এই ম্যাচ থেকে কেকেআরের কিছু পাওয়ার ছিল না। তবে মরসুমের শেষটা যে এত খারাপ ভাবে হবে সেটা কল্পনাও করতে পারেননি কেউ। ২০টি ওভারের মধ্যে মাত্র তিনটি ওভার বাদে কেকেআর বোলারদের প্রতি ওভারের ১০ বা তার বেশি রান উঠেছে। চার ওভারে সবচেয়ে বেশি ৬০ রান দিয়েছেন অনরিখ নোখিয়া। তবে প্রতি ওভারে রানের নিরিখে বরুণ চক্রবর্তী সবচেয়ে খরুচে বোলার হয়েছেন। প্রতি ওভারে ১৮ রান দিয়েছেন তিনি। ক্লাসেন ছাড়াও ভাল খেলেছেন ট্রেভিস হেড (৭৬)।

কেকেআরের বোলারেরা যত মার খাচ্ছিলেন, তত জোরে বল করছিলেন। হায়দরাবাদ করল ঠিক উল্টো। ধীরগতির বল করে, বলে বৈচিত্র এনে কেকেআরকে বিভ্রান্ত করে দিল তারা। ফলে কেকেআরের কেউ হাত খুলতেই পারলেন না। কোনও ব্যাটার ক্রিজ়‌ কামড়ে পড়ে থাকার মানসিকতা দেখাতে পারলেন। বড় ব্যবধানে হেরে আইপিএল শেষ হল না কেকেআরের।

Heinrich Klaasen Sunrisers Hyderabad KKR Ajinkya Rahane
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy