প্রায় সব খেলাধুলোতেই ঘরের মাঠে খেলার একটা বাড়তি সুবিধা থাকে। বেশ কিছু যুক্তিও রয়েছে এর পিছনে: যে দলের ঘরের মাঠ তারা পরিবেশ, পরিস্থিতি বেশি ভাল বোঝে, পিচ বিপক্ষের থেকে ভাল চেনে, দর্শকদের পূর্ণ সমর্থন পায়। জয়ী এবং পরাজিত দলের মধ্যে এগুলোই পার্থক্য গড়ে দেয়।
বিভিন্ন খেলার ক্ষেত্রেই এই যুক্তি সত্যি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সেলোনা ঘরের মাঠে টানা ৩৮টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল। টানা সাত বছর। আমেরিকার বাস্কেটবলে ওকলাহোমা সিটি থান্ডার গত মরসুমে ঘরের মাঠে জিতেছিল ৩৫টি ম্যাচ। হেরেছিল মাত্র ৬টি। এই ব্যবধান লিগের বাকি দলগুলির থেকে বেশি।
তবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে, বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে ঘরের মাঠে সুবিধা পাওয়া যাবে — এই ধারণা ক্রমশ ঝাপসা হতে বসেছে।
মনে রাখতে হবে, ভারত ঘরের মাঠে টানা ১৮টি টেস্ট সিরিজ় জিতেছে। ২০১৩ সালে শুরু হয়ে যা থেমেছে গত বছর, নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে চুনকাম হয়ে। মাঝের এই সময়ে ভারত ৪২টি ম্যাচ জিতেছে, চারটি হেরেছে এবং ছ’টি ড্র করেছে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও ঘরের মাঠে ভারতের দাপট সবচেয়ে বেশি। তারা ২০১৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত টানা ১৭টি সিরিজ় জিতেছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঘরের মাঠের সুবিধা পাওয়ার নেপথ্যে যুক্তিগুলি হল: স্টেডিয়াম এবং পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত থাকা, পিচ সম্পর্কে ধারণা, হোটেলের বদলে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকার সুযোগ এবং অবশ্যই, দর্শকদের অকুণ্ঠ সমর্থন।
তবে আইপিএলের মতো টি-টোয়েন্টি লিগে ঘরের মাঠের সুবিধা পাওয়ার প্রবণতা ক্রমশ কমছে। যে হেতু স্থানীয়, ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার মিলিয়ে একটা মিশ্র দল গড়া হয়, তাই একটি নির্দিষ্ট স্টেডিয়াম ঠিক কাদের কাছে ঘরের মাঠ, তা বলা শক্ত।
অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, চেন্নাই এবং মুম্বই— এই দু’টি দল ঘরের মাঠে সবচেয়ে ভাল খেলেছে। এই মরসুমের আগে পর্যন্ত চিদম্বরম স্টেডিয়ামে ১১৩টির মধ্যে ৭২টি জিতেছে চেন্নাই। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মুম্বই ১১৫টির মধ্যে ৬৮টি ম্যাচে জিতেছে।
এ বছর ঘরের মাঠে মুম্বই নিজেদের দাপট অক্ষুণ্ণ রাখলেও, চেন্নাইয়ের কাছে ঘরের মাঠ অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তারা ছ’টি ম্যাচ খেলে পাঁচটিতেই হেরেছে।
ইডেন গার্ডেন্স। ছবি: পিটিআই।
বেঙ্গালুরুর কাছে হারের পর চেন্নাই কোচ স্টিফেন ফ্লেমিং বলেছিলেন, ‘আমরা পিচ বুঝতে পারিনি। খুব কঠিন হচ্ছে পিচ বোঝা। আমরা ভেবেছিলাম শিশির পড়লে পিচে বল পড়ে পিছলে যাবে। দেখলাম বল পড়ে থমকে যাচ্ছে। কী হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে না।’’ ফ্লেমিংয়ের বক্তব্য ছিল, পিচের চরিত্র বুঝতে না পারার প্রভাব পড়ছে ম্যাচের ফলাফলে। পরিকল্পনা তৈরি থেকে প্রথম একাদশ নির্বাচনেও সমস্যা হচ্ছে।
ঘরের মাঠের পিচ নিয়ে তিনি একা নন, বিদ্রোহী সুর শোনা গিয়েছে বিভিন্ন শিবির থেকে। শুরুটা করেছিলেন কেকেআরের অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে। এর পর লখনউয়ের জ়াহির খান, কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, চেন্নাই অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, সবাই কোনও না কোনও সময় মুখ খুলেছেন। ধারাভাষ্যকার সাইমন ডুল তো কেকেআরকে ইডেন ছেড়ে চলে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন!
বেঙ্গালুরুর কাছে হারের পর রাহানে বলেছিলেন, “অবশ্যই চাইব ঘরের মাঠের পিচ স্পিন-সহায়ক হোক। তবে কোনও অভিযোগ নেই। গত দু’দিন ধরে আচ্ছাদনের নীচে ছিল পিচ। আর্দ্রতা ছিল পিচে, যা খুব ভাল কাজে লাগিয়ে গেল (জস) হেজ়লউড। আমাদের দলের শক্তি যখন স্পিনারেরা, তখন অবশ্যই চাইব ভবিষ্যতে যেন পিচ থেকে ওরা সাহায্য পায়।”
পঞ্জাবের কাছে হারের পর জ়াহির বলেছিলেন, “পিচ আমাকে বেশ হতাশ করেছে। এটা আমাদের হোম ম্যাচ ছিল। আইপিএলে প্রতিটা দলই কোনও না কোনও ভাবে হোম ম্যাচের সুবিধা পায়। আমাদের কিউরেটর বোধ হয় ভাবেননি এটা আমাদের হোম ম্যাচ। মনে হচ্ছিল পিচটা পঞ্জাবের কেউ তৈরি করেছে। এটা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। নতুন একটা দলে যোগ দিয়েছি। আশা করি এই প্রথম এবং শেষ বার পিচ নিয়ে কথা বলতে হবে।”
আইপিএলের দলগুলিকে ঘরের মাঠে সুবিধাজনক পিচ দেওয়া উচিত কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে মুম্বই ম্যাচের আগে চন্দ্রকান্ত বলেছিলেন, “কে সেটা নিয়ে খুশি হবে না বলুন তো? এটা তো খুব সহজ উত্তর।” বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক বাড়তে পারে ভেবে চন্দ্রকান্ত এটাও বলেছিলেন, “আসলে কোচ বা টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্য হিসাবে আমাদের কাছে যে পিচ দেওয়া হয় সেটাতেই খেলি। নিয়ন্ত্রণ সব সময়েই থাকে কিউরেটরের হাতে। আমি জানি না অন্যান্য রাজ্যে বা অন্য মাঠে দলগুলোর হাতে মাঠের নিয়ন্ত্রণ থাকে কি না। এই মুহূর্তে এটুকু বলতে পারি, যে পিচ আমাদের দেওয়া হয় তাতে কিছু যেন আমাদের জন্য থাকে। কোচ, অধিনায়ক, দল পরিচালন সমিতি সেটাই আশা করে।”
ইডেনে কেকেআরেরও রেকর্ড ভাল নয়। ৩ মে পর্যন্ত পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে হেরেছে তারা। একটি জিতেছে, একটি ভেস্তে গিয়েছে। তারা এখনও প্লে-অফের দৌড়ে রয়েছে। ফলে ঘরের মাঠের বাকি দু’টি ম্যাচ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। আগে কেকেআরের দাবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন ইডেনের পিচ নির্মাতা সুজন মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার ডট কম-কে সুজন বলেছিলেন, “পিচ নিয়ে কেন বিতর্ক হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কেকেআর তো আমাকে কিছু বলেনি। কেমন পিচ হবে তা নিয়েও কথা হয়নি। রাহানে আমার ছেলের মতো। ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিল পিচ থেকে স্পিনারেরা আরও সাহায্য পেলে ভাল হয়। তবে সেটা নিছকই মজা করে।”
নিয়ম অনুযায়ী, ঘরের মাঠের পিচ কেমন হবে সে সম্পর্কে দলগুলির কোনও দাবি থাকাই উচিত নয়। প্রতিটি দলই বোর্ডের থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাঠ ভাড়া নেয়। বোর্ডের এক সূত্র বলেছেন, “বোর্ডের পিচ নির্মাতা কোনও ভাবেই আইপিএলের কোনও দলের প্রতি দায়বদ্ধ নন। বোর্ডের থেকে কোনও নির্দেশিকাও নেই। দলগুলো পিচ নির্মাতাদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ভালবাসে। তার থেকে নিজের দলের পারফরম্যান্সের দিকে নজর দিলে ভাল করত।”
আরও পড়ুন:
তিনি আরও বলেছেন, “আইপিএলের দলগুলো একটা মাঠে দু’মাস খেলে। ওরা ভুলে যায় যে বাকি বছর সেখানে বোর্ডের নানা প্রতিযোগিতা হয়। বোর্ডের খেলা না থাকলে রাজ্য সংস্থার খেলা থাকে। বোর্ডের মুখ্য পিচ নির্মাতা দলজিৎ সিংহ এক দশক আগে যে নিয়ম তৈরি করে গিয়েছিলেন সেটাই এখনও মানা হচ্ছে।”
এ বারের আইপিএলে ঘরের মাঠে মুম্বইয়ের নজির সবচেয়ে ভাল। তার পরে রয়েছে গুজরাত। চারটির মধ্যে তিনটি জিতেছে। দিল্লি ছ’টি ম্যাচের মধ্যে তিনটি করে জিতেছে এবং হেরেছে। বাকি সব দলের ক্ষেত্রেই জয়ের থেকে হারের সংখ্যা বেশি।
গুজরাতের রেকর্ড ভাল হলেও দলের মুখ্য কর্তা অরবিন্দর সিংহ জানিয়েছেন, নিয়ম সবার জন্যই এক। তাই ঘরের মাঠের বাড়তি সুবিধা নিয়ে তাঁরা ভাবতে রাজি নন। বলেছেন, “কোনও দলের এটা বলার অধিকার নেই যে, ‘আমি এ রকম পিচ চাই’। নিয়মে নেই সেটা। ঘরের মাঠে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা যায়, সবচেয়ে বেশি অনুশীলন করা যায়— এই পর্যন্ত ঠিক আছে। এ ছাড়া ঘরের মাঠের সুবিধা বলে কিছু হয় না।”
এখনও আইপিএলের প্লে-অফ শুরু হতে কয়েকটি ম্যাচ বাকি। তার আগে একমাত্র গত বারই ঘরের মাঠে সুবিধা বেশি পাওয়া গিয়েছিল। ৪২টি ম্যাচে ঘরের মাঠের দল জিতেছিল। তার আগে ২০২৩-এ, ঘরের মাঠে এবং বিপক্ষের মাঠে জেতার রেকর্ড ছিল ২৯-৪৪। ২০২২-এ এই পরিসংখ্যান ছিল ৩৪-৪০।