Advertisement
E-Paper

কেকেআর থেকে বিতাড়িত, পঞ্জাবের হৃদয়জয়, অধিনায়ক থেকে ‘সরপঞ্চ’ শ্রেয়স ভুলতে পারবেন না গত দুটো বছর

ট্রফি জেতার পরেও গত বছর কেকেআর তাঁকে দল থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। পঞ্জাব কিংসকে ফাইনালে তুলে সেই ‘অপমানের’ জবাব দিয়েছেন। অখ্যাত ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়ে তোলা পঞ্জাবের সাফল্যের নেপথ্যে ‘সরপঞ্চ’ শ্রেয়স আয়ার।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫ ১০:২৫
cricket

আইপিএলে দৃষ্টি নিবদ্ধ শ্রেয়সের। সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে। ছবি: পিটিআই।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাঁকে নিয়ে একটি পডকাস্ট সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। হাসির সেই ভিডিয়োয় দাবি করা হয়েছে, যদি পঞ্জাব কিংসকে আইপিএল দিতে পারেন তা হলে তাঁকে জমি, বাড়ি, গোটা কলোনি, তাঁর নামে রাস্তা তো বটেই, কানাডার এক মহিলার সঙ্গে বিয়েও দিয়ে দেওয়া হবে! তিনি, অর্থাৎ শ্রেয়স আয়ার।

‘দ্য বাউন্ডারি বয়েজ়’ নামে ওই পডকাস্টটি চালান দুই বন্ধু ইন্দর এবং দিলরুপ। আদ্যোপান্ত পঞ্জাবি ভাষায় হওয়া সেই পডকাস্টের জনপ্রিয়তা নেহাত কম নয়। সেখানেই সঞ্চালক ইন্দর একটি ভিডিয়োয় বলেছেন, “যদি ও (শ্রেয়স) পঞ্জাবকে আইপিএল জেতায়, তা হলে সারা জীবন ওকে মালিক বলে মেনে নেব। আমরা ওর নামে কলোনি বানাব, রাস্তা বানাব। সেই রাস্তার ধারে ওকে ১০০ একর জমি উপহার দেব। রাজপ্রাসাদ তৈরি করার জন্য ১০ একর জমি দেব। তার চেয়েও বড় কথা, কানাডার মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব।” এখানেই শেষ নয়, শ্রেয়সকে বিধায়ক বানিয়ে দেওয়ার আর্জিও শোনা গিয়েছে।

দলের অধিনায়ককে নিয়ে এটাই এখন গোটা পঞ্জাবের মেজাজ।

একটু ভুল হল, অধিনায়ক নন, ‘সরপঞ্চ’। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানকে ‘সরপঞ্চ’ বলা হয়ে থাকে। আইপিএলে শ্রেয়সের এই নাম জনপ্রিয় হয়েছে প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার আকাশ চোপড়ার সৌজন্যে। পঞ্জাবের খেলা থাকলে এবং তিনি ধারাভাষ্যে থাকলে, আকাশ অন্তত বার চল্লিশেক ‘সরপঞ্চ’ শব্দটি উচ্চারণ করবেন। ‘সরপঞ্চ সহাব তুসি গ্রেট হো’, ‘ক্যয়া লাজবাব শট মারি সরপঞ্চ সহাব নে’, এ ধরনের বাক্য আকছার শোনা যায়। রবিবার ফাইনালে ওঠার পর পঞ্জাবের সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে লেখাও হয়, ‘আজ সরপঞ্চ ম্যাচ জিতাকে আয়া হ্যায়’।

রবিবার মাঝরাত পেরিয়ে ম্যাচ তখন সবে শেষ হয়েছে। ১৯তম ওভারে অশ্বনী কুমারকে চারটি ছয় মেরে শ্রেয়স শুধু খেলাই শেষ করেননি, পঞ্জাবকে প্রথম আইপিএল জেতার আরও কাছে নিয়ে গিয়েছেন।

এমন দিনেও তিনি আশ্চর্য রকমের নিরুত্তাপ। ম্যাচ জেতানো ছয় মারার পরেও ইস্পাতকঠিন মুখ। প্রথমে সতীর্থ মার্কাস স্টোইনিসকে জড়িয়ে ধরলেন, হেলমেট খুলে তাতে গ্লাভস রাখলেন, মুম্বই ক্রিকেটারদের সঙ্গে একে একে হাত মেলালেন। এক বারই তাঁকে আবেগপ্রবণ দেখাল। পঞ্জাবের কোচ রিকি পন্টিংকে জড়িয়ে ধরার সময়। আইপিএলে সফলতম কোচ-অধিনায়ক জুটির তালিকায় তাঁরা হয়তো সবচেয়ে উপরেই থাকবেন।

শুধু মাঠের ভিতরেই নয়, কথা বলার সময়ও একই রকম নিরুত্তাপ থাকেন শ্রেয়স। বেঙ্গালুরুর কাছে প্রথম কোয়ালিফায়ারে হারের পরেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘আমরা লড়াইটা হেরেছি, যুদ্ধটা এখনও চলছে।” মুম্বইকে হারানোর পর তিনি বলেন, “আমি বড় মঞ্চে খেলতে ভালবাসি। সব সময় নিজেকে এবং সতীর্থদের বলি, যত বড় মঞ্চই হোক না কেন, যদি তুমি শান্ত থাকতে পারো তা হলে ফলাফল এমনিই পাবে।”

দুটো সাক্ষাৎকার শুনলে বোঝা যাবে, শ্রেয়সের মাথা কতটা ঠান্ডা। তিনি এখনই উৎসবে ভেসে যেতে রাজি নন। বরং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছেন, অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে।

রাতারাতি এই মানসিকতা আসেনি। গত দু’টি বছরে অনেক কিছু সইতে হয়েছে তাঁকে। দু’বছর আগে, এই অহমদাবাদেই অদ্যাবধি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ফাইনালে। গোটা প্রতিযোগিতায় ভাল খেলার পর ফাইনালের ব্যর্থতা এবং ট্রফি হাতছাড়া হওয়া তাঁর হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। ম্যাচের পর চোখের জল বাধ মানেনি। এর পর বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েন (এখন অবশ্য ফিরেছেন), কেকেআরকে ট্রফি জিতিয়েও বিতাড়িত হন।

এই যদি হয় তাঁর ব্যর্থতার ইতিহাস, তা হলে পঞ্জাবকে ফাইনালে তোলা, নির্বাচকদের দরজায় অনবরত খটখটানি, ঘরোয়া ক্রিকেটে জোড়া ট্রফি— এগুলো তাঁর সাফল্যে ফেরার কাহিনি। ৩০ বছরের শ্রেয়স যে দিন ক্রিকেট থেকে পুরোপুরি অবসর নেবেন, এই দু’টি বছর তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকে যাবে। শেষ দু’টি বছর তাঁকে কঠিন, তীক্ষ্ণ এবং দৃঢ় করে তুলেছে। এই শ্রেয়স এখন মুখে নয়, ব্যাটে জবাব দেন।

আইপিএলের প্রথম অধিনায়ক হিসাবে তিনটি দলকে ফাইনালে তোলার কীর্তি গড়েছেন। তবে এ বারের ফাইনালটা শ্রেয়সের কাছে নিঃসন্দেহে বিশেষ অনুভূতির। গত বছর কেকেআরকে আইপিএল জেতানোর পরেই শাহরুখ খানের দল থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। আস্থা রেখেছিলেন পন্টিং, যাঁর সঙ্গে শ্রেয়সের জুটি ২০২০ সালে ফাইনালে তুলেছিল দিল্লি ক্যাপিটালসকে।

দু’জনে মিলে এমন একটা দল তৈরি করেন, যেখানে চালিকাশক্তি কোনও তারকা ক্রিকেটারেরা নয়, বরং দলের অখ্যাত ক্রিকেটারেরা। পঞ্জাবের মূল দল গড়ে তোলা হয়েছে ছ’জন তরুণ ক্রিকেটারকে নিয়ে, যাঁদের কারও দেশের হয়ে অভিষেক হয়নি। এঁরা হলেন প্রিয়াংশ আর্য, প্রভসিমরন সিংহ, নেহাল ওয়াধেরা, শশাঙ্ক সিংহ, বিজয়কুমার বিশাখ এবং হরপ্রীত ব্রার। মার্কাস স্টোইনিস আর মার্কো জানসেন বাদে নামকরা বিদেশিই বা কোথায় ছিল।

নিন্দকেরা সমালোচনা করেছেন বটে। কিন্তু মাঠে নেমে ফুল ফুটিয়েছেন এই তরুণেরাই। প্রিয়াংশ এবং প্রভসিমরন এই আইপিএলের অন্যতম সেরা বিধ্বংসী ওপেনিং জুটি। ধারাবাহিক ভাবে তাঁরা শুরুটা ভাল করেছেন। মিডল অর্ডারে দায়িত্ববোধ দেখিয়েছেন ওয়াধেরা। মুম্বই ম্যাচে শ্রেয়সের সঙ্গে তাঁর ৮৪ রানের জুটি ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছে। ফিনিশার হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন শশাঙ্ক। কঠিন ম্যাচে তাঁর ব্যাটেই শেষ হাসি হেসেছে পঞ্জাব।

বোলিংয়ে বিশ্বস্ত অস্ত্র হয়ে উঠেছেন বিশাখ। বিশেষ করে কঠিন পরিস্থিতিতে। রবিবার আর্দ্র পিচেও যে ভাবে একের পর এক ‘নাক্‌ল বল’ করেছেন তা প্রশংসনীয়। জনি বেয়ারস্টো পর্যন্ত সেই বল বুঝতে না পেরে বোকা বনেছেন। সব ম্যাচে সুযোগ না পেলেও জাত চিনিয়েছেন হরপ্রীত।

তরুণ ক্রিকেটারদের উপরে এই আস্থাই গোটা মরসুমে পঞ্জাবকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। শ্রেয়স যেমন নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনই তরুণদের পিঠ চাপড়ে লড়াইয়ের ময়দানে এগিয়ে দিয়েছেন। কাঁধে অধিনায়কের এমন ভরসার হাত থাকলে যে কেউ মাঠে জান লড়িয়ে দেবেন। ঠিক সেটাই করেছেন প্রিয়াংশ, প্রভসিমরনেরা।

অধিনায়ক শ্রেয়সকে ঠিক কী চোখে দেখেন তরুণ ক্রিকেটারেরা? ফাঁস করেছেন শশাঙ্ক। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ও এমন একজন অধিনায়ক, যে সব ক্রিকেটারকে স্বাধীনতা দেয়। সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করে। সবাই মানে সবাই। আমাদের দলে ১০০-১২০ জন কর্মী রয়েছে। সকলের সঙ্গে সমান সম্পর্ক রাখে শ্রেয়স। সবার সঙ্গে সময় কাটায়। সব সময় ইতিবাচক থাকতে ভালবাসে। আপনি যদি বলেন, ‘আমি সবার আগে গিয়ে সব বোলারদের মাঠের বাইরে ফেলতে চাই’, ও বলবে, ‘সেটাই করো। শুধু এই ম্যাচ নয়, পরের ম্যাচে, তার পরের ম্যাচেও সেটাই কোরো’। এই বাড়তি স্বাধীনতা ক’জন পায়?”

শশাঙ্ক আরও বলেছেন, “অধিনায়ক হিসাবে নিজের ভাবনাচিন্তাকে কাজে লাগায় ও। এটাই ওর আসল গুণ। আমি অনেক অধিনায়ককে দেখেছি যারা সব কিছুতেই ‘না’ বলে। কিন্তু শ্রেয়স আমাদের বলে দিয়েছে, ‘তোমাদের যা বলার আছে আমাকে বলো। আমি শুনব। ভাল লাগলে সেটাই করব’। এগুলো একজন তরুণ ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। বাইরে থেকে লোকে ভাবে ও অহংকারী। কিন্তু শ্রেয়স আসলে খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ।”

শ্রেয়সের হাতে ৩ জুন ট্রফি উঠবে কি না তা সময় বলবে। তবে এই আইপিএলের শ্রেষ্ঠ শটটা তিনিই খেলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। জসপ্রীত বুমরাহের শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলটা ছিল মিডল স্টাম্পে ইয়র্কার। অন্য কোনও ব্যাটার হলে ফস্কাতেন এবং মিডল স্টাম্প উড়ে যেত। শ্রেয়স স্রেফ বলের সামনে ব্যাটটা পেতে দিলেন। বল থার্ডম্যান দিয়ে বাউন্ডারিতে। বুমরাহ তো বটেই, গোটা স্টেডিয়াম তখন চমকিত, বিস্ফারিত। তবে এই প্রথম নয়, অতীতে দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলার সময় বুমরাহকে ঠিক এ ভাবেই একটি চার মেরেছিলেন শ্রেয়স, যা রবিবারের পর ভাইরাল হয়েছে।

ধারাভাষ্য দিতে বসে বিস্মিত এবি ডিভিলিয়ার্স এক নিঃশ্বাসে বললেন, “আমার মতে আইপিএলের সেরা শট। নিখুঁত ইয়র্কার ছিল। বাঁচার কোনও উপায়ই ছিল না। আমি থাকলে তো স্টাম্প ভেঙে যেত। শ্রেয়স কী অবলীলায় চার মেরে দিল।”

আইপিএলের ১৮টা মরসুমে ১৭ বার অধিনায়ক বদলেছে পঞ্জাব। সব দলের চেয়ে বেশি। তবু সাফল্য আসেনি। এত বছর পর অবশেষে তারা খুঁজে পেয়েছে একজন ‘সরপঞ্চ’কে। এমন একজন, যাঁকে সবাই ভালবাসেন। মঙ্গলবার ট্রফি জিততে পারলে নিশ্চিত ভাবেই পঞ্জাবের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবেন শ্রেয়স আয়ার, ওরফে ‘সরপঞ্চ সহাব’।

Shreyas Iyer Punjab Kings Ricky Ponting
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy