E-Paper

টি-টোয়েন্টি যুগে টেস্ট ক্রিকেটের এক নীরব সাধক

চেতেশ্বর পুজারা, বিদায়ের দিনে দেশের কোনও ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে আপনার কোনও টেস্ট ইনিংসের ভিডিয়ো চালানো হল কি? কোনও খুদে শিক্ষার্থী আপনার মতো ডেড-ব্যাট ডিফেন্স করার আগ্রহ দেখাল?

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২৫ ১০:০৩
অদম্য: আগুনে বোলিংয়ের সামনে প্রাচীর হয়ে উঠতেন পুজারা।

অদম্য: আগুনে বোলিংয়ের সামনে প্রাচীর হয়ে উঠতেন পুজারা। — ফাইল চিত্র।

চেতেশ্বর পুজারা, আপনার ঘ্যানঘ্যানে ইনিংসটা তা হলে শেষ হল।

শেষ বার আপনাকে টেস্ট খেলতে দেখা গিয়েছিল ২০২৩-এর জুনে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সেই অভিশপ্ত ফাইনাল। ট্র্যাভিস হেড ১৭৪ বলে ১৬৩ করে কচুকাটা করে দিয়ে গেলেন। আর আপনি? যথারীতি সেই ঘুম পাড়ানি ব্যাটিং। ২৫ বলে ১৪ আর ৪৭ বলে ২৭।

আপনার কোনও ভক্ত খুব আবেগ নিয়ে বুকের মধ্যে স্কোরগুলো সাজিয়ে রেখেছিল? এটাই আমার প্রিয় তারকাকে শেষ দর্শন। মনে হয় না। বরং, কর্কশ শুনতে লাগলেও বলে দেওয়া যাক, এই টি-টোয়েন্টি যুগে আপনার ঠুকঠুক ব্যাটিং কেউ মনে রাখেনি। আপনি যে ব্যাটিংটা করতেন, ওটা ‘স্লো-মোশন’। এখন যেটা চলছে, ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’। আপনি অনেক আগেই জনমানস থেকে বিস্মৃত, বিসর্জিত। শুধু আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায়ের ঘোষণাটুকু বাকি ছিল। সেটা রবিবার হয়ে গেল।

চেতেশ্বর পুজারা, বিদায়ের দিনে দেশের কোনও ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে আপনার কোনও টেস্ট ইনিংসের ভিডিয়ো চালানো হল কি? কোনও খুদে শিক্ষার্থী আপনার মতো ডেড-ব্যাট ডিফেন্স করার আগ্রহ দেখাল? এখন তো টেস্ট ক্রিকেটেও স্কুপ, রিভার্স স্কুপের মতো শট এসে গিয়েছে। আপনার ব্যাটিংয়ের ভিডিয়ো ক্লিপ কে চালিয়ে দেখাবে বলুন তো? যদি শোনা যায় রবিবার কোনও কোচ তাঁর ছাত্রদের জড়ো করে বলেছেন ‘‘টেস্ট ক্রিকেটের এক পূজারি আজ সন্ন্যাস নিলেন, এসো আমরা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি,’’ বিস্মিত হতে হবে। কোথাও কোনও পরিবার সন্ধ্যা-আরতি দিতে দিতে প্রার্থনা করবে, আমার ছেলেটা ক্রিকেট খেলছে, ও যেন চেতেশ্বর পুজারার মতো হয়? মনে হয় না। ভুল লিখলাম। মনে হয় কী! পরিষ্কার লিখে দেওয়া যায়, এমন ঘটেনি, ঘটার সম্ভাবনাও নেই।

চেতেশ্বর পুজারা, কেনই বা লোকে আপনাকে মনে রাখবে? নাচতে জানেন না, রিল্‌স বানাতে পারেন না, কানে দুল নেই, শরীরে ট্যাটু নেই, লম্বাচওড়া উদ্ধৃতি নেই, অস্ট্রেলিয়ায় এক সিরিজ়ে তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি করেও কলার তোলেন না। কখনও কোনও বিজ্ঞাপনের মুখ হিসেবে কেউ আপনার কথা ভেবেছে? তা হলে আর কীসের উদাহরণ? কীসের তারকা? আপনার ক্রিকেট মানে লড়াকুর ক্রিকেট। আপনার জীবন মানে সংগ্রাম করে আকাশে উড়েও মাটিতে পা রেখে চলা মানুষের জীবন। এ ভাবে বাজার ধরা যায়? শৃঙ্খলা, লড়াই, পরিশ্রম, অনুশাসন, দায়বদ্ধতা, অধ্যবসায়ের অদৃশ্য ট্যাটু দিয়ে যে আপনার শরীর-মনকে সাজিয়েছেন, তার কথা ভাবতে কারও বয়েই গিয়েছে।

বিদায়বেলায় প্রশংসা বর্ষণ হচ্ছে, ভাল কথা। সচিন তেন্ডুলকর এক্স-এ লিখেছেন। আপনার সতীর্থরা লিখেছেন। প্রাক্তন কোচ রবি শাস্ত্রী লিখেছেন আপনার সংকল্পের কথা। শাস্ত্রী-বিরাট জমানায় পাঁচ বছর টেস্ট দুনিয়ায় ভারতীয় দলের বিশ্বসেরা থাকা যে পুজারা-দুর্গ ছাড়া সম্ভব ছিল না, স্বীকার করেছেন শাস্ত্রী। ২০১৮-১৯ ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ডনের দেশে ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ় জয়। আপনার তিনটি সেঞ্চুরি ছাড়া কী ভাবে সম্ভব হত? অ্যাডিলেডে ১২৩। মেলবোর্নে ১০৬। সিডনিতে ১৯৩। আর কোন বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে? প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, জশ হেজ়লউড, নেথান লায়ন। বর্গি আক্রমণের মুখে পড়া বোধ হয় এর চেয়ে সহজ ছিল। এখনও গুগ্‌ল সার্চ করলে পাওয়া যাবে, সেই টেস্ট সিরিজ়ে মোট ১২৫৮ বল আপনি একাই খেলেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় একটা সিরিজ়ে এতগুলো বল আর কখনও কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যান খেলেননি। রাহুল দ্রাবিড়ের ১২০৩ বল খেলার রেকর্ড টপকে যান আপনি। দ্রাবিড় সভ্যতার পতাকাবাহক বলা হত আপনাকে। ঠিকই বলা হত। পুরো টেস্ট কেরিয়ারে ১০৩ ম্যাচের ১৭৬ ইনিংসে খেলেছেন ১৬,২১৭ বল। দাঁড়ান, এর সঙ্গে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা আরও ৪১,৭১৫ বল যোগ করতে হবে যে! একটা তথ্য দেখছিলাম যে, ২০১০ সাল থেকে ধরলে টেস্ট ক্রিকেটে সব চেয়ে বেশি বল খেলেছেন আপনি। তাতে কী এসে-যায় বলুন তো? অন্যদের কাজ সহজ করে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁরা তারকা হয়েছেন, আপনি হননি। সারাদিনে বলিউড থেকে কেউ কি সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিল? ট্রেন্ডিংও তো সে ভাবে হলেন না। তা হলে আর কীসের তারকা?

শশী তারুর দেখলাম লম্বা একটা লেখা লিখেছেন এক্স-এ যে, তিনি বেশ দুঃখী চেতেশ্বর পুজারা নামের এক টেস্ট সন্তান বিদায় নিলেন। তারুর মনে করছেন, যে ভাবে বাইশ গজে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনি লড়াই করেছেন তাতে একটা সম্মানজনক ফেয়ারওয়েল অন্তত প্রাপ্য ছিল। তারুর টেস্ট ক্রিকেটের ভক্ত, তাঁকে বাদ দিলে অন্য জগতের কারও খুব একটা হেলদোল নেই। আসমুদ্রহিমাচল নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনও ঘোষণা এটা আদৌ নয়। আর কী করেই বা হবে? আইপিএলের আলো ঝলমলে, রঙিন মঞ্চে কখনও তো কল্কেই পেলেন না। নিলামে হয় ওঠেননি, নয়তো কেউ কেনেনি। নিলাম-পরিচালক ‘আনসোল্ড’ হেঁকে কোল্ড স্টোরেজে পাঠিয়ে দেয়। ১০৩ টেস্টে ছক্কা ক’টা? মাত্র ১৬টা। ভি ভি এস লক্ষ্মণ মেরেছেন আরও অনেক কম, ১৩৪ টেস্টে পাঁচটা। কিন্তু লক্ষ্মণ ছিলেন ব্যাটিং শিল্পী, আপনি তা নন। গোটা দেশ আন্দোলিত হবে কোন দুঃখে?

২০২১-এর ব্রিসবেন টেস্টের কথাই ধরুন না। আপনার কথা কেউ বলে? গ্যাবা রূপকথা বলতে ক্রিকেট ভক্তদের কাছে শুভমন গিলের ৯১। ঋষভ পন্থের ৮৯ অপরাজিত। মহম্মদ সিরাজের পাঁচ উইকেট। এমনকি ওয়াশিংটন সুন্দরের ৬২ ও ২২ নিয়ে কথা হয়। আপনার ২১১ বলে ৫৬ রানের বীরগাথা সম্পূর্ণ অনুচ্চারিত। কেউ মনে রেখেছে ওই ৫৬ রানের ইনিংসে একাধিকবার কী ভাবে অস্ট্রেলীয় পেসারদের বোমাবর্ষণে শরীরে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলেন? কয়েকটা মিসাইল হানার বর্ণনা তুলে ধরছি। কামিন্সের বাউন্সার হেলমেটের পিছন দিকে ঠিক ঘাড়ের কাছে লাগল। এর পরের ওভারে কামিন্স আবার মারলেন ঠিক গলার নীচে, মানে সব চেয়ে নরম জায়গায়। একটু পরে হেজ়লউড মারলেন হেলমেটে। ‘নেক-গার্ড’ খুলে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে কামিন্সের গোলা আছড়ে পড়ল বুকের খাঁচায়। প্রত্যেকটা বল যেন ফিল হিউজ়ের ভয়ঙ্কর স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিল। হাতে, বাহুতে, আঙুলে আরও অজস্র আঘাতের কথা না হয় বাদই দিলাম।

আপনার স্ত্রী পূজা একটা খুব সুন্দর বই লিখেছেন। ‘দ্য ডায়েরি অব আ ক্রিকেটার্স ওয়াইফ’। কতটা লড়াই, পরিশ্রম, আত্মত্যাগ রয়েছে আপনার ক্রিকেট জীবনের যাত্রাপথে, তার সন্ধান পাওয়া যায় এই বই থেকে। সেখানেও স্ত্রী লিখেছেন, ব্রিসবেন টেস্টে এত বার আপনি আঘাত পাচ্ছিলেন যে, সকলে খুব শঙ্কিত হয়ে পড়েন। একাধিক ‘মেসেজ’ পাঠিয়ে রাখেন মোবাইলে যে, ফোন খুলেই আমাকে কল করবে। আপনি সন্ধেবেলায় শুধু লিখে পাঠালেন যে, ‘‘আমি একদম ঠিক আছি। কিছু ভেবো না। টিম সেলিব্রেশনে যাচ্ছি।’’ দ্রুত ফোন করলেন স্ত্রী। তখনও খুবই উদ্বিগ্ন। জানতে চাইলেন, ‘‘সেলিব্রেশনে যাচ্ছ কী? ডাক্তার কী বলল? মাথায়, গলায় এ ভাবে বারবার লাগল। কী বলছ কী তুমি?’’ চেতেশ্বর, আপনি কী জবাব দিলেন? না, ‘‘ব্যথা আছে। কিন্তু মিষ্টি ব্যথা। সব ব্যথা ভুলে যাচ্ছি জয়ের আনন্দে।’’ রাহুল দ্রাবিড় এ রকম বলতেন। ভারতীয় ক্রিকেটে দেওয়াল মানেই কি তা তৈরি হয় দলগত মন্ত্রের ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে? সেখানে ব্যক্তিগত চুন-সুরকির অস্তিত্ব থাকতে নেই!

আপনার বাবা অরবিন্দ পুজারার মুখে শুনেছি, ছেলের ধীরস্থির-শান্ত মন গড়ে তোলার নেপথ্যে মা রিনা পুজারা। ছোটবেলায় সারাক্ষণ ভিডিয়ো গেমস নিয়ে পড়ে থাকতেন। মা শর্ত দেন, গেমস খেলতে হলে রোজ আধ ঘণ্টা পুজো করতে হবে। আপনি পুজারা, মা শেখালেন পুজো, স্ত্রীর নাম পূজা। হরভজন সিংহ এক বার বলেছিলেন, ‘‘পুজারা মানুষটাই এমন যে, দেখলে পুজো-পূজারির কথাই মনে পড়বে।’’ কে জানত, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায়ের আগে ছেলের মধ্যে বাইশ গজে আরাধনার দীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেনরিনা পুজারা!

মা চলে যাওয়ার পরে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে বাবা অরবিন্দ পুজারাকে। যিনি নিজে সৌরাষ্ট্রের হয়ে রঞ্জি খেলেছেন। সকালে উঠে প্রাতরাশ তৈরি করে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, ফিরে আসার পরে পাশের কোচিং ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বল ছুড়ে ছুড়ে ব্যাটিং অনুশীলন। বন্ধু কারসন ঘাউড়ির সাহায্য নিয়ে চেতেশ্বরকে মুম্বইয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল, মুম্বই ঘরানার জেদি ক্রিকেটার বানাবেন ছেলেকে। অথচ, পকেটে পয়সা নেই। মুম্বইয়ে ঘুপচি ঘরে মেঝেতে শুয়েও কত রাত কাটাতে হয়েছে বাবা-ছেলেকে। টেস্টে ভারতের সর্বাধিক রান সংগ্রহকারীদের তালিকায় আট নম্বর, ৭১৯৫ রান, ৪৩.৬০ গড়, ১৯ শতরান আর দেশ-বিদেশে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে, আগুনে বোলিংয়ের সামনে অদম্য মানসিকতায় বুক চিতিয়ে লড়াই সেই জীবনসংগ্রামের চিহ্নবহন করছে।

চেতেশ্বর পুজারা, ভুল লিখেছিলাম। ঘ্যানঘ্যানে ইনিংস নয়, আপনার আরাধনা শেষ হল।

চেতেশ্বর পুজারা, ভুল লিখেছিলাম। টি-টোয়েন্টি যুগে বড়লোকি চালে ফেরারি নিয়ে সিগন্যাল না মেনে ছোটাটাই যখন রেওয়াজ, তখন আপনি নিশ্চিত করেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের রোল্‌স রয়েসের মধ্যে বসে আমরা নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারি।

চেতেশ্বর পুজারা, ভুল লিখেছিলাম। ক্রিকেটে বাড়তে থাকা লারেলাপ্পা মাইকের শব্দের মধ্যে আপনি সেতার নিয়ে সাধনায় বসা এক ওস্তাদ। দ্রুত যাঁরা অবলুপ্তির পথে।

চেতেশ্বর পুজারা, ভুল লিখেছিলাম। আপনাকে ভোলা যাবে না। যত দিন টেস্ট ক্রিকেট থাকবে, আপনিও থাকবেন। নীরব যোদ্ধারা আড়ালে থাকলেও সবচেয়েজ্বলজ্বল করেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cheteshwar Pujara test cricket Indian Cricket

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy